দ্রুত নির্বাচন চায় যুক্তরাষ্ট্র

স্টাফ রিপোর্টার: গত ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে বাংলাদেশের মানুষ একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ পরিবেশে এবং সবার কাছে গ্রহণযোগ্য উপায়ে তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারেনি। তাই এ নির্বাচন বাংলাদেশের মানুষসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে গ্রহণযোগ্য নয় বলে মনে করে যুক্তরাষ্ট্র। নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা বিষয়ে ওই দিন কতো শতাংশ ভোট পড়লো কিংবা মানুষের অংশগ্রহণ কেমন ছিলো তার বিবেচনা শুরু থেকেই যুক্তরাষ্ট্রের কাছে গুরুত্ব পায়নি। বরং অর্ধেকেরও বেশি আসনে কোনো নির্বাচনী প্রতিদ্বন্দ্বিতা না থাকাকেই নির্বাচন অগ্রহণযোগ্য হওয়ার জন্য যথেষ্ট মনে করছে যুক্তরাষ্ট্র। এ অবস্থায় বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক অভিযাত্রা বহাল ও অর্থনৈতিক অর্জনের গতি অব্যাহত রাখতে বাংলাদেশে খুব দ্রুত সব দলের অংশগ্রহণে একটি প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচন চায় যুক্তরাষ্ট্র। বাংলাদেশের দশম জাতীয় সংসদের একতরফা নির্বাচন এবং এর মাধ্যমে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সরকার গঠন বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্র সরকারের প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে স্টেট ডিপার্টমেন্টের মুখপাত্র গতকাল উপরিউক্ত মন্তব্য করেন। ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পরদিন যুক্তরাষ্ট্র এ নির্বাচন গ্রহণযোগ্য নয় বলে মন্তব্য করেছে। দশম জাতীয় সংসদের নির্বাচিত সদস্যরা ইতোমধ্যেই শপথ নিয়েছেন এবং আজ আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করতে যাচ্ছে। এ নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসা সরকারকে যুক্তরাষ্ট্র স্বীকৃতি দেবে কি-না, কিংবা নতুন সরকারের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক কেমন হবে- এমন প্রশ্নের জবাবে মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্টের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়া বিষয়ক মুখপাত্র এমিলি হর্ন বলেন, প্রথমেই মনে রাখতে হবে যুক্তরাষ্ট্র সরকারকে স্বীকৃতি দেয় না, রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দেয়।  তাই একটি দেশের কোনো দল বা সরকারের চেয়ে রাষ্ট্রের সাথে সম্পর্ককেই গুরুত্ব দেয় যুক্তরাষ্ট্র। তবে ওই রাষ্ট্রের নেতৃত্ব গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত কি-না সে বিষয়টি যুক্তরাষ্ট্র গুরুত্ব দিয়ে দেখে। কেননা যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের বিষয়ে কোনো ধরনের আপস করার সুযোগ নেই। ওই লিখিত বার্তায় বাংলাদেশের নির্বাচন বিষয়ে এর আগে স্টেট ডিপার্টমেন্টের বিবৃতির বরাত দিয়ে মুখপাত্র বলেন, যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বাস করে বাংলাদেশের মানুষের আকাঙ্খার প্রতিফলন ঘটিয়ে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের সুযোগ এখনও আছে। আর এ উদ্দেশে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে খুব দ্রুত নতুন করে গঠনমূলক সংলাপ শুরু করা উচিত। কেননা যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশে যথাসম্ভব দ্রুত একটি গণতান্ত্রিক উপায়ে নির্বাচিত সরকার দেখতে চায়। নতুন সরকারের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক কেমন হবে- প্রশ্নের এ অংশটুকুর উত্তরে মুখপাত্র বলেন, এ বিষয়টি নির্ভর করছে সরকারের পরবর্তী কার্যক্রমের ওপর। স্বাভাবিকভাবেই আমরা (সরকারের ধরন ও কর্মকাণ্ড) পর্যবেক্ষণ করবো তবে যে কোনো পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের জনগণকে সমর্থন করার যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিশ্রুতি অটুট থাকবে। এদিকে বাংলাদেশের রাজনৈতিক অচলাবস্থার অবসানের দাবিতে মার্কিন কংগ্রেসের সিনেট কমিটি অন ফরেন রিলেশন্স কমিটিতে গত ১১ ডিসেম্বর উত্থাপিত রেজ্যুলেশন্স ৩১৮ গত ৭ জানুয়ারি সিনেটের ফুল কমিটিতে সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়েছে। রেজ্যুলেশন ৩১৮ সিনেটে উত্থাপনের পর বেশ কিছুদিন সরকারি ছুটির কারণে সিনেট অধিবেশন মূলতবি থাকায় প্রস্তাবটি গ্রহণ করতে দেরি হয়। এর ফলে এ প্রস্তাব গ্রহণের আগেই বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচনসহ প্রস্তাবে উল্লিখিত অনেক বিষয় প্রাসঙ্গিকতা হারালেও এ প্রস্তাবের মূল স্পিরিট অর্থাৎ রাজনৈতিক সংস্কৃতির সংস্কার, সব ধরনের রাজনৈতিক সহিংসতা বন্ধ এবং সর্বোপরি রাজনৈতিক অচলাবস্থার অবসানে একটি গ্রহণযোগ্য জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের লক্ষ্যে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে গঠনমূলক সংলাপের প্রয়োজন এখন আগের চেয়েও অনেক বেশি বলে মনে করছে মার্কিন সিনেট। এ বিষয়ে সিনেট কমিটি অন ফরেন রিলেশন্সের একটি উঁচু পর্যায়ের সূত্র এ প্রতিনিধিকে বলে, ভবিষ্যতে বাংলাদেশ বিষয়ে সিনেটের যে কোনো পদক্ষেপ নিতে রেজ্যুলেশন ৩১৮-কে ভিত্তি ধরেই এগিয়ে যাওয়া হবে। এখানে লক্ষ্য করার বিষয়, বাংলাদেশের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পরও গত ৭ জানুয়ারি সিনেটে গৃহীত রেজ্যুলেশনে বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচন বিষয়ে সিনেটের আগের অবস্থানের কোনো ব্যত্যয় ঘটেনি, একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের লক্ষ্যে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে গঠনমূলক সংলাপের বিষয়ে ইতোপূর্বে সিনেটের যে দাবি তার কোনো ধরনের সংশোধন বা পরিবর্তন ছাড়াই সিনেট রেজ্যুলেশন ৩১৮ গৃহীত হয়েছে। এর মাধ্যমে মার্কিন সিনেট মূলত বাংলাদেশের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনকে অগ্রহণযোগ্য ঘোষণা করলো বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। এরই অংশ হিসেবে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের লক্ষ্যে নতুন করে সংলাপ শুরুর আহ্বান জানিয়ে গত ৮ জানুয়ারি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়ার কাছে চিঠি পাঠিয়েছেন মার্কিন কংগ্রেসের সিনেট কমিটি অন ফরেন রিলেশন্স-এর চেয়ারম্যান সিনেটর রবার্ট মেনেন্দেজ। যুক্তরাষ্ট্রের কাছে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক গুরুত্বের কথা তুলে ধরে বর্তমান রাজনৈতিক অচলাবস্থা দেশকে অস্থিতিশীল করে তুলতে পারে- এমন আশঙ্কা প্রকাশ করে ওই চিঠিতে বলা হয়, এর ফলে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া ও অর্থনৈতিক ভবিষ্যতের ওপর দীর্ঘমেয়াদি নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। এদিকে বাংলাদেশের ৫ জানুয়ারির নির্বাচন বৈধ কিনা এবং এ নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত সরকার বৈধ সরকার কি-না এ বিষয়ে বার্তা সংস্থা এক প্রশ্নের জবাবে গত ৮ জানুয়ারি যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয়ে স্টেট ইউনিভার্সিটির সরকার ও রাজনীতি বিভাগের প্রধান প্রফেসর আলী রীয়াজ বলেন, সাংবিধানিক বা আইনগতভাবে এ নির্বাচন বৈধ হলেও, বিরোধী দলের অংশগ্রহণ না থাকায় এবং ভোটার উপস্থিতি অত্যন্ত কম হওয়ায় এ নির্বাচন নৈতিক বৈধতা পাবে না। উল্লেখ্য, প্রফেসর আলী রীয়াজ গত ডিসেম্বর ২০১৩ পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের বিখ্যাত থিংকট্যাংক প্রতিষ্ঠান উইলসন সেন্টার ফর ইন্টারন্যাশনাল স্কলার্সের পাবলিক পলিসি স্কলার হিসেবে কাজ করেন এবং এ সময়ে তিনি বাংলাদেশ নিয়ে মার্কিন সিনেটের শুনানিতেও অন্যতম বিশেষজ্ঞ হিসেবে সাক্ষ্য দেন। অধ্যাপক আলী রীয়াজের কাছে প্রশ্ন ছিলো, ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের আন্তর্জাতিক গ্রহণযোগ্যতা কতটুকু? নতুন