দুই মন্ত্রীকে ভৎসনা আপিল বিভাগের : শপথ ভঙ্গের শাস্তি জানতে চেয়েছেন আদালত

 

স্টাফ রিপোর্টার: সরকারের দুই মন্ত্রী সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে হাজির হয়ে আবারো নিঃশর্ত ক্ষমা প্রার্থনা করেছেন। একইসাথে ভবিষ্যতে আদালত অবমাননা হয় এমন কোনো উক্তি করা থেকে বিরত থাকার অঙ্গীকার করেছেন। আপিল বিভাগ তাদের তীব্র ভৎসনা করেছেন। খাদ্যমন্ত্রী অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলামের দাখিলকৃত লিখিত জবাবের একটি অংশকে ঔদ্ধত্যপূর্ণ অভিহিত করে তার ব্যাখ্যাকে প্রত্যাখ্যান করেছেন আদালত। মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক দোষ স্বীকার করায় কি শাস্তি হতে পারে আপিল বিভাগ তা আইনজীবীর কাছে জানতে চান? এ প্রসঙ্গে প্রধান বিচারপতি বলেন, সংবিধান রক্ষার শপথ নিয়ে দুই মন্ত্রী শপথ ভঙ্গ করেছেন। তারা শুধু প্রধান বিচারপতিকেই ছোট করেননি, গোটা বিচার বিভাগকে পায়ের নিয়ে গুঁড়িয়ে দিয়েছেন। কুত্সা রটনা, বিচার প্রশাসনে হস্তক্ষেপ ফৌজদারি অবমাননা। ডাকাতি মামলার আসামিকে যে ধরনের সাজা দেয়া হয় এই অপরাধের সাজা একই।

প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহার নেতৃত্বাধীন আপিল বিভাগের সাত বিচারপতির পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চে দুই মন্ত্রীর বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার অভিযোগের এ শুনানি হয়। গতকাল রোববার সকাল ৮টা ৪৪ মিনিটে আইনজীবীদের সাথে নিয়ে দুই মন্ত্রী আপিল বিভাগে হাজির হন। সকাল ৯টা ৯ মিনিটে আদালত অবমাননার দাখিলকৃত জবাবের শুনানি শুরু হয়। শুরুতেই মন্ত্রী মোজাম্মেলের পক্ষে সিনিয়র আইনজীবী ব্যারিস্টার রফিক-উল হক বলেন, আদালত অবমাননাকারী মন্ত্রী হাজির রয়েছেন। বসার অনুমতি চাচ্ছি। এ সময় দুই মন্ত্রী ব্যারিস্টার রফিকের পেছনে দাঁড়িয়ে ছিলেন। আদালত প্রথমে মোজাম্মেলকে বসার অনুমতি দেন। এরপর খাদ্যমন্ত্রীর পক্ষে অ্যাডভোকেট আব্দুল বাসেত মজুমদার বলেন, তিনি (অ্যাডভোকেট কামরুল) আদালতে হাজির হয়েছেন। আদালতের কাছে বসার অনুমতি চাচ্ছি। আদালত এ আবেদনও মঞ্জুর করেন।

