দামুড়হুদার জগন্নাথপুর গৈচারা মাঠে চাঁদাবাজ দেবা ওরফে রিজননৃশংসতার শিকার

 

 

মস্তকবিহীন লাশ উদ্ধার : খণ্ডিত মাথার সন্ধান করতে পারেনি পুলিশ

ঘটনাস্থল থেকে ফিরেবখতিয়ার হোসেন বকুল:চুয়াডাঙ্গার দামুড়হুদা ও মেহেরপুরের মুজিবনগর এলাকার অন্ধকার জগতের আরো এক মুকুটহীন সম্রাটের পতন ঘটেছে। এবার নৃশংসভাবে গলাকেটে হত্যা করা হয়েছে রিজন (৩০) নামের এক চরমপন্থিকে। তাকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে এলোপাতাড়ি কুপিয়ে দেহ থেকে মস্তক বিচ্ছিন্ন করে হত্যা করা হয়েছে। মেলেনি মস্তকের সন্ধান। গত বুধবার রাতের কোনো একসময় দামুড়হুদা উপজেলার জগন্নাথপুর গ্রামের গৈচারার মাঠে (মুজিবনগর উপজেলার সীমান্তবর্তী) এ কিলিং মিশনের ঘটনা ঘটে।চরমপন্থিদের আভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের জের ধরে এ হত্যাকাণ্ডের ঘটনা বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা করছে পুলিশ। গতকাল বৃহস্পতিবার সকালে দামুড়হুদা থানা পুলিশ রিজন ওরফে লিজনের মস্তকবিহীন লাশ উদ্ধার করে চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালমর্গে প্রেরণ করে। লাশের পাশে শাদা কাগজে ‘দেবা ৪৪৫‘ লেখা একটি চিরকুট পাওয়া যায়। যা এলাকার সন্ত্রাসীদের অন্তর্কোন্দলের বহির্প্রকাশ বলে ধারণা করছে এলাকাবাসী ও পুলিশ। রিজন মেহেরপুর মুজিবনগর উপজেলার গোপালপুর গ্রামের ইরাদুল ইসলাম শাহ ওরফে হেবা ফকিরের ছেলে।

পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, গতকালভোরে ঘটনাস্থলে মস্তকবিহীন লাশ দেখে পুলিশে খবর দেয় স্থানীয় লোকজন। দামুড়হুদা থানা পুলিশ নিহতের লাশ অজ্ঞাত পরিচয় হিসেবে মর্গে প্রেরণ করে। দুপুর ২টার দিকে রিজনের বড় ভাই রিপন হোসেন চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালমর্গের সামনে লাশ দেখে পরিচয় নিশ্চিত করেন। ময়নাতদন্ত শেষে রিজনের লাশ পুলিশ তার পরিবারের লোকজনের কাছে হস্তান্তর করলে সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে নিজ গ্রামের কবরস্থানে দাফন সম্পন্ন করা হয়। গতকালই রিজনের বড় ভাই রিপন বাদী হয়ে অজ্ঞাতনামা কয়েকজনের নামে দামুড়হুদা থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। এ দিকে থানা পুলিশ রিজনের খণ্ডিত মাথার খোঁজে দিনভর দৌড়ঝাঁপের পরও এ সংবাদ লেখা পর্যন্ত কোনো হদিস মেলাতে পারেনি।

এলাকার বিভিন্ন মাধ্যম ও পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, দামুড়হুদা-মুজিবনগর এলাকার ত্রাস জামু বাহিনীর সাথে এক সময় সখ্য গড়ে ওঠে রিজনের। পা বাড়ায় অন্ধকার জগতে। ওই বাহিনীর সেকেন্ড কমান্ড হিসাবে সে খুন, চাঁদাবাজি ও ডাকাতির নেতৃত্ব দিয়েছে বলে জনশ্রুতি রয়েছে। পুলিশের খাতায়ও এরকম তথ্য রয়েছে। তবে বেশ কয়েক বছর আগে থেকেই জামু বাহিনীর সাথে রিজনের বিরোধ সৃষ্টি হয়। বাহিনীর কিছু সদস্য নিয়ে গ্যাং গ্রুপ গঠন করে রিজন। যোগ দেয় নতুন পুরাতন কয়েকজন সন্ত্রাসী। রিজন হয়ে ওঠে আরো বেপরোয়া। চাঁদাবাজি ও বোমাবাজিসহ কয়েকটি হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে তার সম্পৃক্ততার অভিযোগ ওঠে।

দামুড়হুদা মডেল থানার ওসি সিকদার মশিউর রহমান জানান, এলাকাবাসীর কাছ থেকে খবর পেয়ে সকালেই লাশ উদ্ধার করা হয়। লাশের পাশে শাদা কাগজে কালো কালি দিয়ে লেখা একটি চিরকুটে ‘দেবা ৪৪৫’ লেখা পাওয়া যায়। ওই কাগজের সূত্র ধরেই ধারণা করা হয় লাশটি মেহেরপুর মুজিবননগর এলাকার শীর্ষ সন্ত্রাসী দেবার। দেবা ওরফে রিজন ওরফে লিজনের বিরুদ্ধে চুয়াডাঙ্গার দামুড়হুদা এবং মেহেরপুরের মুজিবনগর থানায় ট্রিপল মার্ডারসহ অন্তত ৭টি মামলা রয়েছে। সে এলাকার কুখ্যাত সন্ত্রাসী জামু বাহিনীর সেকেন্ড ইন কমান্ড হিসেবে দায়িত্ব পালন করতো। নিহতের বড় ভাই রিপন বাদী হয়ে অজ্ঞাতনামা কয়েকজনের নামে দামুড়হুদা থানায় মামলা দায়ের করেছেন। তবে এখনও পর্যন্ত নিহতের খণ্ডিত মাথার হদিস মেলানো সম্ভব হয়নি।

