নাগরিক সংবর্ধনায় প্রধানমন্ত্রী

স্টাফ রিপোর্টার: আমার চাওয়া-পাওয়ার কিছু নেই, হারাবারও কিছু নেই। এদেশের মানুষের কল্যাণের জন্য আমি আত্মত্যাগ করতে সদা প্রস্তুত। আমরা দেশকে শাসন করতে আসিনি, এসেছি সেবক হয়ে জনগণের সেবা করতে। বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে এবং এগিয়ে যাবেই।

গতকাল শুক্রবার বিকেলে ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে জাতীয় নাগরিক কমিটির উদ্যোগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে নাগরিক সংবর্ধনা দেয়া হয়। এই অনুষ্ঠানে তিনি এসব কথা বলেন। এ সময় তিনি বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘উদয়ের পথে শুনি কার বাণী, ভয় নাই, ওরে ভয় নাই…নিঃশেষে প্রাণ যে করিবে দান ক্ষয় নাই তার ক্ষয় নাই’ আবৃত্তি করেন। ভারতের সঙ্গে স্থল সীমান্ত চুক্তি বাস্তবায়নসহ জাতীয় জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে সাফল্য অর্জনে নেতৃত্ব দেয়ায় এ সংবর্ধনার আয়োজন করা হয়। বিশাল এই সংবর্ধনার জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এ সম্মাননা আমার প্রাপ্য নয়, এটা বাংলার মানুষ ও বাংলাদেশের জনগণের প্রাপ্য। তাই আমি এ সম্মাননা বাংলাদেশের জনগণকে উত্সর্গ করছি।  দীর্ঘ ৪০ বছর পর ভারতের পার্লামেন্টে সর্বসম্মতভাবে স্থল সীমান্ত চুক্তির সংবিধান সংশোধনী বিল পাস হওয়াকে বর্তমান সরকারের রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক সাফল্য হিসেবে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশ আজ আর্থ-সামাজিকসহ সব দিক থেকে এগিয়ে চলেছে। মুক্তিযুদ্ধের সময় অনেকে বিদ্রূপ করে বলেছিল, ‘স্বাধীন হলেও বাংলাদেশ হবে তলাবিহীন ঝুড়ি।’ কিন্তু আমি বলতে চাই, বাংলাদেশ তলাবিহীন ঝুড়ি নয়। বরং অসীম মজবুত তলাযুক্ত এমন এক ঝুড়ি, যে ঝুড়ি উন্নয়নের রসদে ভরপুর। বাংলাদেশকে কেউ আর এখন অবজ্ঞার চোখে কিংবা অপছন্দ করে না।

বিকাল সাড়ে ৩টায় সংবর্ধনা অনুষ্ঠান শুরু হওয়ার কথা থাকলেও দুপুর আড়াইটার মধ্যে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে নির্মিত বিশাল প্যান্ডেল কানায় কানায় পরিপূর্ণ হয়ে যায়। অনুষ্ঠান শুরু হওয়ার পর মূল প্যান্ডেলে স্থান সংকুলান না হওয়ায় হাজার হাজার মানুষ প্যান্ডেলের বাইরে দাঁড়িয়ে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য শোনেন। বিকাল পৌনে ৪টার দিকে প্রধানমন্ত্রী অনুষ্ঠানস্থলে উপস্থিত হন। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন জাতীয় নাগরিক কমিটির সভাপতি কবি সব্যসাচী সৈয়দ শামসুল হক। প্রথমে জাতীয় সঙ্গীত ও কোরআন তেলাওয়াতসহ ধর্ম গ্রন্থ থেকে পাঠের মাধ্যমে মূল অনুষ্ঠান শুরু হয়। সূচনা বক্তব্য দেন সৈয়দ শামসুল হক। তিনি শেখ হাসিনার হাতে নৌকার প্রতিকৃতির স্মারক তুলে দেন। এরপর সংবর্ধনা উত্সবের মর্মসঙ্গীত এবং নৃত্য পরিবেশিত হয়। নৃত্যাঞ্চলের সদস্যরা দেশাত্মবোধক গানের সঙ্গে নৃত্য পরিবেশন করেন। এমিরেটাস অধ্যাপক ড. আনিসুজ্জামান অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রীর উদ্দেশে অভিজ্ঞানপত্র পাঠ করেন। ড. আনিসুজ্জামান অভিজ্ঞানপত্র পাঠের পর কাঠের ওপর শেখ হাসিনার প্রতিকৃতি সম্বলিত একটি স্মারক প্রধানমন্ত্রীর হাতে তুলে দেন।

সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে বিভিন্ন খাতে সরকারের সাফল্য তুলে ধরে বক্তব্য রাখেন ইতিহাসবিদ অধ্যাপক মুনতাসির মামুন, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্ণর ড. আতিউর রহমান, শহীদজায়া শ্যামলী নাসরিন চৌধুরী, শিক্ষাবিদ ড. অনুপম সেন, অর্থনীতিবিদ ড. কাজী খলিকুজ্জমান আহমদ, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব নাসিরউদ্দিন ইউসুফ এবং বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের সাবেক অধিনায়ক আকরাম খান। অনুষ্ঠানে বুদ্ধিজীবী, মন্ত্রিসভার সদস্য, প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা, আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য, সাধারণ সম্পাদকসহ কার্যনির্বাহী সংসদের সদস্য, ঢাকার দুই মেয়র, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর উপাচার্য, শিল্পী-সাহিত্যিক, সাংবাদিক, ব্যবসায়ী নেতা, আইনজীবী, পেশাজীবীসহ ঢাকা এবং আশেপাশের  জেলাগুলোর আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা উপস্থিত ছিলেন।

অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী বলেন, স্বাধীনতার সুফল ঘরে ঘরে পৌঁছে দিতে হবে যাতে প্রতিটি মানুষ তার অধিকার পায়। আমরা মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বাঙালি জাতিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য রূপকল্প ঘোষণা করেছি। এখন তার বাস্তবায়নের কাজ চলছে। দারিদ্র্যই বাংলাদেশের একমাত্র শত্রু। এই দারিদ্র্য থেকে আমাদের দেশকে মুক্ত করতে হবে। জাতির জন্য যে কোনো ত্যাগ স্বীকারে আমি প্রস্তুত। আমি মৃত্যুকে ভয় করি না।

যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করার দৃঢ় অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করে শেখ হাসিনা বলেন, পঁচাত্তরের পর আমি প্রতিজ্ঞা করেছিলাম, এই বাংলার মানুষের জন্যই তো আমার বাবা আত্মত্যাগ করেছিলেন, কাজেই বাংলার মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তি, মানুষের অধিকার ফিরিয়ে আনা, গণতন্ত্রকে ফিরিয়ে আনতে, আমার পিতার সোনার বাংলা প্রতিষ্ঠার জন্য যা কিছু করা দরকার আমি সব করবো। সেই সঙ্গে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম সেই ঘাতক, যারা শুধু আমার পিতাকে কেড়ে নেয়নি, কেড়ে নিয়েছিলো বাংলার মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষাকে সেই খুনিদের বিচার বাংলার মাটিতে করবোই। আমরা তাদের বিচার করেছি। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার সম্পন্ন করতে দেশবাসীর সহযোগিতা কামনা করে তিনি বলেন, এদের বিচার চলছে, রায়ও কার্যকর হচ্ছে। ৭৫-এর ১৫ আগস্ট জাতির পিতাকে হত্যা করে বাংলাদেশের মর্যাদাকে ক্ষুণ্ন করা হয়েছিলো, সেই মর্যাদাকে ফিরিয়ে আনতে হবে। এই বাংলাদেশকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় সামনে এগিয়ে নেয়ার জন্য, অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য আমরা রূপকল্প ২০২১ ঘোষণা করেছি এবং তার বাস্তবায়ন কাজ এখন চলছে।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, ২০২১ সালের স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী আমরা ক্ষুধা-দারিদ্র্যমুক্ত ভাবে উদযাপন করব। আর ২০৪১ সালে বাংলাদেশ বিশ্বের বুকে উন্নত ও সমৃদ্ধ দেশ হিসেবে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবেই। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের ক্ষুধা-দারিদ্র্যমুক্ত অসাম্প্রদায়িক মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বাংলাদেশ আমরা গড়ে তুলবোই।

