নকল ও ভেজাল ভুট্টাবীজে চুয়াডাঙ্গার বিভিন্ন বাজার সয়লাব

চড়ামূল্যের বাহারি চকচকে মোড়কের ভুট্টাবীজের গুণগত মান নিয়ে চাষিরা শঙ্কিত

নজরুল ইসলাম: ভুট্টা রোপণের সময় হলেই বিভিন্ন কোম্পানির বিক্রয় প্রতিনিধিরা ভিড় জমায় খুচরা বিক্রেতা ডিলারদের কাছে। কৃষকদের আকৃষ্ট করতে ভুট্টাবীজের বিভিন্ন কোম্পানি অবলম্বন করেছে নানামুখি কৌশল। চড়ামূল্যের চকচকে মোড়কের ভুট্টাবীজের গুণগত মান নিয়ে চাষিরা শঙ্কিত হলেও বিষয়টি দেখার কেউ নেই। বিভিন্ন কোম্পানি এসব বীজ চড়াদামে বিক্রির সময় প্রতিনিধি নিয়োগ করে কৃষকদের দ্বারে দ্বারে পাঠায়। ভুট্টা ওঠার সময় কৃষকদের উৎপাদিত ভুট্টার মূল্য নিয়ে কেউ ভাবে না।

এলাকা ঘুরে জানা গেছে, গত বছর ভুট্টাচাষিরা তাদের উৎপাদিত ভুট্টা বিক্রি করতে গিয়ে রীতিমত খেয়েছে নাকানি চুবানি। ধান ও পাটের মূল্য না পেয়ে চলতি মরসুমে আবারও  ভুট্টাচাষের দিকে ঝুঁকছে চাষিরা। ভরা মরসুমে ভুট্টার দাম না থাকলেও বর্তমানে ভুট্টার দাম প্রতিমণ ৮শ টাকার ওপরে। যখন চাষিদের ভুট্টা বিক্রি শেষ ঠিক তখনি ভুট্টা কেনা সিন্ডিকেট চাষিদের নতুন করে ভুট্টাচাষ করার জন্য দাম বৃদ্ধি করে থাকে। যেন আবারও ভুট্টাচাষ করে চাষিরা। এতে চাষিরা লাভবান না হলেও লাখপতিরা হচ্ছে কোটিপতি। মহাজনদের কাছ থেকে সার, বীজ ও কীটনাশক নিয়ে চাষিরা ভুট্টাচাষ করে। ভুট্টা ওঠার সাথে সাথে মহাজনের ঋণ শোধ করতে মহাজনদের বেধে দেয়া কম মূল্যে ভুট্টা বিক্রি করতে বাধ্য হয় চাষিরা। একটি সূত্র বলেছে, সারাদেশে ভুট্টা ক্রয় ও বীজ উৎপাদনের কয়েকটি সিন্ডিকেট আছে। তারা তাদের সুবিধামত ভুট্টাক্রয় এবং বীজ বিক্রি করে থাকে। কারণ ভুট্টার বীজ সংরক্ষণ বা উৎপাদন করার মতো টেকনোলজি চাষিদের নেই। তাই অনেকটা বাধ্য হয়েই কোম্পানির আমদানিকৃত বা উৎপাদিত ভুট্টাবীজ কিনতে হয় চাষিদের। এ বছর ফসলের দাম না পেয়ে হতাশ চাষিকুল। এরই মাঝে অনেক চাষি জড়িয়ে গেছে ঋণের জালে। মহাজনের ঋণ শোধ করতে আবারও প্রস্তুতি নিচ্ছে ভুট্টাচাষের। ঠিক সেই সুযোগটিই কাজে লাগাতে চাষিদের দোড়গোড়ায় হাজির বীজ কোম্পানির প্রতিনিধিরা। ভুট্টাবীজের বিভিন্ন কোম্পানির লোক নিজ কোম্পানির বীজের গুণাগুণ তুলেধরে চকচকে প্যাকেটে বীজ পৌঁছে দিচ্ছে পাইকারি ও খুচরা বিক্রেতাদের দোকানে। চুয়াডাঙ্গা সদরের বেগমপুর ও তিতুদহ ইউনিয়ন এলাকার চাষি আলী আহম্মদ, তোফাজেল, ফজলু ও বাক্কা জানান, যখন ভুট্টা উঠেছিলো তখন ভুট্টার মণ ছিলো সাড়ে ৫শ থেকে ৬শ টাকার মধ্যে। বর্তমানে বিক্রি হচ্ছে ৮শ টাকার ওপরে। কারণ এখন চাষিদের ঘরে আর ভুট্টা নেই। ধান ও পাটের দাম পাইনি। দীর্ঘমেয়াদী ফসল উৎপাদন করার মতো পর্যাপ্ত জমি নেই। তাই লোকসান পুশাতে আশায় বুক বেধে ভুট্টার চাষ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। ভুট্টার দাম না পেয়ে ঋণে জড়িয়ে পড়েছি। চাষ না করে উপায় কী।

