দু নেত্রীর সমঝোতার আশা ফুরাচ্ছে

স্টাফ রিপোর্টার: রাজনীতির আকাশের ঈশান কোণে আবারো কালো মেঘ জমতে শুরু করেছে। যে কোনো মুহূর্তে তা ভয়ঙ্কর রূপ নিতে পারে বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা আশঙ্কা করছেন। তাদের ভাষ্য, নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস্থা নিয়ে প্রধান দুই দল আলোচনার কথা বললেও কার্যত সমঝোতার কোনো পরিবেশ তৈরি হয়নি বরং এ ইস্যুতে দু পক্ষই পরস্পরকে ঘায়েলের ফন্দি খোঁজায় সঙ্কট নিরসনের পথ ক্রমেই রুদ্ধ হয়ে পড়ছে। অথচ এ দায় নিতে চায় না আওয়ামী লীগ বা বিএনপি কেউই। তাই দু দলই নিজ নিজ অবস্থানে অনড় থেকে প্রস্তাব-পাল্টা প্রস্তাব দিচ্ছে। গত শনিবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা টেলিফোনে বিরোধীদলীয় নেতা বেগম খালেদা জিয়াকে আলোচনায় বসার প্রস্তাব দেয়ার পর দ্বিতীয় দফা এ উদ্যোগে কোন দল কতটা কার্যকর ভূমিকা নেবে তা নিয়েও সঙ্কট ঘনিভূত হচ্ছে।

সরকার ও দলের নীতিনির্ধারকরা মনে করেন, প্রধানমন্ত্রী আলোচনার আমন্ত্রণ জানিয়ে বিরোধীদলীয় নেতাকে ফোন দিয়ে বল তার কোর্টে ঠেলে দিয়েছেন। এ ক্ষেত্রে বিরোধী দল কতোটা সাড়া দেবে তার ওপর নির্ভর করছে পরবর্তী পদক্ষেপ। তার আগে সরকারের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে নতুন করে যোগাযোগ করা হবে না। আওয়ামী লীগের একাধিক জ্যেষ্ঠ নেতার সঙ্গে আলাপ করে দলের এ অবস্থান জানা গেছে। জ্যেষ্ঠ নেতাদের ভাষ্য, বিরোধী দল নির্বাচনে এলে এক ধরনের চিন্তা আর না এলে আরেক ধরনের চিন্তা।

এদিকে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল প্রধানমন্ত্রীর ফোনের পর থেকেই সংলাপ নিয়ে সরকারের আন্তরিকতা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করে আসছেন। বিশেষ করে মঙ্গলবার প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধীদলীয় নেতার টেলিফোনের কথোপকথন প্রকাশের পর তিনি তার সন্দেহ জোরালো ভাষায় প্রকাশ করেছেন। অন্যদিকে বিএনপির কয়েকজন নেতা বলেছেন, তারা মনে করছেন, সংলাপে সমস্যার সমাধান হবে না। কারণ সরকার সংলাপে আন্তরিক হওয়ার চেয়ে সংলাপে আগ্রহ দেখিয়ে দেশের মানুষ ও বহির্বিশ্বের আস্থা অর্জনের ষড়যন্ত্রেই বেশি তৎপর। তাই রাজনৈতিক সঙ্কটের মূল ইস্যু নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস্থা নিয়ে আলোচনা না করে বিএনপিকে কথার ফাঁদে আটকে ১৮ দলীয় জোটের চলমান সোচ্চার আন্দোলনে ভাটা ফেলতে চাইছে। তবে এরপরও সংলাপ ব্যর্থ হওয়ার দায় নিতে চায় না বিএনপি। এ জন্য সুনির্দিষ্ট ইস্যুতে তারা আলোচনায় বসতে রাজি আছেন বলে জানান বিএনপির শীর্ষ নেতারা। তবে এলোমেলো আলোচনা বিএনপি যোগ দেবে না বলে সাফ জানান দিয়েছেন মির্জা ফখরুল।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, বিএনপির নেতৃত্বাধীন ১৮ দলীয় জোট খুব কম সময়ের মধ্যে চলমান রাজনৈতিক সঙ্কটের সমাধান চাইছে। তাই টানা ৬০ ঘণ্টার হরতাল শেষ হওয়ার পরপরই আগামী ৪, ৫ ও ৬ নভেম্বর সারাদেশে অবরোধ কর্মসূচি এবং ২ নভেম্বর বিক্ষোভ সমাবেশ কর্মসূচি ঘোষণা করে ক্ষমতাসীন সরকারকে চাপে রাখতে চাইছে। কিন্তু রাজনৈতিক কূটচালে পারদর্শী আওয়ামী লীগ এ ব্যাপারে ‘ধীরে চলো নীতি গ্রহণ করে বিশেষ ফায়দা লোটার ছক এঁটেছে। একই সঙ্গে এ ফাঁকে তারা নির্বাচনী প্রচারণায় নিজেদের কিছুটা এগিয়ে রাখার চেষ্টা করছে।