সভাপতির বক্তব্যে সৈয়দ শামসুল হক বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ‘দেশরত্ন’ উপাধিতে ভূষিত করা হয়েছে। আজ থেকে শেখ হাসিনার নামের প্রারম্ভে আবশ্যিকভাবে ‘দেশরত্ন’ শব্দটি ব্যবহার হবে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু যেমন ছিলেন রাজনীতির কবি, তাঁর কন্যা শেখ হাসিনা হচ্ছেন উন্নয়নের কবি। প্রজ্ঞা, দূরদৃষ্টি এবং অকুতোভয় চিত্তে তিনি দেশকে ক্রমাগত উন্নয়নের দিকে নিয়ে যাচ্ছেন। সৈয়দ শামসুল হক তাঁর বক্তব্যের সময় পুরো সংবর্ধনা অনুষ্ঠান সফল হওয়ার পেছনে কঠোর পরিশ্রম করার জন্য স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিমসহ নাগরিক সমাজের সংশ্লিষ্ট সবার কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন।

ইতিহাসবিদ অধ্যাপক ড. মুনতাসীর মামুন বলেন, শেখ হাসিনার সরকার বাংলাদেশকে বিশ্বের কাছে মাথা উচু করে দাঁড় করিয়েছে। আমাদের মর্যাদাবান করেছে, সম্মানিত করেছে। পার্বত্য চট্রগ্রামে শান্তি চুক্তি, ভারতের সঙ্গে গঙ্গা চুক্তি, সমুদ্র সীমা বিজয় অর্জন করেছে। এখন মুজিব-ইন্দিরা চুক্তি বাস্তবায়ন করছে।

অর্থনীতিবিদ ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ বলেন, আমাদের সামাজিক, অর্থনৈতিক যে অর্জন তা দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে নেই। দারিদ্র্যের হার কমেছে। মানুষের আয় বৃদ্ধি পেয়েছে। একজন দিনমজুরও সারাদিন পরিশ্রম করে ১১ কেজি চাল ক্রয় করতে পারে। সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব নাসির উদ্দীন ইউসুফ বাচ্চু বলেন, অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র গঠনে শেখ হাসিনার সাহসী পদক্ষেপ পুরো দেশের সংস্কৃতিই পাল্টে দিয়েছে। জঙ্গি-সন্ত্রাস-সাম্প্রদায়িক অপশক্তির বিরুদ্ধে শেখ হাসিনার লড়াইয়ে পুরো দেশের মানুষ তাঁর সঙ্গে থাকবে। বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ড. অনুপম সেন বলেন, বর্তমান সরকারই শিক্ষার আলো দান করেছে। শহীদ জায়া শ্যামলী নাসরিন বলেন, শেখ হাসিনার সরকার আমলে যুদ্ধাপরাধীর বিচার ও রায় কার্যকর হওয়ায় শহীদদের আত্মা শান্তি পাচ্ছে। সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের সাবেক অধিনায়ক আকরাম খান ক্রিকেটসহ ক্রীড়াঙ্গনে প্রধানমন্ত্রীর বিভিন্ন কার্যক্রমের কথা তুলে বলেন, প্রধানমন্ত্রীর সব ধরনের সহযোগিতার জন্য দেশের বিভিন্ন জায়গায় আধুনিক ক্রীড়া অবকাঠামো গড়ে উঠেছে। তাঁর অনুপ্রেরণায় বাংলাদেশ নিউজিল্যান্ড ও পাকিস্তানকে হোয়াইটওয়াশ করতে সক্ষম হয়েছে। যেখানে যে অবস্থায় খেলা হয়, তিনি খেলোয়াড় ও কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলেন। এটা পরবর্তী জয়ে অবদান রাখে।

সংবর্ধনা অনুষ্ঠান শেষে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের বিশাল মঞ্চে মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান পরিবেশন করা হয়। প্রধানমন্ত্রী মঞ্চে থেকে বিশিষ্ট রবীন্দ্র সঙ্গীত শিল্পী মিতা হক ও মনিরুজ্জামান চৌধুরীর পরিবেশনায় রবীন্দ্র সঙ্গীত, এম এ মান্নান ও বুলবুল মহলানবীশসহ অন্যান্য শিল্পীর পরিবেশনায় নজরুল সঙ্গীত এবং মমতাজ বেগম এমপির কণ্ঠে ছিটমহল নিয়ে লেখা গান শোনেন। সংবর্ধনা অনুষ্ঠানের পর দেশের ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠীর পরিবেশনায় মনোজ্ঞ নৃত্যও পরিবেশন করা হয়।