নতুনরূপে আসছে এমপিও ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে জনবল নীতিমালা

প্রস্তাব বাস্তবায়ন হলে সারা দেশে প্রায় দেড় লাখ নতুন শিক্ষক-কর্মচারী নিয়োগ

 

স্টাফ রিপোর্টার: নতুনরূপে আসছে ‘এমপিও এবং জনবল কাঠামো’ নির্দেশিকা। বেসরকারি পর্যায়ের স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসায় বিভিন্ন ধরনের নিয়োগ, পদোন্নতি এবং শিক্ষক-কর্মচারীদের আর্থিক সুবিধার এ ‘গাইড লাইন’ সর্বশেষ ৫ বছর আগে আমূল সংস্কার হয়। কিন্তু ২০১২ সালে চালু নতুন শিক্ষাক্রম এবং দেশব্যাপী মানসম্মত পাঠদান বিঘ্নিত হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে এটি পুনরায় নতুন আঙ্গিকে তৈরির উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। একটি খসড়াও ইতোমধ্যে তৈরি করা হয়েছে, যা চূড়ান্ত করতে আজ শনিবার রাজধানীতে জাতীয় কর্মশালায় বসছেন সংশ্লিষ্টরা।

শিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, মোট ১১ ধরনের মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক এবং ডিগ্রি পর্যায়ের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এতে বিষয়ভিত্তিক শিক্ষক আর কর্মচারী নিয়োগের লক্ষ্যে নতুন পদ সৃষ্টির প্রস্তাব রয়েছে। প্রস্তাব বাস্তবায়ন হলে সারা দেশে অন্তত ১ লাখ ৩৭ হাজার নতুন শিক্ষক-কর্মচারী নিয়োগ দেয়া যাবে। পাশাপাশি এতে বরাবরের মতোই অনার্স-মাস্টার্স কলেজ, অনার্স ও কামিল মাদ্রাসা, সংগীত কলেজ, শরীর চর্চা কলেজ, চারুকলা কলেজ, গার্হস্থ্য অর্থনীতি কলেজ ও নৈশকালীন বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ মোট ৯ ধরনের প্রতিষ্ঠান বাদ দেয়া হয়েছে।

অথচ সরকার কয়েক বছর ধরে সারা দেশে কলেজ ও মাদ্রাসায় এক প্রকার লাগামহীনভাবেই অনার্স-মাস্টার্স প্রোগ্রাম চালুর অনুমতি দিয়ে যাচ্ছে। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের হিসাবে বর্তমানে সারা দেশে ৬ শতাধিক কলেজে অনার্স প্রোগ্রাম রয়েছে। এর মধ্যে মাত্র ১৯০টি সরকারি কলেজ, বাকি ৪ শতাধিক কলেজই বেসরকারি। এছাড়া ৩১টি মাদ্রাসায় সরকার অনার্স চালুর অনুমতি দিয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানের লক্ষাধিক শিক্ষক কলেজ তহবিল থেকে যে পরিমাণ বেতন-ভাতা পান, তা নিয়েই দিন কাটাচ্ছেন। তাদের জন্য এবারের নীতিমালায়ও কোনো নির্দেশনা নেই। খসড়া নীতিমালাটি তৈরি করেছে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতর (মাউশি)। আজকের কর্মশালায় সভাপতিত্ব করবেন সংস্থাটির মহাপরিচালক অধ্যাপক ফাহিমা খাতুন। তিনি জানান, গত বছরের ৩১ আগস্ট শিক্ষা মন্ত্রণালয় পরিদর্শনকালে এমপিও প্রদানের ব্যাপারে বেশকিছু নির্দেশনা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। তাছাড়া নতুন কারিকুলাম ও ভৌগোলিক অবস্থান এবং নয়া বিষয়-বিন্যাসের কারণে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নতুন শিক্ষক নিয়োগ দেয়া হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা অনুযায়ী চাহিদা আর অগ্রাধিকার ভিত্তিতে এমপিও দেয়া হবে। এ কারণে এমপিও নীতিমালায় সংশোধন আনা প্রয়োজন। দেশে বর্তমানে এমপিওভুক্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ২৬ হাজার ৯০টি। এসব প্রতিষ্ঠানে বর্তমানে তিন লাখ ৬০ হাজার ৬৪৮ জন শিক্ষক রয়েছেন। আর কর্মচারী রয়েছে প্রায় এক লাখ পাঁচ হাজার ৫৭৪ জন। সব মিলিয়ে এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীর সংখ্যা রয়েছে প্রায় চার লাখ ৬৬ হাজার জন।