দু পক্ষের এ ভিন্নমুখী যাত্রায় রাজনৈতিক অঙ্গনে লু হাওয়া বইতে শুরু করেছে। নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস্থা নিয়ে সংলাপের মধ্যদিয়ে দ্রুত সমঝোতা না হলে দেশজুড়ে আবারো রাজনৈতিক সংঘাত শুরু হবে। ৬০ ঘণ্টার হরতালে সারাদেশে যেভাবে রাজনৈতিক সহিংসতা ছড়িয়েছে, অবরোধ কর্মসূচিতে তা আরো কয়েকগুণ বাড়বে আশঙ্কা করে পর্যবেক্ষকরা বলছেন, এ সময় দু পক্ষ সমঝোতায় এগিয়ে এলেও উত্তপ্ত পরিস্থিতি সামাল দেয়া রাজনীতিকদের পক্ষে কঠিন হয়ে দাঁড়াবে। এতে তৃতীয় শক্তির আগমনের পথ প্রশস্ত হবে। দেশ আবার অমানিশার অন্ধকারে ডুবে যাবে।

রাজনৈতিক সূত্রগুলো জানায়, আওয়ামী লীগ প্রকাশ্যে নির্বাচনী প্রচারাভিযানে নামলেও তলে তলে ১৮ দলীয় জোটের আন্দোলন মোকাবেলার বিষয়টিকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিচ্ছে। শীর্ষ থেকে তৃণমূল পর্যন্ত দলের প্রতিটি স্তরেই এ ব্যাপক প্রস্তুতি নেয়ার দিকনির্দেশনা দেয়া হয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় আওয়ামী লীগ আগামী ৩ নভেম্বর জেলহত্যা দিবস উপলক্ষে রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে জনসভা করার কর্মসূচি নিয়েছে। জনসভায় দলীয় শক্তি প্রদর্শন করার লক্ষ্যে ঢাকা ও এর আশপাশের জেলা থেকে বিপুল নেতাকর্মী জমায়েত করার পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে।
রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা বলছেন, ১৮ দলীয় জোটের অবরোধ কর্মসূচি শুরুর মাত্র একদিন আগে আওয়ামী লীগের এ ধরনের কর্মসূচি ভিন্ন ইঙ্গিত বহন করছে। তাদের ধারণা, রাজধানীর বাইরে থেকে ৩ নভেম্বর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের সমাবেশে যোগ দেয়া নেতাকর্মীদের একটি বড় অংশ ঢাকাতেই থেকে যাবে এবং পরদিন তারা ১৮ দলীয় জোটের অবরোধ কর্মসূচি রুখে দিতে মাঠে তৎপর থাকবে।

যদিও আওয়ামী লীগের শীর্ষস্থানীয় একাধিক নেতার দাবি, ৩ নভেম্বরের সমাবেশ কর্মসূচি তারা আগেই ঘোষণা করেছে। এর সঙ্গে ১৮ দলীয় জোটের কর্মসূচির কোনো যোগসূত্র নেই। তবে বিএনপির আন্দোলন মোকাবেলায় সব ধরনের প্রস্তুতি নেয়া হচ্ছে বলে স্বীকার করেন ওই নেতারা। এদিকে বিএনপির একাধিক দায়িত্বশীল সূত্রে জানা গেছে, লোক দেখানো সংলাপের নামে আওয়ামী লীগের জনগণের আস্থা অর্জনের পাশাপাশি সময়ক্ষেপণের চেষ্টার কৌশল তারা আগেভাগেই জেনে গেছে। এ কারণেই তাদের সে সুযোগ না দিতে ১৮ দলীয় জোট আলোচনা ও আন্দোলন একই সঙ্গে চালিয়ে যাওয়ার প্রস্তুতি নিয়েছে। যাতে সাপ মরে, লাঠিও না ভাঙে।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির এক সদস্য বলেন, ক্ষমতাসীন সরকারকে সমঝোতার জন্য আরো ৫ দিন সময় দেয়া হয়েছে। এ সময়ের মধ্যে আশানুরূপ গতিতে সংলাপ চললে ৪ থেকে ৬ নভেম্বরের অবরোধ কর্মসূচি তুলে নেয়া হবে। আর তা না হলে ৭ নভেম্বরের পর আরো টানা কঠোর কর্মসূচি দিয়ে গোটা দেশ অচল করে দেয়া হবে। আওয়ামী লীগ সর্বদলীয় নির্বাচনের কথা বলে ১৪ দলকে নিয়ে যে নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছে তা রুখে দেয়ার মতো যথেষ্ট প্রস্তুতি ১৮ দলের রয়েছে বলে ওই নেতা দাবি করেন।

