দু দলেরই শর্তের আবর্তে ঘুরপাক খাচ্ছে সংলাপ প্রসঙ্গ

রাজনৈতিক অস্থিরতা : হরতাল-অবরোধে সঙ্কটে পড়েছে অর্থনীতি

 

স্টাফ রিপোর্টার: রাজনৈতিক অস্থিরতা, হরতাল-অবরোধে সঙ্কটে পড়েছে অর্থনীতি। বিপাকে পড়েছেন চুয়াডাঙ্গা-মেহেরপুর ও ঝিনাইদহসহ সারাদেশের সবজিচাষিরা। অনেকটা স্থবিরতা নেমে এসেছে উৎপাদন খাতে। আমদানি ও রফতানি বাণিজ্যে ধস নেমেছে। স্থবির হয়ে পড়েছে পরিবহন খাত। বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া বলেছেন, ‘গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চলবে।’ এজন্য দেশবাসীকে আন্দোলনে শামিল হওয়ার আহবান জানিয়েছেন বেগম খালেদা জিয়া। শুক্রবার গুলশান কার্যালয়ে বেগম খালেদা জিয়ার সাথে সাক্ষাত শেষে বেরিয়ে এসে সাংবাদিকদের এসব কথা জানান বাংলাদেশ জাতীয় ফুটবল দলের সাবেক অধিনায়ক আমিনুল হক। অপরদিকে বিএনপি কয়েকটি রাজনৈতিক শর্ত মানলে তাদের সাথে সংলাপে যেতে পারে আওয়ামী লীগ। শর্তগুলো হলো বিএনপিকে আগে সহিংস রাজনীতি থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। অবরোধ প্রত্যাহারের পাশাপাশি যুদ্ধাপরাধী, জঙ্গিগোষ্ঠী ও আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করতে হবে। এছাড়া আন্দোলনের নামে জ্বালাও-পোড়াও, নাশকতামূলক রাজনীতি না করার অঙ্গীকার করতে হবে। তাহলে সংবিধানের মধ্যে থেকে আলোচনায় বসবে আওয়ামী লীগ।

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, অর্থনীতির সব খাতে প্রতিদিন অন্তত ১৫০০-২০০০ কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি হচ্ছে। এ হিসাবে গত ১২ দিনের রাজনৈতিক সংঘাতে আর্থিক খাতেই ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ১৬ থেকে ২০ হাজার কোটি টাকা। সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে পোশাক খাতের। একই সাথে গ্রাম-গঞ্জের কৃষকদের হচ্ছে রক্তক্ষরণ। ব্যবসায়ীরা জানান, এভাবে চলতে থাকলে তাদের পথে বসতে হবে। শ্রমিকদের বেতন দেয়া সম্ভব হবে না। আর এতে শ্রমিক অসন্তোষ সৃষ্টি হতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন মালিকরা। এছাড়া মাসের পর মাস স্বাভাবিকের তুলনায় কম উৎপাদন হলে দীর্ঘ মেয়াদি সঙ্কটে পড়তে পারে দেশ। অন্যদিকে সময়মতো পণ্য সরবরাহ করতে না পারায় ক্রেতা হাতছাড়া হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

