ধান নিয়ে কৃষকের কান্না

ধান নিয়ে কৃষকের কান্না, ঋণে দিশেহারা বর্গাচাষি
স্টাফ রিপোর্টার: ১৬ কোটি মানুষের খাদ্যের যোগান দেন কৃষক। সেই কৃষকই এবার আমণ ধান চাষ করে বিঘাপ্রতি লোকসান গুনছেন হাজার হাজার টাকা। বর্গাচাষিদের অবস্থা আরো করুণ। তারা চড়া সুদে দাদন ব্যবসায়ী মহাজনের কাছ থেকে ঋণ নিয়ে আবাদের পর ধান বিক্রি করে ন্যায্যমূল্য না পেয়ে দিশেহারা হয়ে পড়েছেন। বাম্পার ফলনের কারণে মাঠে থাকা যে ধান নিয়ে চাষিরা স্বপ্ন দেখতেন সেই ধান এখন তাদের গলার ফাঁস হয়ে দাঁড়িয়েছে। সারাদেশের মতো দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলেও আমণ ধানের বাজার দর প্রায় অভিন্ন। বাজারে ধান বিক্রি না হওয়ায় অনেকেই ফেরত নিয়ে যাচ্ছেন। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে কৃষকের ঘরে নতুন আমণ ধান ঠাসা রয়েছে। তারা দাম না পেয়ে বিক্রি করতে পারছেন না। বিক্রি করলে কোনো কোনো বাজারে দাম খরচের সমান সমান ওঠে। আবার কোথাও লোকসান হয়। এ কারণে তারা এবার দুশ্চিন্তায় পড়েছেন। এ চিত্র শুধুই দণি-পশ্চিমাঞ্চলের নয়, সারাদেশের।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর সূত্র জানায়, দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২টি রিজিয়ন খুলনার ৪টি জেলা ও যশোরের ৬টি জেলায় এবার মোট ৬ লাখ ২১ হাজার ৯৬ হেক্টর জমিতে রোপা আমণ আবাদ হয়। চালের হিসাবে উৎপাদন হয় ১৮ লাখ ৮২ হাজার ৩৮১ মেট্রিক টন চাল। হেক্টর প্রতি উৎপাদন হয়েছে হাইব্রিড জাতের ৩ দশমিক ৮১ ও উফশী জাতে ২ দশমিক ৯৯ মেট্রিক টন চাল।
মাঠপর্যায়ের কৃষি কর্মকর্তারা বলেছেন, এই ফলন আশানুরূপ। কৃষকরাও ধান কাটা মরসুমে খুবই খুশি ছিলেন। কিন্তু তারা দুশ্চিন্তায় পড়েছেন উপযুক্ত ও ন্যায্যমূল্য পাওয়া নিয়ে। আবহাওয়া কিছুটা অনুকূল থাকায় এবং সার্বণিক চাষিরা পরিচর্যা করার কারণে রোপা আমনের বাম্পার ফলন হয়েছে। কৃষকের কথা হচ্ছে, ধানের ফলন তো ভালোই হয়েছে কিন্তু দাম তো পড়ন্ত। বাজারে ধানের দাম ৫০০ টাকা থেকে ৫১০ টাকা মণ। জমি প্রস্তুত, রোপণ, সার, পরিচর্যা, কাটা, মাড়াই ও বাজারে তোলা সবমিলিয়ে যে খরচ হয়, তা উঠছে না ওই দামে বিক্রি করলে। বাজারে সব কিছুর দাম আছে, শুধু নেই প্রান্তিক চাষির ঘাম ঝরানো ফসলের।
যশোর কেশবপুরের আতাউর রহমান মেম্বার জানান, আমণ ধান উঠেছে। তবে ন্যায্য দাম পাচ্ছেন না কৃষক। যা দাম তাতে উৎপাদন ব্যয়ও উঠছে না। এদিকে বেড়েছে সার বীজ সেচ কীটনাশক আর ধান কাটাই মাড়াই শ্রমিকের মজুরি। ফলে উৎপাদন খরচ বাড়ছে। এক বিঘা জমিতে ধান ফলাতে খরচ হয়েছে কম করে হলেও প্রায় ৭ হাজার টাকা। ধান মিলেছে ১০/১২ মণ। আর তাদের বিক্রি করতে হয়েছে ৫ থেকে ৬ হাজার টাকা। সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে প্রান্তিক চাষিরা। তারা জোতদারের জমি বর্গা নিয়ে আবার কেউ বছরওয়ারি বিঘা প্রতি জমি ভাড়া নিয়ে চাষাবাদ করেন। সব খরচ কৃষকের। ধান কাটার সময় মহাজন চুক্তি মোতাবেক তার অংশ মাঠ থেকেই বুঝে নিয়ে যান। আর