সরকারের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কাজ যুদ্ধাপরাধের বিচার, কিন্তু এভাবে নির্বাচিত সরকার যুদ্ধাপরাধের বিচার ও বিচারের রায় কার্যকর করতে নতুন করে সমালোচনার মুখে পড়বে কি-না? জবাবে প্রফেসর আলী রীয়াজ বলেন, আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নতুন সরকারের গ্রহণযোগ্যতা প্রশ্নসাপেক্ষ হবে। যুদ্ধাপরাধের বিচার প্রক্রিয়া নিয়ে অনেক দেশ আগেই তাদের কিছু কিছু আপত্তি জানিয়েছে। কিন্তু এ বিচারের ভিত্তি নিয়ে পশ্চিমা দেশগুলো প্রশ্ন তোলেনি। এখন এ বিষয়ে আলাদা করে তারা আরও আপত্তি করবেন কি-না সেটার চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ হলো নির্বাচনকে কেন্দ্র করে আন্তর্জাতিক সমাজের অনুরোধ ও চেষ্টাকে উপেক্ষা করার যে নীতি অনুসরণ করা হয়েছে তার প্রভাব দেশের অর্থনীতির ওপর কতটুকু পড়বে। মনে রাখা দরকার, যারা এই একতরফা নির্বাচন না করার জন্য অনুরোধ করেছিলো তারাই বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বাণিজ্যিক অংশীদার।
এ ছাড়া বাংলাদেশের নতুন সরকারের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক কেমন হবে- এমন প্রশ্নের জবাবে প্রফেসর আলী রীয়াজ বলেন, আমি আশঙ্কা করি, ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের মাধ্যমে যে সরকার গঠিত হবে তার সাথে যুক্তরাষ্ট্র এবং অন্য অনেক দেশেরই সম্পর্কে একটা টানাপড়েন থাকবে। সঙ্কটের সমাধান যুক্তরাষ্ট্র বা অন্য কোনো দেশের হাতে নেই, আছে বাংলাদেশের রাজনীতিবিদদের হাতে। সরকারকেই পদক্ষেপ নিতে হবে। বিরোধী দলকেও আপসের মনোভাব দেখাতে হবে। যুক্তরাষ্ট্র সেটাকেই উৎসাহ যোগাবে। কিন্তু দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ না নেয়া হলে যুক্তরাষ্ট্র যে ভিন্ন ধরনের পদক্ষেপ বিবেচনা করবে তা অনুমান করতে কষ্ট হয় না। এদিকে বাংলাদেশের একতরফা নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসা নতুন সরকার অধিকতর কর্তৃত্ববাদী ও একনায়কতান্ত্রিক হবে বলে মতপ্রকাশ করেছেন বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক রাষ্ট্রদূত ও বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের উইলসন সেন্টার ফর ইন্টারন্যাশনাল স্কলার্সের সিনিয়র পাবলিক পলিসি স্কলার উইলিয়াম বি মাইলাম। এ অবস্থায় বাংলাদেশের নির্বাচনকেন্দ্রিক যুক্তরাষ্ট্রের কূটনীতিকে আপনি কীভাবে মূল্যায়ন করছেন, বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্রের একজন প্রাক্তন রাষ্ট্রদূত হিসেবে আপনার কী মনে হয় যে, বাংলাদেশে একটি ইনক্লুসিভ নির্বাচন অনুষ্ঠানে সহায়তা করতে যুক্তরাষ্ট্রের আরও দৃশ্যমান ভূমিকা রাখার প্রয়োজন বা সুযোগ ছিলো- এমন প্রশ্নের জবাবে এক লিখিত বার্তায় রাষ্ট্রদূত উইলিয়াম বি মাইলাম বলেন, আমি মনে করি না যে কূটনৈতিক সীমারেখার মধ্য থেকে এর চেয়ে বেশি দৃশ্যমান ভূমিকা রাখার সুযোগ আছে। আগামী দিনগুলোতে বিশেষ করে ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে ক্ষমতায় আসা নতুন সরকারের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক কেমন হবে বলে আপনি মনে করেন- এমন প্রশ্নের জবাবে রাষ্ট্রদূত উইলিয়াম বি মাইলাম তার লিখিত বার্তায় বলেন, আমার মনে হয় যুক্তরাষ্ট্র এখন বাংলাদেশের নতুন সরকারের কর্মকাণ্ড পর্যবেক্ষণ করবে। একতরফা নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসা নতুন সরকার দেশে একদলীয় শাসন কায়েম করে কি-না এবং বিরোধী দলের সাথে সমঝোতার যে আন্তর্জাতিক আহ্বান তাতে সাড়া দেয় কি-না, যুক্তরাষ্ট্র তা গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করবে। যদি নতুন সরকার তা না করে এবং একনায়কতান্ত্রিকভাবে দেশ শাসন করে তাহলে যুক্তরাষ্ট্রের ঐতিহ্য অনুযায়ী এ ধরনের সরকারের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের সার্বিক সহযোগিতা সঙ্কুচিত করা হবে এবং একদম অনন্যোপায় হয়েই যুক্তরাষ্ট্রকে তা করতে হবে।