রাজনৈতিক সঙ্কট নিরসনে আবারও আলোচনায় সংলাপ। পাশাপাশি বিদেশি কূটনীতিকরাও সংলাপের ওপর জোর দিয়েছেন। এ অবস্থায় বিএনপির পক্ষ থেকে সর্বশেষ শুক্রবার সরকারকে আবারও কার্যকর সংলাপের উদ্যোগ নেয়ার আহ্বান জানানো হয়। তবে সুনির্দিষ্ট আলোচ্যসূচি (এজেন্ডা) ছাড়া সংলাপে বসবে না বিএনপি। সরকারের পক্ষ থেকে দ্রুত নির্বাচন অনুষ্ঠানে সব দলের সাথে আলোচনায় বসার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দিলেই শুধু তারা তাতে সম্মতি জানাবে। সরকার আলোচনায় বসার কোনো উদ্যোগ না নিলে রাজপথেই দাবি আদায় করার কৌশল নিয়ে এগোচ্ছে বলে জানান বিএনপির নীতিনির্ধারকরা। দলীয় সূত্র জানায়, চূড়ান্ত আন্দোলনে যাওয়ার আগে সংলাপের জন্য সরকারকে শেষবারের মতো সময় দিতে চায় বিএনপি। সংলাপ নিয়ে বিএনপির আন্তরিকতার অভাব আছে এমন সন্দেহ যেন কারও মধ্যেই না আসে, সেজন্য শেষবারের মতো শুক্রবার সরকারকে আলোচনায় বসার আহ্বান জানানো হয়। তবে তাদের আন্তরিকতার অভাব না থাকলেও সরকারের অবস্থান পুরো উল্টো বলে মনে করছে বিএনপি। আলোচনার মাধ্যমে সঙ্কট নিরসনে সরকারের কোনো চিন্তা-ভাবনা দেখা যাচ্ছে না। উল্টো বিএনপির আন্দোলনকে দমনে সরকার রাষ্ট্রের সব শক্তিকে কাজে লাগানোর উদ্যোগেরই বহির্প্রকাশ ঘটছে ঘুরে ফিরে। ইতোমধ্যে যৌথ অভিযানের নামে দেশের বিভিন্ন জায়গায় চালাচ্ছে গ্রেফতার অভিযান।

সূত্র আরও জানায়, সংলাপের আহ্বানের পাশাপাশি চূড়ান্ত আন্দোলনের প্রস্তুতিও প্রায় সম্পন্ন করেছে বিএনপি। সরকারের কঠোর মনোভাব মোকাবেলায় তৈরি হচ্ছে তারা। গ্রেফতার এড়িয়ে আন্দোলনকে আরও বেগবান ও শক্তিশালী করার ব্যাপারে দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া নেতাদের নানা দিকনির্দেশনা দিচ্ছেন। উজ্জীবিত করতে কথা বলছেন তৃণমূলের সাথে।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য লে. জে. (অব.) মাহবুবুর রহমান বলেন, তারা বারবার সংলাপের জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়ে আসছেন। দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া সংবাদ সম্মেলন করে আনুষ্ঠানিকভাবে সংলাপে বসার আহ্বান জানান। কিন্তু সরকার তাদের আহ্বানে সাড়া দিচ্ছে না। তিনি বলেন, সঙ্কট নিরসনে অবশ্যই সংলাপ প্রয়োজন। সংলাপের বিকল্প হচ্ছে সংঘাত। তারা সংঘাত চান না। সরকার দ্রুত নির্বাচন অনুষ্ঠানের লক্ষ্যে সংলাপে বসার উদ্যোগ নিলে যে কোনো স্থানে যেতে বিএনপি রাজি আছে।

৫ জানুয়ারি নির্বাচনের প্রথম বর্ষপূর্তিকে কেন্দ্র করে দু দলের মুখোমুখি অবস্থানে রাজনীতি আবারও রাজপথে চলে যায়। খালেদা জিয়াকে তার গুলশান কার্যালয়ে অবরুদ্ধ করে রাখা হয়। পরে দেশব্যাপি টানা অবরোধের ঘোষণা দেন তিনি। শুরু হয় সংঘাত, সংঘর্ষ। চলমান অবরোধে ইতোমধ্যে ব্যাপক প্রাণহানি ও জানমালের ক্ষতি হয়েছে। স্থবির হয়ে পড়েছে দেশে সামগ্রিক অর্থনীতি। বাংলাদেশের সহিংস রাজনীতি নিয়ে দেশের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ও উদ্বেগ প্রকাশ করে আসছে। বিভিন্ন পেশাজীবীর পক্ষ থেকে সংকট নিরসনে সংলাপের তাগিদ দেয়া হয়। নড়েচড়ে বসে বাংলাদেশে নিযুক্ত বিভিন্ন দেশের কূটনীতিকরাও। বুধবার পশ্চিমা দেশের কূটনীতিকরা সরকারের সঙ্গে আলোচনা করেন। সঙ্কট নিরসনে সংলাপে বসতে আহ্বান জানান তারা। বৃহস্পতিবার রাতে বিএনপির সাথেও বৈঠক করেন পশ্চিমা দেশের ওইসব কূটনীতিকরা। সঙ্কট নিরসনে সংলাপের বিকল্প নেই বলে তারা বিএনপিকে জানান। কূটনীতিকদের পাশাপাশি দেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, সুশীল সমাজ, ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষেরও দাবি সংকট নিরসনে সংলাপের উদ্যোগ নেয়া হোক।