ভাড়া করা জমির টাকাতো আগাম দিতে হয়। এলাকা ভেদে প্রতি বিঘার ভাড়া বছর প্রতি ৬ থেকে ৮ হাজার টাকা। লাভ লোকসান সব প্রান্তিক চাষির ঘাড়ে। এসব দেখার কেউ নেই। যাদের দু’দশ বিঘা জমি আছে তাদের অবস্থাও একই রকম। প্রান্তিক চাষিরা সরকারের দেয়া কোনো সুবিধা ভোগ করতে পারেন না। ব্যাংক ঋণ ও অন্যান্য সুযোগ সুবিধা মেলে জমির মালিকানার কাগজ দেখে। অনেক জোতদার বর্গাচাষির ফসল দেখিয়ে ব্যাংক থেকে কৃষি ঋণ নিয়ে অন্য ব্যবসায় লাগান। আবার অল্প জমির মালিকরা কৃষি ঋণ নিতে গিয়ে পড়েন নানা বিড়ম্বনায়।
বেশ কয়েকজন জমির মালিক বলেন, ৩০ হাজার টাকা ঋণ নিতে গিয়ে খরচ করতে হয়েছে ৫ হাজার টাকা। তারপরতো সুদ রয়েছেই। এসব ঝক্কি ঝামেলা এড়াতে বাধ্য হয়ে তারা দ্বারস্থ হন মুখিয়ে থাকা সুদি মহাজন আর এনজিওগুলোর। এনজিওগুলো সেবা নয় পুরোদস্তুর ব্যবসা করছে এসব অসহায় কৃষকদের নিয়ে। এমন অভিযোগ মাঠে প্রান্তরে শোনা যায়। এরপর বাড়তি উপদ্রব হলো ফড়িয়ারা। এরা ফসল ওঠার আগ থেকে মাঠে মাঠে হামলে পড়েন। ছলে বলে কৌশলে কৃষকের ঘাম ঝরানো ফসল তাদের ঘরে যাবার আগে চলে যায় ফড়িয়াদের গোলায়। এরা সিন্ডিকেট করে বাজার নিয়ন্ত্রণ করেন। ফসল ওঠার সময় দাম ফেলে দিয়ে কৃষকের ঘর শূন্য করে। এরপর ফের তারা দাম বাড়িয়ে দেন। লাখ লাখ কৃষক এভাবে প্রতারিত হচ্ছেন প্রতিনিয়ত। নিরাশ হতে আরও নিরাশ হচ্ছে। ঋণের আটোসাটো ফাঁস হতে মুক্তি পাবার জন্য এক চিলতে জমি গরু বসতভিটে সবই চলে যাচ্ছে। সব হারিয়ে অনেক কৃষক পেশা বদল করে গ্রাম ছেড়েছেন।
দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের কৃষি নির্ভর এলাকার কৃষকরা জানান, আমণ ধান কাটা-মাড়াই শেষ। প্রস্তুতি চলছে ইরি-বোরো ধান আবাদের। পর্যাপ্ত বৃষ্টি না হওয়ায় এবার আমন আবাদ করতে কৃষককে বাড়তি খরচ করতে হয়েছে সেচের পানির জন্য। অতিরিক্ত খরচ আর শত কষ্টের মধ্যে ধান ঘরে তুলে কৃষক কিছুটা তৃপ্তির হাসি হেসেছে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য এই হাসি নিমিষেই ম্লান হয়ে গেছে কৃষকের মুখ থেকে। বাজারে ধানের দাম নেই। সরকারও গত ইরি-বোরো মরসুম থেকে চলতি আমন ধান কেজি প্রতি এক টাকা কমিয়ে ক্রয় করতে শুরু করেছে। শুধু তাই নয় এবার সরাসরি কৃষকদের কাছ থেকে ধান ক্রয় করছে না সরকার। তাই দেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণে মন্ত্রীর তৃপ্তির ঢেকুর এবং কৃষিতে সাফল্যের ঢোল পেটানো হলেও যারা ধান উৎপাদন করেন সে কৃষকের মুখে হাসি নেই। সারাদেশের কৃষক আর বর্গাচাষিদের কান্না যেন থামছেই না। ধানের বাম্পার ফলন হলেও উৎপাদন খরচের চেয়ে বাজার মূল্য কম হওয়ায় কৃষকরা পড়েছেন বিপাকে। চড়া সুদে ঋণ নিয়ে ধানচাষ করে দেনা পরিশোধ করতে না পারায় কৃষকরা দিশেহারা। এবছর সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন বেড়েছে দ্বিগুণ, অথচ লোকসানে ধান বিক্রি করতে হচ্ছে কৃষকদের। দেশের উন্নয়নে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রাখা কৃষককুল চরম দুর্গতিতে পড়েছেন।