এ পর্যায়ে প্রধান বিচারপতি বলেন, আপনার কাছ থেকে আদালত অবমাননার কারণ দর্শানোর কোনো জবাব পাইনি। বাসেত মজুমদার বলেন, জবাব আমরা দাখিল করেছি। প্রধান বিচারপতি বলেন, জবাবে কি বলেছেন? বাসেত মজুমদার জবাবের অংশ পাঠ করে বলেন, বিশ্ব খাদ্য সংস্থার একটি আঞ্চলিক সম্মেলনে যোগদান এবং চিকিত্সা শেষে ১৬ মার্চ খাদ্যমন্ত্রী দেশে ফিরেছেন। এরপরই আদালতের আদেশে হাজির হয়ে নিঃশর্ত ক্ষমা প্রার্থনা করেছেন। ভবিষ্যতে এ ধরনের উক্তি করা থেকে বিরত থাকবেন বলেও তিনি অঙ্গীকার করেছেন। প্রধান বিচারপতি আবেদনের ৫ নম্বর অনুচ্ছেদ পাঠ করতে বলেন। ওই অনুচ্ছেদের উদ্ধৃতি দিয়ে বাসেত মজুমদার বলেন, আদালত অবমাননাকারী একজন মুক্তিযোদ্ধা। মুক্তিযুদ্ধের সময় পাক হানাদার বাহিনীর সহযোগী আল-বদর, আল-শামস ও রাজাকাররা এই মাটির সূর্য সন্তান ও কন্যাদের হত্যা করেছে। এই বিষয়টি স্মরণে আসায় তিনি আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েন এবং তা নিয়ন্ত্রণ করা ছিলো কষ্টকর। এজন্য ওই বক্তব্যের জন্য তিনি অনুশোচনা ও অনুতপ্ত বোধ করছেন। জবাবে প্রধান বিচারপতি বলেন, রাজনীতিবিদরা সংসদ ও টকশোতে বিচার, বিচার বিভাগ নিয়ে নানা মন্তব্য করেন। বিচারাধীন বিষয় নিয়ে দুজন মন্ত্রী যে বক্তব্য দিয়েছেন তা ঔদ্ধত্যপূর্ণ। বিষয়টি অবহিত হওয়ার পর নেপালে থাকাবস্থায় টেলিফোনে আমি আইনমন্ত্রীকে বলেছি, প্রধানমন্ত্রীকে বিষয়টি অবহিত করতে। দেশে ফেরার আগেই দুই মন্ত্রীকে সংবাদ সম্মেলন ডেকে প্রকাশ্যে ক্ষমা চাইতে বলেছিলাম। শুনেছি প্রধানমন্ত্রী দুই মন্ত্রীর বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। প্রেস কনফারেন্স করে ক্ষমা না চাইলে পরিণতি সাংঘাতিক খারাপ হবে বলে জানিয়েছিলাম। বিমান বন্দর থেকে আমি সরাসরি আদালতে আসি। আইনমন্ত্রী সব বিচারকদের সঙ্গে কথা বলতে আসেন। কিন্তু আপিল বিভাগের বিচারকরা উনার সাথে কথা বলতে রাজি হননি।

প্রধান বিচারপতি বলেন, এই আদালত সংবিধানের অঙ্গ, সরকারের অঙ্গ নয়। সরকার ও বিচার বিভাগের মধ্যে পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ থাকা দরকার। মন্ত্রী মহোদয়গণ শুধু প্রধান বিচারপতিকেই ছোট করেননি, গোটা বিচার বিভাগকে পায়ের নিচে গুঁড়িয়ে দিয়েছেন। তারা জানেন না বিচারাধীন বিষয় এবং প্রধান বিচারপতিকে নিয়ে কী ঔদ্ধত্যপূর্ণ বক্তব্য দিয়েছেন। প্রধান বিচারপতিকে এক হাজার কোটি টাকা ঘুষ দিলেন কিন্তু আরও চারজন বিচারপতি আছেন তাদের সকলকে কি একসাথে কেনা সম্ভব?

এ পর্যায়ে বিচারপতি মোহাম্মদ আব্দুল ওয়াহহাব মিঞা বলেন, প্রধান বিচারপতি চাইলেও তার পক্ষে একা রায় দেয়া সম্ভব নয়। রায় প্রদানের আগে প্রধান বিচারপতিও জানেন না কি রায় হবে। সবার মতামত নিয়ে তাকে রায় ঘোষণা করতে হয়।