অপরদিকে প্রস্তাবিত নীতিমালা অনুযায়ী, নতুন পদ সৃষ্টির কারণে উল্লিখিত ২৬ হাজার ৯০টি এমপিওভুক্ত প্রতিষ্ঠানে আরও ১ লাখ ২ হাজার ৬৭৪ জন শিক্ষক-কর্মচারী নতুন নিয়োগ করা যাবে। এর মধ্যে নিম্ন মাধ্যমিক পর্যায়ের ৩ হাজার ৩৩৭টি প্রতিষ্ঠানে ৭ জন করে মোট ২৩ হাজার ৩৫৯ জন, মাধ্যমিক স্কুলে (নিম্ন মাধ্যমিকসহ) আগের চেয়ে ২ জন বেশি ধরে মোট ১২ হাজার ৭৯২টিতে ২৫ হাজার ৫৮৪ জন, ১৪৩৬টি উচ্চ মাধ্যমিক স্কুল বা কলেজে ১ জন বেশি ধরে সমসংখ্যক, ৯২৭টি ডিগ্রি কলেজে ১ জন বেশি করে ধরে একই সংখ্যক এবং দাখিল ও আলিম পর্যায়ের মাধ্যমে ৮ জন (যথাক্রমে ৬ জন ও ২ জন বেশি) বেশি ধরে ৫১ হাজার ৩৬৮ জন শিক্ষক-কর্মচারী নতুন নিয়োগ করা যাবে, যারা এমপিও পাবেন।

শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও মাউশি সূত্র জানিয়েছে, সারা দেশে বর্তমানে প্রায় ৯ হাজার মাধ্যমিক থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসা রয়েছে। যার একটিও এমপিওভুক্ত নয়। এসব প্রতিষ্ঠানে অন্তত ৩৫ হাজার শিক্ষক-কর্মচারী নিয়োগ হবে। উল্লেখ্য, বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের (স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা ও কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহ) শিক্ষক ও কর্মচারীদের এমপিও প্রদান এবং জনবল কাঠামো সম্পর্কিত নির্দেশিকা শীর্ষক এ নীতিমালা প্রথমে ১৯৯৫ সালে প্রণীত হয়। ২০১০ ও ২০১৩ সালে এটি দু’দফায় সংশোধিত হয়েছে।

খসড়ায় যা আছে : ৬টি শর্ত পূরণ করে এমপিও পেতে হয়। এগুলো হচ্ছে- প্রাপ্যতা, স্বীকৃতি/অধিভুক্তি, জনবল কাঠামো পূরণ, কাম্য শিক্ষার্থী ও ফলাফল, ব্যবস্থাপনা কমিটি। এ ছয়টির মধ্যে এমপিও প্রত্যাশী প্রতিষ্ঠানকে এখন ৫০% শিক্ষার্থীর পরিবর্তে ৭০% শিক্ষার্থীকে পাস করা হবে। ইতোপূর্বে বাংলা, ইংরেজি ও সামাজিক বিজ্ঞান বিষয়ের জন্য নিম্ন মাধ্যমিক স্কুলে ১ জন করে শিক্ষক নিয়োগ করা যেত। কিন্তু নতুন প্রস্তাবে এ তিন বিষয়ের জন্য তিনজন শিক্ষক নিয়োগের কথা রয়েছে। আবার মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের স্কুলে বাংলা, ইংরেজি, সামাজিক বিজ্ঞান ও ব্যবসায় শিক্ষার জন্য ৩ জন শিক্ষক পাওয়া যেত। এখানে আরও ১ জন বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। তবে বাড়তি এ শিক্ষকটি হবেন ব্যবসায় শিক্ষা বিষয়ের।

মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে প্রথমবারের মতো শারীরিক শিক্ষা, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি এবং চারু ও কারুকলা বিষয় প্রবর্তন করা হয়েছে। এগুলোর মধ্যে ইতঃপূর্বে শরীরচর্চা শিক্ষক যারা ছিলেন তারা শারীরিক শিক্ষা বিষয়ের শিক্ষক হিসেবে গণ্য হবেন। আর বাকি দুই বিষয়ের জন্য শিক্ষক দেয়ার প্রস্তাব রয়েছে। এর বাইরে স্কুল ও মাদ্রাসায় কৃষি এবং গার্হস্থ্য বিষয়ে অভিন্ন না হলেও একই শিক্ষককে পড়াতে হতো। নতুন নীতিমালায় গার্হস্থ্য বিষয়ের জন্য আলাদা শিক্ষকের প্রস্তাবের পাশাপাশি বালিকা বিদ্যালয়গুলোতে এই বিষয় বাধ্যতামূলকভাবে প্রবর্তনের কথা রয়েছে। মাদ্রাসায় দাখিলে ইতঃপূর্বে যেখানে কম্পিউটার শিক্ষক ছিল না, সেখানে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিষয়ের জন্য শিক্ষক দিতে হবে। এ একই বিষয়ের শিক্ষক দেয়ার প্রস্তাব রয়েছে আলিম স্তরেও। ইতঃপূর্বে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের স্কুলে এবং দাখিল ও আলিম পর্যায়ের মাদ্রাসায় বিজ্ঞানের শিক্ষক ছিলেন ১ জন। তিনিই পদার্থ, রসায়ন, জীববিদ্যা ও উচ্চতর গণিত পড়াতেন। নতুন প্রস্তাবে ভৌতবিজ্ঞান এবং জীববিজ্ঞানের জন্য আলাদা শিক্ষক নিয়োগের প্রস্তাব করা হয়েছে। আবার নিম্ন মাধ্যমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ের প্রতিষ্ঠানে বর্তমানে এমএলএসএস ১ জন করে রয়েছেন। এক্ষেত্রে ৩ জন করার প্রস্তাব রয়েছে। উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয় এবং আলিম মাদ্রাসায় এ নীতি অনুসরণ হলেও সহশিক্ষা বা মহিলা কলেজ হলে একজন আয়া নিয়োগ করতে হবে। দাখিল ও আলিম স্তরের মাদ্রাসায় আগের চেয়ে ১ জন বেশি এমএলএসএস দেয়ার কথা বলা হয়েছে। উচ্চ মাধ্যমিকে প্রভাষকদের এমপিওভুক্তির ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে ২৫ জন করে শিক্ষার্থী থাকতে হয়। কিন্তু প্রস্তাবিত নীতিমালায় বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে এ শর্ত শিথিল করে ১৫ জন করা হয়েছে। প্রস্তাবিত খসড়ায় দেখা যাচ্ছে, ইবতেদায়ি সংযুক্ত দাখিল, আলিম ও ফাজিল মাদ্রাসায় বাংলা, ইংরেজি, সামাজিক বিজ্ঞান ও ব্যবসায় শিক্ষায় ২ জন করে শিক্ষক পেলেও তা ৪ জন করা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে প্রত্যেক বিষয়ে ১ জন করে পাবে। সেই হিসাবে ব্যবসায় শিক্ষা চালু না থাকলে এ বিষয়ে শিক্ষক নিয়োগ করা যাবে না। দাখিল মাদ্রাসায় ১ জন করে সহকারী গ্রন্থাগারিক কাম ক্যাটালগার দেয়ার প্রস্তাবও দেয়া হয়েছে।