২০১২ সালের ৫ ডিসেম্বর দিনগত রাতে মুজিবনগর উপজেলার রতনপুর টুপলার বিলের পাশে তারানগর গ্রামের মৃত আজমতের ছেলে রবি (৩৬), জয়পুর গ্রামের মৃত রাফায়েল মণ্ডলের ছেলে হিরু (৩৫) ও পুরন্দরপুর গ্রামের আজিজুল বাঙালির ছেলে ইমাদুল ইসলাম ওরফে আমাদুলকে (৩৮) গলাকেটে হত্যা করা হয়। তিনজনই মেহেরপুর ডিএসবি তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসী ও হত্যাকাণ্ডসহ একাধিক মামলার আসামি ছিলো। জামু বাহিনীর ওই তিন সদস্যর বিরুদ্ধে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের অভিযোগ ছিলো অসংখ্য। উলঙ্গ অবস্থায় পড়ে থাকা লাশগুলোর গায়ে ও আশেপাশে টুকরা কাগজে ‘দেবা ৪৪৫’ লেখা চিরকুট উদ্ধার করেছিলো পুলিশ। গতকাল উদ্ধার হওয়া রিজনের লাশের পাশেও একই চিরকুট উদ্ধারের ঘটনায় নানা প্রশ্ন জেগেছে জনমনে। কে এই দেবা?এলাকার জনশ্রুতি রয়েছে রিজনই দেবা নাম ব্যবহার করে চাঁদাবাজি করতো।তাহলে কেনো এই চিরকুট?দেবা অধ্যায় সমাপ্ত নাকি দেবা নাম ব্যবহার করেই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়ে অন্তরালে থেকে যাচ্ছে অন্য কেউ?

নিহতের বড় ভাই রিপন এজাহারে বলেছেন, রিজন দীর্ঘ ১৫ বছর যাবত এলাকায় থাকেনা এবং বাড়ির সাথে তার কোনো যোগাযোগও ছিলো না। বিগত ৮ বছর আগে একবার বাড়ি এসেছিলো। কোথায় থাকিস জিজ্ঞাসা করলে সে বলেছিলো ঢাকার থাকি গাজীপুরে। লোকমুখে শুনছি সে গত মঙ্গলবার এলাকায় এসেছে কিন্তু বাড়িতে যায়নি। গতকাল বৃহস্পতিবার লোকজন বলাবলি করছিলো দামুড়হুদা উপজেলার জগন্নাথপুরে মার্ডার হয়েছে। সকাল ১০টার দিকে জগন্নাথপুর আসলে এলাকার লোকজন বলে পুলিশ লাশ উদ্ধার করে থানায় নিয়ে গেছে। তবে তোমার ভাই রিজনকে গত বুধবার বিকেলে এ এলাকায় ঘোরাফেরা করতে দেখেছি। দুপুরে চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালমর্গে গিয়ে লাশ শনাক্ত করি। আমার ভাই এলাকার কিছু খারাপ লোকজনের সাথে মেলামেশা করতো। আমার ধারণা তাদের সাথে কোনো মতবিরোধের কারণে তারাই আমার ভাইকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে এলোপাতাড়ি কুপিয়ে জবাই করে তার মাথা অন্যত্র লুকিয়ে রেখেছে। এলাকার কয়েকজন নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, সে দীর্ঘদিন ধরে মোবাইলে লাগাতারভাবে চাঁদাদাবি করে আসছিলো। তার অত্যাচারে এলাকার মানুষ অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিলো। তার কাছে এলাকার মানুষ ছিলো অনেকটাই জিম্মি। দেবা নামে চাঁদাবাজি করা হলেও এলাকার মানুষ রিজনকেই সন্দেহ করেছিলো। রিজনের নিহতের খবর এলাকায় জানাজানি হলে ভুক্তভোগী মানুষের মাঝে নেমে আসে স্বস্তির নিঃশ্বাস।

নিহত দেবার পরিচয়: মেহেরপুর জেলার মুজিবনগর উপজেলার মহাজনপুর ইউনিয়নের গোপালপুর গ্রামের ইরাদুল ইসলাম শাহ ওরফে হেবার ছেলে রিজন। দুভাইয়ের মধ্যে সেছিলো ছোট। গ্রামের স্কুলে ৪র্থ শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপাড়া জানা রিজন আগে এলাকায় কৃষিকাজ করতো। বছর পনেরো আগে ঢাকায় পাড়ি জমায়। ওখানেই ২টি বিয়ে করে। তার ২ স্ত্রীই গার্মেন্টসে কাজ করে। তারা ঢাকায় থাকে। সে নিজেও নাকি গার্মেন্টসে কাজ করতো।