প্রধান বিচারপতি বলেন, আমরা আদালত অবমাননা সংক্রান্ত জনকণ্ঠের মামলায় আদালত অবমাননার বিষয়ে একটি নির্দেশনা দিয়েছি। আপনারা কি ওই রায় দেখেছেন? মন্ত্রীরা মীর কাসেমের বিচারের রায়কে প্রভাবিত করতেই কি এই মন্তব্য করেছেন? প্রধান বিচারপতি ও বিচার বিভাগকে নিয়ে কুত্সা রটিয়েছেন কি? এ পর্যায়ে বাসেত মজুমদারকে প্রধান বিচারপতি বলেন, আপনার (খাদ্যমন্ত্রীর) ব্যাখ্যা হয়নি। এটা আমরা প্রত্যাখ্যান করলাম। আপনার দাখিলকৃত জবাবের ৫ নম্বর অনুচ্ছেদ সাংঘাতিক ঔদ্ধত্যপূর্ণ।

ব্যারিস্টার রফিকের উদ্দেশে প্রধান বিচারপতি বলেন, আপনি তো জনকণ্ঠের রায় পড়েছেন। সর্বোচ্চ আদালতের রায় মানতে কোনো বাধ্যবাধকতা আছে কি-না? রফিক উল হক বলেন, এটা মানতে সবাই বাধ্য। প্রধান বিচারপতি বলেন, কুত্সা রটানো এবং বিচার প্রশাসনে হস্তক্ষেপ ফৌজদারি আদালত অবমাননার অপরাধ। ডাকাতি মামলার আসামিকে যে সাজা দেয়া হয় আদালত অবমাননা করলেও একই রকমের সাজা দেয়া হয়। এটি জনকণ্ঠের মামলায় আমরা বলে দিয়েছি।

প্রধান বিচারপতি বলেন, আপনি (মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রী) স্বীকার করেছেন অপরাধ করেছেন। এ কারণে এই বিষয়টি এখানেই শেষ করতে চাই। আদালত অবমাননার বিষয় নিয়ে আর ঘাঁটাঘাঁটি করতে চাই না। টকশোতে যাবেন আর বাড়াবাড়ি করবেন এটা আর দেখতে চাই না। প্রধান বিচারপতি মন্ত্রীদের শপথ নেয়া সংক্রান্ত সংবিধানের ১৪৮ অনুচ্ছেদ পড়ার জন্য বলেন। ব্যারিস্টার রফিক-উল হক সংবিধানে মন্ত্রীদের শপথবাক্যের অংশটুকু পাঠ করে শোনান। পাঠ শেষ হলে প্রধান বিচারপতি বলেন, এখন বলুন  আপনি শপথ লঙ্ঘন করেছেন কি-না? সংবিধান রক্ষার শপথ নিয়ে যদি এই শপথ ভঙ্গ করেন তা হলে পরিণতি কী হবে? আপনি দোষ স্বীকার করে বলেছেন অন্যায় করেছেন।

প্রধান বিচারপতি বলেন, সেদিন রাত দশটা পর্যন্ত সুপ্রিম কোর্টে মিটিং করেছি। তখন পর্যন্ত আমরা মামলার সিদ্ধান্ত নেইনি। পরের দিন নিয়েছি। আপনি সংবিধান লঙ্ঘন করেছেন, সেটা জুডিশিয়াল নোটিসে নেয়ার আগেই আমরা সংবাদ সম্মেলন করে ক্ষমা চাওয়ার মেসেজ দিয়েছিলাম। সেটা আপনার মক্কেল বুঝেছিলেন কি-না?