দলীয় সূত্রে জানা গেছে, ৬ নভেম্বরের অবরোধ কর্মসূচি শেষ হওয়ার পর আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দু রাজধানীতে নেতাকর্মীদের জমায়েত করতে সচেষ্ট হবে বিএনপি। এর পর শুরু হবে সরকার পতনের একদফা দাবিতে আন্দোলন।  বিএনপির শীর্ষ নেতাদের দাবি, আওয়ামী লীগ নির্বাচনের যত প্রস্তুতিই নিক না কেন, সরকার পতন আন্দোলনে তা খেই হারিয়ে ফেলবে। এ কারণে তারা নির্বাচনী প্রস্তুতির চেয়ে আন্দোলন জোরদার করার ব্যাপারেই বেশি সোচ্চার রয়েছে। দু দলের এ মুখোমুখি অবস্থানে সংলাপ-সমঝোতার পথ দ্রুত রুদ্ধ হয়ে সংঘাতময় পরিস্থিতির দিকে দেশ অগ্রসর হচ্ছে বলে কূটনীতিকরাও আশঙ্কা করছেন। জাতিসংঘ, যুক্তরাষ্ট্র, চীনসহ বন্ধুদেশগুলো সঙ্কট নিরসনে দু’দলকেই আহ্বান জানাচ্ছে। এমনকি উন্নয়ন সহযোগী জাপানও এ পরিস্থিতিতে উদ্বেগ জানিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে জনগণের জানমালের নিরাপত্তার তাগিদ দেয়া হয়েছে। তবে এতেও রাজনৈতিক অঙ্গনে কোনো প্রভাব পড়েছে বলে মনে করছেন না পর্যবেক্ষকরা। তাদের ধারণা, আন্তর্জাতিক মহলকে সন্তুষ্ট রেখেই দেশের প্রধান দু দল নিজ নিজ অবস্থানে অনড় থাকতে চাইছে। এ কারণে দেশের অস্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিস্থিতি স্বাভাবিক পর্যায়ে ফিরিয়ে আনার চেয়ে উভয়পক্ষই বিদেশি কূটনীতিকদের সামনে তাদের সংলাপে বসার আগ্রহ প্রকাশেই বেশি ব্যস্ত রয়েছে।
অভিজ্ঞ রাজনীতিকদের ভাষ্য, পর্দার অন্তরালে আলোচনা না হলে সঙ্কটের সমাধান হবে না। এজন্য দুই দলকেই যথেষ্ট আন্তরিকতা নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে। আর তা না হলে সংলাপের নামে কালক্ষেপণের মধ্য দিয়ে দেশ সংঘাতের দিকে এগিয়ে যাবে। এ দায় কেউ নিতে না চাইলেই তা দুপক্ষের ঘাড়েই বর্তাবে। দেশের প্রধান দুই দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপিকে এর দীর্ঘমেয়াদি খেসারত দিতে হবে।

এদিকে রাজনৈতিক সঙ্কটের সুষ্ঠু সমাধানের দিকে না এগিয়ে দেশের প্রধান দুই রাজনৈতিক শক্তি ভিন্নমুখি অবস্থান নিয়ে দেশে সংঘাতময় পরিস্থিতির দিকে ঠেলে নিয়ে যাওয়ায় ৱ্যাব-পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সব বাহিনীরই মাঠপর্যায়ে ক্রমেই অসন্তোষ ছড়িয়ে পড়ছে। এ পরিস্থিতি চলমান থাকলে উত্তপ্ত রাজপথে তারা নিস্ক্রিয় থাকতে পারে বলেও অনেকেই আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন।

পুলিশের মাঠপর্যায়ের একাধিক কর্মকর্তা নাম না বলার শর্তে ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, আন্দোলনের তা-ব ঠেকাতে গিয়ে প্রতিনিয়ত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা হামলার শিকার হচ্ছে। অথচ দু’পক্ষই নিজ নিজ অবস্থানে অনড় থেকে সঙ্কট নিরসনে টালবাহানা করছে। রাজনৈতিক পরিস্থিতি ধীরে ধীরে যেভাবে উত্তপ্ত হয়ে উঠছে তাতে সে পরিস্থিতি সামাল দিতে গেলে আইন রক্ষাকারী বাহিনীর বিপুলসংখ্যক সদস্যের জানমালের ক্ষতি হবে। তাই চাকরি রক্ষার স্বার্থে পুলিশের মাঠপর্যায়ের সদস্যরা রাজপথে ডিউটিতে থাকলেও বেসামাল পরিস্থিতিতে তাদের সরে পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে।