দৈনিক মাথাভাঙ্গার সাংবাদিক সদরুল নিপুলের খণ্ডবিখণ্ড লাশ উদ্ধার

চুয়াডাঙ্গার মোমিনপুর এলাকায় থমথমে অবস্থা : প্লাটফর্মের ওপরে ছোপ ছোপ রক্ত : হত্যা রহস্য নিয়ে নানা গুঞ্জন

 

 

স্টাফ রিপোর্টার: দৈনিক মাথাভাঙ্গার একনিষ্ঠ সাংবাদিক সদরুল নিপুলের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। চুয়াডাঙ্গার মোমিনপুরে তার বাড়ির অদূরবর্তী রেলস্টেশন সংলগ্ন লাইনের ওপর থেকে তার খণ্ডবিখণ্ড লাশ গতকাল বুধবার সকালে উদ্ধার করে জিআরপি পুলিশ। নিহত সাংবাদিক নিপুলের পরিবারের অভিযোগ তাকে কৌশলে হত্যা করে রেললাইনে ফেলে দেয়া হয়েছে। কারো বিরুদ্ধে কোনো সংবাদ লেখা বা কোনো গোপন তথ্য জেনে ফেলার কারণে অজ্ঞাত দুর্বৃত্তরা এ খুনের ঘটনা ঘটিয়ে থাকতে পারে বলে তাদের ধারণা। তারা এ ঘটনার সুষ্ঠু তদন্তপূর্বক দোষীদের উপযুক্ত শাস্তি দাবি করেছেন।

DSC01121

চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলার মোমিনপুর ইউনিয়নের মোমিনপুর গ্রামের প্রয়াত নুর মোহাম্মদ ওরফে নুরু সিআইয়ের ছেলে সদরুল আলম নিপুল(৪০) প্রায় ১ যুগ আগে থেকে দৈনিক মাথাভাঙ্গার মোমিনপুর ইউনিয়ন প্রতিনিধি হিসেবে সাংবাদিকতা শুরু করেন। সেই থেকে আন্তরিকতার সাথে একনিষ্ঠভাবে দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন তিনি। গত মঙ্গলবার বিকেলে তার স্ত্রী নীলুফা ইয়াসমিন নীলিমা পারভীন যান বাবার বাড়ি আলমডাঙ্গার গড়চাপড়া গ্রামে। সাথে ছিলো একমাত্র মেয়ে সানিয়া এমামুন নিধি (৫)। সন্ধ্যার পর সাংবাদিক নিপুল নিজবাড়ি থেকে বের হন। রাত ৯টার পর স্ত্রী নীলিমার সাথে তার শেষ কথা হয়। এরপর নিপুলকে আর দেখা যায়নি। সকালে মোমিনপুর রেলস্টেশনের লাইনের ওপর সাংবাদিক নিপুলের খণ্ডবিখণ্ড লাশ পড়ে থাকতে দেখে পুলিশে খবর দেয়া হয়। চুয়াডাঙ্গা জিআরপি ফাঁড়ি পুলিশের ইনচার্জ এএসআই খোরশেদ আলম সঙ্গীয় ফোর্স নিয়ে ঘটনাস্থলে পৌঁছে সকাল ১০টার দিকে লাশ উদ্ধার করেন।