প্রধান বিচারপতি বলেন, আমি নেপালের হাইকমিশনের মোবাইলফোনে আইনমন্ত্রীর সাথে যোগাযোগ করেছি। পরে সব বিচারপতির উপস্থিতিতে আবার আইনমন্ত্রীর সাথে কথা বলেছি। পরের দিনও সকাল সাড়ে আটটা পর্যন্ত আমরা অপেক্ষা করেছিলাম। প্রধান বিচারপতি বলেন, দেশ চলতে হলে সংবিধান রক্ষা করতে হবে। সংবিধান অনুযায়ী দেশ চলবে। তারা কত ঔদ্ধত্যপূর্ণ বক্তব্য দিয়েছেন। ওখানে একজন প্রসিকিউটর ছিলেন, তিনি নাকি রায় নিয়ে আইন কমিশনের চেয়ারম্যানকে দেখিয়েছেন। উনি বলেছেন রায় ঠিক আছে। আপনারা সুপ্রিম কোর্টকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন? প্রধান বিচারপতি বলেন, এটা দেশের সর্বোচ্চ আদালত। কোর্ট অব রেকর্ডের বাইরে আমরা রায় দিতে পারি না। আমরা সংবিধানের চুল পরিমাণ ব্যত্যয় করতে পারি না। আপনি সংবিধানের অধীনে শপথ নিয়েছেন। আপনাদের অপরাধ স্বীকার করা আর জনকণ্ঠের সাংবাদিক বা কোনো একজন সাধারণ নাগরিকের অপরাধ স্বীকার করার মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। তাদের অপরাধ আর আপনার অপরাধ এক নয়। একজন অপরাধীকে যখন কাঠগড়ায় এনে বলা হয়, তুমি দোষী না নির্দোষ? তখন ওই  আসামি যদি দোষ স্বীকার করে ক্ষমা চান তা হলে আদালত কি তাকে খালাস দেন? জবাবে ব্যারিস্টার রফিক উল হক বলেন, লঘু দণ্ড দেন। আমি অন্যায় করেছি বলেই নিঃশর্ত ক্ষমা চেয়েছি।

অ্যাডভোকেট বাসেত মজুমদার বলেন, ক্ষমা যখন চেয়েছি তখন দোষ স্বীকার করেই চেয়েছি। এখন পুরো বিষয়টি আদালতের হাতে। বিচারপতি ওয়াহহাব মিঞা বলেন, আমাদের প্রথা হচ্ছে ক্ষমা দুই লাইনে চাইতে হয়। আপনারা বিশাল ব্যাখ্যা দিয়েছেন।

প্রধান বিচারপতি বলেন, আমি যদি ওই মামলা থেকে নিজেকে প্রত্যাহার করে নিতাম তা হলে দেশে হয়তো রায়ট (দাঙ্গা) লেগে যেত। পুরো যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বানচাল হয়ে যেত। বাসেত মজুমদারের উদ্দেশে প্রধান বিচারপতি বলেন, আপনার মক্কেলকে সুরক্ষা দিতে না পারলে আদালতে আসবেন না। তারা যতই ক্ষমতাধর হোন না কেন আইন কিন্তু সোজা পথে চলবে। আমরা অনেক সহ্য করেছি। সংবিধান রক্ষায় যে কোনো আদেশ দিতে আমরা পিছপা/কুণ্ঠাবোধ করবো না, সে তিনি যেই হোন না কেন।

এ পর্যায়ে বাসেত মজুমদার বলেন, যথাযথভাবে জবাব দাখিলের সময় চাই। এরপর প্রধান বিচারপতি ২৭ মার্চ শুনানির দিন ধার্য করেন। একই সাথে ওইদিন খাদ্যমন্ত্রীকে জবাব দাখিলের নির্দেশ দেন।

প্রধান বিচারপতি ও বিচারাধীন মামলার বিষয়বস্তু নিয়ে আপত্তিকর বক্তব্য দেয়ায় গত ৮ মার্চ আপিল বিভাগের ফুল কোর্ট আদালত অবমাননার অভিযোগে ওই দুই মন্ত্রীকে তলবের নির্দেশ দিয়েছিলেন। একই সাথে আদালত অবমাননার দায়ে কেন ব্যবস্থা নেয়া হবে না তার ব্যাখ্যা দিতে বলা হয়।

গত ৫ মার্চ ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে আপিল বিভাগে বিচারাধীন যুদ্ধাপরাধে দণ্ডপ্রাপ্ত মীর কাসেম আলীর আপিলের বিষয় নিয়ে প্রধান বিচারপতিকে উদ্দেশ করে তির্যক মন্তব্য করেন সরকারের ওই দুই আইনজীবী মন্ত্রী। এ নিয়ে সকল মহলেই প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়।