কৃষি সম্প্রাসারণ অধিদপ্ত সূত্রে জানা গেছে, গত বছর চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলায় ভুট্টার চাষ হয়েছে ১৩ হাজার ২শ ৯০ হেক্টর জমিতে। ভুট্টার দাম না থাকায় লক্ষ্যমাত্রা অর্ধেকে নামার আশঙ্কা করা হয়েছিলো। কিন্তু বর্তমানে ভুট্টার দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় এ বছর বেশি জমিতে ভুট্টার চাষ হবে। সরকারিভাবে ভুট্টা ক্রয় বা বীজ সরবরাহ করা হয় না। তাই অধিকাংশ ভুট্টাবীজ আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানই হচ্ছে ভুট্টা ক্রয় কোম্পানি। অনেকটা স্বর্ণকারের মতো। কেনায়ও লাভ বিক্রিতেও লাভ। ভুট্টার ব্যাপারে সরকারিভাবে কোনো তদারকি নেই। থাকলেও নিয়ন্ত্রণকারীরা রয়েছে নিয়ন্ত্রণে। সরেজমিনে দেখা গেছে, এলাকার বীজ বিক্রেতাদের দোকানে দোকানে চকচকে বাহারি মোড়কে সিনজেন্টা, এলিট, মুনসেন্টা, পেট্রোকেম, উত্তরণ, ব্র্যাক, লালতীর, কৃষিবাণিজ্য প্রতিষ্ঠান, থ্রীএস অ্যাগ্রো সার্ভিস, অট্রোকৃষি, সিপি লিমিটেডসহ বিভিন্ন জাতের ভুট্টাবীজে বাজার সয়লাব। আর দোকানে দোকানে বসিয়ে রাখা হয়েছে কোম্পানির লোক। চাষিরা দোকানে এলে বীজের মান এবং ফলনের ব্যাপারে শোনানো হচ্ছে বাহারি কথা। এ বছর সর্বনিম্ন এক কেজি ভুট্টাবীজ ২২০ টাকা থেকে ৪৬০ টাকা পর্যন্ত হাকানো হয়েছে। থ্রীএস অ্যাগ্রোসার্ভিসের ১ কেজি ভুট্টাবীজ চাষিদের কিনতে হচ্ছে ৪৬০ টাকায়। ফলে এ কোম্পানির ১ মণ ভুট্টাবীজ কিনতে ভরামরসুমে চাষিদের বিক্রি করতে হবে ৩০ মণ ভুট্টা। চাষিরা জানায়, গতবছর একবিঘা জমিতে ভুট্টাচাষ করতে খরচ পড়েছে ১৫ থেকে ১৭ হাজার টাকার মতো। আর এক বিঘা জমির ভুট্টা বিক্রি হয়েছে ১৪ থেকে ১৬ হাজার টাকায়। লাভ তো দূরের কথা অধিকাংশ চাষিরা জড়িয়ে পড়েছে ঋণের জালে। বিষয়টির প্রতি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নজর দেয়া দরকার বলে মনে করছে ভুক্তভোগী চাষিকুল।