প্রতক্ষদর্শীরা জানান, মোমিনপুর রেলস্টেশনের প্লাটফর্মের ওপর একটি সেগুর গাছের গোড়া বাঁধাই করা আছে। তার পাশেই ছোপ ছোপ রক্ত দেখা যায়। প্লাটফর্মের ওপরেও কিছু কিছু স্থানে রক্তের দাগ দেখা যায়। প্লাটফর্মের নিচেও ফিনকি দিয়ে ছোটা রক্তের চিহ্ন রয়েছে। পুলিশ আপলাইনের মাঝ থেকে লাশের টুকরোগুলো উদ্ধারের পাশাপাশি প্লাটফর্মের ওপরে পড়ে থাকা নিপুলের ব্যবহৃত একটি গামছা ও স্যান্ডেল উদ্ধার করে। জিআরপি পুলিশের পাশাপাশি চুয়াডাঙ্গা সদর থানা পুলিশও ঘটনাস্থলে পৌঁছায়। পরে চুয়াডাঙ্গা পুলিশ সুপার রশীদুল হাসান ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন। নিহত সাংবাদিক সদরুল নিপুলের পরিবারের সদস্যদের দাবি নিপুলকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করে রেললাইনের ওপরে ফেলে রাখা হয়েছিলো। তবেরেলওয়ে পুলিশের এএসআই খোরশেদ আলম বিষয়টিকে রহস্যজনক বলে মনে করেন। নিহতের সুরতহাল প্রস্তুতকারী খোরশেদ আলম জানান,নিহতের মাথা ও ঘাড়ে তিনটি বড় ধরনের আঘাতের চিহ্ন রয়েছে।শরীর থেকে ডান পা বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। স্টেশনের প্লাটফর্ম থেকে সাংবাদিকের ব্যবহৃত ব্যাটারি খোয়া যাওয়া মোবাইলফোনটি উদ্ধার করা হয়েছে। তিন খণ্ডের লাশ ছাড়াও আশপাশ থেকে নিহতের লাশের আরো সাতটি অংশ উদ্ধার করা হয়।অন্যদিকে প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, নিপুলের মাথায় ও চোয়ালে ধারালো অস্ত্রের কোপের দাগ রয়েছে। তাতেই হত্যার সন্দেহ আরো ঘনীভূত হয়। এ ঘটনায় এলাকায় শোকের ছায়া নেমে আসে। নিহত সাংবাদিক নিপুলের বৃদ্ধ মা ইমামন নেছা ছেলের মৃত্যুর সংবাদে বার বার মূর্ছা যেতে থাকেন।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক সূত্র জানায়, সম্প্রতি মোমিনপুর ইউনিয়নের বোয়ালমারী গ্রামের একজন মহিলাকে শিক্ষিকা হিসেবে চাকরি জুটিয়ে দেন এক ব্যক্তি। এই সুবাদে ওই ব্যক্তির সাথে শিক্ষিকার প্রেম সম্পর্ক গড়ে ওঠে।অবাধ মেলামেশার এক পর্যায়ে কয়েকদিন আগে চাকরি দেয়া ব্যক্তি বোয়ালমারী গ্রামে শিক্ষিকার বাড়িতে এলে তাকে মারধর করা হয়। এ বিষয়ে নিউজ করা না করা নিয়ে মেয়ে পক্ষের সাথে কথা-কাটাকাটি হয়। কপালে চরম বিপদ আছে বলে মেয়ে পক্ষ নিপুলকে শাসিয়ে দেন।এ ছাড়া স্পর্শকাতর এলাকা হিসেবে খ্যাত ঘোলদাড়ি ও খাসকররা এলাকার কিছু সংবাদ পরিবেশন করার নেপথ্যেও হত্যা ঘটনা ঘটে থাকতে পারে বলে তার পরিবারসহ অনেকে মন্তব্য করেন।

এছাড়া সাংবাদিক নিপুলের ভাই ও পরিবারের লোকজন জানান,নিপুল মোবাইলে সব সময় জোরে কথা বলে; কিন্তু ঘটনার দিন রাত ৯টায় দিকে কে বা কার সাথে মোবাইলে কথা বলছিলো আস্তে ফিস ফিস করে। যা অনেকেই প্রত্যক্ষ করেছেন। তাহলে মোবাইলফোনে কথা বলেই কি ঘাতকরা নিপুলকে ডেকে নিয়েছিলো? এর জবাব মিলতে পারে সাংবাদিক নিপুলের মোবাইলফোনের কললিস্ট পরীক্ষা করলে।

এলাকার কেউ কেউ বলেছেন, মোমিনপুর রেলস্টেশনের প্লাটফর্মের ওপরেই রয়েছে একটি আমগাছ। দু দিন আগে কে বা কারা ও গাছ থেকে অনুমান ২০/২২ মণ আম পাড়ে ওই গাছ থেকে। বিষয়টি জেনে যান সাংবাদিক নিপুল। সংবাদটি যাতে পত্রিকায় না আসে তা নিয়ে সাংবাদিকের সাথে তাদের বাগবিতণ্ডা হয়। সংবাদটি যাতে না ছাপা হয় সে কারণে তাকে হত্যা করা হয়ে থাকতে পারে কি-না তা খতিয়ে দেখা দরকার বলে মনে করছেন অনেকেই। যেখান থেকে সাংবাদিক নিপুলের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে, তার পাশেই প্লাটপর্মের ওপরেই নেশাখোরদের আড্ডা বসে বলেও কেউ কেউ জানিয়েছেন। নেশাখোরেরা নিপুলকে হত্যা করে থাকতে পারে বলেও গুঞ্জন শোনা যাচ্ছে। প্লাটফর্মের পাশ থেকে একটা আধলা ইট দেখা যায়। ওই ইটে রক্তের দাগ ও মাথার চুল দেখা যায়। ইট দিয়ে তার মাথায় আঘাত করা হয়েছে কি না তাও খতিয়ে দেখা দরকার বলে এলাকাবাসী মনে করেন। গতকাল সকালে মোমিনপুর স্টেশনের আমগাছ থেকে আম পাড়া নিয়ে গুঞ্জন শুরু হলে গাছের গোড়ায় থাকা তারকাঁটা দিয়ে ঘেরা তারকাঁটা ও কাঁটাযুক্ত গাছের ডাল কে বা কারা সরিয়ে ফেলে।

অন্য একটি সূত্র জানায়, ঘটনার দিন সন্ধ্যার পর পার্শ্ববর্তী আমিরপুর গ্রামের মোমিন নামের এক ব্যক্তির সাথে মোটরসাইকেলযোগে চুয়াডাঙ্গা জেলা শহরে যান সাংবাদিক নিপুল। বাড়ি ফিরে রাত ৯টার দিকে শার্টপ্যান্ট পাল্টে লুঙ্গি পরে বাইরে বের হন। পরে রেলস্টেশনের একটি চা দোকানে চা পান করেন। এরপর থেকে তার কেউ খোঁজ পায়নি। সকালে উদ্ধার হলো লাশ। এ ঘটনায় মোমিনপুর রেলস্টেশন মাস্টার নজরুল ইসলাম বাদী হয়ে কুষ্টিয়ার পোড়াদহ জিআরপি থানায় একটি অপমৃত্যু মামলা দায়ের করেছেন। লাশ উদ্ধার করে চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালমর্গে নেয়া হয়। সেখানে দুপুরে লাশের ময়নাতদন্ত সম্পন্ন হয়। বিকেলে মোমিনপুর কবরস্থানে তার দাফন সম্পন্ন হয়। এ ঘটনায় এলাকায় থমথমে অবস্থা বিরাজ করছে।

লাশের ময়নাতদন্তে নিয়োজিত ৪ সদস্যের মেডিকেল টিমের অন্যতম সদস্য চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালের আরএমও ডা. মাসুদ রানা জানান,লাশের ময়নাতদন্তে পাওয়া প্রতিবেদন প্রস্তুত করা হয়েছে। ভিসেরা রিপোর্ট পাওয়ার পর বিস্তারিত জানা যাবে।

জেলা পুলিশ সুপার রশীদুল হাসান জানান,তিনি দুপুরে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন। রেলওয়ের জায়গায় ঘটনাটি হওয়ায় রেলওয়ে পুলিশ তদন্ত করবে। পাশাপাশি চুয়াডাঙ্গা সদর থানা পুলিশও নিজস্ব উদ্যোগে তদন্ত শুরু করেছে।

এ ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ ও নিন্দা জ্ঞাপন করেছেন স্থানীয় সাংবাদিক নেতৃবৃন্দ। চুয়াডাঙ্গা প্রেসক্লাবের সভাপতি মাহাতাব উদ্দিন ও সাধারণ সম্পাদক সরদার আল আমিন এবং বাংলাদেশ সাংবাদিক সমিতি চুয়াডাঙ্গা শাখার সভাপতি এসএম শরীফ উদ্দিন হাসু ও সাধারণ সম্পাদক শাহার আলী ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত দাবি করেছেন। একই সাথে দোষী ব্যক্তিদের অবিলম্বে গ্রেফতারের দাবি জানান তারা। নিহতের ছোট ভাই মো. লিপন জানান, আমার ভাই খুবই সরল প্রকৃতির। তার কোনো শত্রু ছিলো না। তাকে যারা যে কারণেই হত্যা করে থাকুক না কেন, তার রহস্য উন্মোচন হবেই। এ ব্যাপারে আগামীকাল (আজ) থানায় হত্যামামলা করা হবে।