৩১ ডিসেম্বর গুলশান কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া আলোচনায় বসতে সরকারকে সাত দফা দাবি জানান। দ্রুত সময়ের মধ্যে আলোচনার উদ্যোগ নেয়া না হলে রাজপথে দাবি আদায় করা হবে বলেও ঘোষণা দেন তিনি। কিন্তু খালেদা জিয়ারও ওই আহ্বান তাৎক্ষণিক প্রত্যাখ্যান করে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। সবশেষ শুক্রবার বিএনপির পক্ষ থেকে আবারও সংলাপের আহ্বান জানানো হয়। দলের যুগ্মমহাসচিব রুহুল কবির রিজভী আহমেদ স্বাক্ষরিত এক বিবৃতিতে এই মুহূর্তে কার্যকর সংলাপের ব্যবস্থা নিতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানানো হয়।

এদিকে বিএনপির শীর্ষনেতাদের সাথে বিভিন্ন দেশের কূটনীতিকদের সাম্প্রতিক বৈঠক নিয়ে মোটেও চিন্তিত নয় আওয়ামী লীগ। দলটি মনে করছে, কূটনীতিকরা সামাজিক কারণে বিভিন্ন ব্যক্তির বাসায় যেতেই পারেন। অপরদিকে বিএনপি যদি নাশকতামূলক কর্মকাণ্ড অব্যাহত রাখে তাহলে তাদের অবৈধ ঘোষণার উদ্যোগ নেবে আওয়ামী লীগ। ইতোমধ্যে বিএনপিকে অবৈধ ঘোষণা করার জন্যও আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ প্রধানমন্ত্রীর কাছে দাবি জানিয়েছেন। এর পক্ষের যুক্তি হিসেবে তারা তুলে ধরেছেন যে, সামরিক শাসকদের সব কার্যক্রম আদালত অবৈধ ঘোষণা করায় জিয়াউর রহমানের দল বিএনপিও অবৈধ। তাছাড়া বিএনপি এখন সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদী কর্মকাণ্ড চালাচ্ছে। এসব কারণে বিএনপিকে অবৈধ ঘোষণা করার সময় এসেছে।

আওয়ামী লীগের উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য এবং আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত এমপি বলেন, খালেদা জিয়া যতোই কূটনীতিকদের নিয়ে বসেন কোনো লাভ হবে না। বিশ্বের কোনো দেশই সন্ত্রাস ও নাশকতাকারীদের সাথে নেই।

গতকাল শুক্রবার বিকেলে ধানমন্ডিস্থ আওয়ামী লীগ সভানেত্রীর রাজনৈতিক কার্যালয়ে দলের পক্ষে আয়োজিত এক সাংবাদিক সম্মেলনে দলের যুগ্মসাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফ বলেন, বিএনপি একটি সন্ত্রাস ও জঙ্গি দল হিসেবে চিহ্নিত। এই সহিংস রাজনীতি থেকে বিএনপিকে আগে বেরিয়ে আসতে হবে। অবরোধ প্রত্যাহার করে সন্ত্রাস ও জঙ্গীবাদী কর্মকাণ্ড পরিহার করতে হবে। তারপর সংলাপের ব্যাপারটি ভেবে দেখবে আওয়ামী লীগ। বিএনপি চেয়ারপারসন যদি বাসায় ফিরে যান, সব কর্মসূচি প্রত্যাহার করে নেন এবং কূটনীতিকরা যদি সংলাপের উদ্যোগ নিতে চাপ দেন তাহলে আওয়ামী লীগ কী করবে, একজন সাংবাদিকের এমন প্রশ্নের জবাবে হানিফ বলেন, আগে বিএনপি অবরোধ প্রত্যাহার করুক। জ্বালাও-পোড়াও, নাশকতা বন্ধ করুক। তারপর এটা নিয়ে ভেবে দেখা যাবে।