দাবি আদায়ে রাজপথে গার্মেন্টস শ্রমিকরা

সড়ক-মহাসড়কে তীব্র যানজট সংঘর্ষ ভাঙচুর আগুন : গাজীপুরে আনসার ক্যাম্পে হামলা : অস্ত্র গুলি লুট

স্টাফ রিপোর্টার: ন্যূন্যতম মজুরি আট হাজার টাকা করার দাবিতে টানা তৃতীয় দিনের মতো সড়ক-মহাসড়কে নেমে বিক্ষোভ করেছেন গার্মেন্টসের শ্রমিকরা। গতকাল রাজধানী ছাড়াও গাজীপুর, টঙ্গি, সাভার, কালিয়াকৈর ও রাজধানীর আশপাশের বিভিন্ন গার্মেন্টসের শ্রমিকরা বিক্ষোভ করেন। রাজধানীতে শ্রমিকদের সাথে পুলিশের বিচ্ছিন্ন সংঘর্ষ হয়েছে। এ সময় দুটি মোটরসাইকেলে আগুন আর কিছু যানবাহনে ইটপাটকেল ছোড়া হয়। আর গাজীপুরে আনসার ক্যাম্পে হামলা চালিয়ে ৪টি রাইফেল ও ১৬০ রাউন্ড গুলি লুট করে নিয়ে যায়। পরে রাইফেল চারটি পাশের একটি ডোবা থেকে উদ্ধার হলেও ১৩৫ রাউন্ড গুলি পাওয়া যায়নি। শ্রমিকদের অবরোধের কারণে গতকাল সোমবার সকাল সাড়ে আটটা থেকে গাজীপুরে ঢাকা-ময়মনসিংহ ও ঢাকা টাঙ্গাইল মহাসড়কে প্রায় তিন ঘণ্টা এবং সাভারে ঢাকা-আরিচা মহাসড়কে ঘণ্টাখানেক যান চলাচল বন্ধ থাকে। এছাড়া শ্রমিকরা রাজপথে নামার কারণে রাজধানীতে তীব্র যানজটের সৃষ্টি হয়। বিভিন্ন জায়গায় শ্রমিকরা রাস্তায় টায়ার জ্বালিয়ে বিক্ষোভ করেন। বিশৃঙ্খলা এড়াতে রাজধানী ও গাজীপুরসহ আশপাশের সব গার্মেন্টসেই গতকাল ছুটি ঘোষণা করা হয়। গার্মেন্টস মালিকরা বলেছেন, নিরাপত্তা পেলে আজই তারা কারখানা চালু করতে চান। ঢাকা মহানগর পুলিশের তেজগাঁও অঞ্চলের উপ-কমিশনার বিপ্লব কুমার সরকার জানান, তেজগাঁও শিল্পাঞ্চলের নাবিস্কো এলাকার বিভিন্ন কারখানার কয়েক হাজার শ্রমিক সকাল ১০টার দিকে রাস্তায় নেমে আসে এবং টায়ার জ্বালিয়ে বিক্ষোভ শুরু করে। শ্রমিকরা কয়েকটি গাড়ি ভাঙচুর করে এবং দু’টি মোটরসাইকেলে আগুন দেয়। তাদের অবরোধের কারণে গুলশান-তেজগাঁও লিংক রোডে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। পরে পুলিশ টিয়ার শেল ছুড়ে শ্রমিকদের ছত্রভঙ্গ করে দিলে বেলা ১১টার দিকে ওই সড়কে আবার যান চলাচল শুরু হয়। এদিকে নাবিস্কোর পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসার পরপরই বিক্ষোভ শুরু হয় মহাখালীতে। তিতুমীর কলেজের কাছে গার্মেন্টের শ্রমিকরা সড়কে নেমে মিছিল শুরু করলে যান চলাচল বিঘ্নিত হয় বলে জানিয়েছেন মহানগর পুলিশের গুলশান অঞ্চলের উপ-কমিশনার লুত্ফুল কবীর। প্রায় একই সময়ে বনানী ও ফার্মগেইট এলাকাতেও শ্রমিকরা বিক্ষোভ করেন।

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, রাজধানীর মালিবাগে গতকাল বিকেল তিনটার দিকে গার্মেন্টস শ্রমিকদের সাথে পুলিশের সংঘর্ষ হয়েছে। এ সময় পুলিশ শ্রমিকদের সরিয়ে দেয়ার জন্য কয়েক রাউন্ড ফাঁকা রাবার বুলেট নিক্ষেপ করে। বেতন-ভাতা বাড়ানোর দাবিতে শ্রমিকরা একটি মিছিল বের করে। মিছিলটিকে ছত্রভঙ্গ করতে পুলিশ টিয়ারশেল নিক্ষেপ করলে মিছিলকারীরা বিভিন্ন অলিগলিতে চলে যায়। তবে এতে কোনো হতাহতের ঘটনা ঘটেনি। রমনা থানার এসআই আলী হোসেন জানান, বেতন ভাতার দাবিতে শ্রমিকরা একটি মিছিল বের করলে তাদেরকে সেখান থেকে চলে যেতে বলা হয়। কিন্তু তারপরও তারা রাস্তায় বসে পুলিশকে ইটপাটকেল নিক্ষেপ করলে বিচ্ছিন্ন সংঘর্ষ হয়।

গাজীপুরে আনসারের অস্ত্র ও গুলি লুট: গতকাল সোমবারও গাজীপুর জেলা সদরের বিভিন্ন গার্মেন্টস কারখানায় বিক্ষোভ, অগ্নিসংযোগ, যানবাহন ভাঙচুর, অবরোধ করেছে শ্রমিকরা। একটি গার্মেন্টসে আনসারদের অস্ত্র ও গুলি লুটের ঘটনা ঘটেছে। শ্রমিকদের অবরোধের কারণে গতকাল সকাল সাড়ে ৮টা থেকে ঢাকা-ময়মনসিংহ ও ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। সকাল সাড়ে আটটার দিকে ভোগড়া বাইপাস মোড় এলাকায় কলোসাস এ্যাপারেলস লিমিটেড ইউনিট-২ তে বহিরাগত শ্রমিকরা হামলা চালায়। তারা জোরপূর্বক গেট ভেঙে ভেতরে প্রবেশ করতে চাইলে আনসার সদস্যরা তিন রাউন্ড ফাঁকা গুলি করে। এ সময় বহিরাগত উত্তেজিত শ্রমিকরা ওই কারখানার গেট ভেঙে ভেতরে প্রবেশ করে আনসার সদস্যদের বেধড়ক মারধর করে চারটি রাইফেল ও ১৬০ রাউন্ড গুলি লুট করে নিয়ে যায়।

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, সকাল সাড়ে আটটার দিকে ভোগড়া বাইপাস মোড় এলাকায় কলোসাস অ্যাপারেলস লি. ইউনিট-২ তে বহিরাগত শ্রমিকরা হামলা চালায়। তারা প্রথমে কারখানার প্রধান ফটকের কাছে গেলে কারখানার নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত আনসার সদস্যরা শ্রমিকদের বাধা প্রদান করেন। এক পর্যায়ে তারা জোরপূর্বক গেট ভেঙে ভেতরে প্রবেশ করতে চাইলে আনসার সদস্যরা তিন রাউন্ড ফাঁকা গুলি করে। এ সময় বহিরাগত উত্তেজিত শ্রমিকরা ওই কারখানার গেট ভেঙে ভেতরে প্রবেশ করে আনসার সদস্যদের বেধড়ক মারধোর করে ৪টি রাইফেল ও ১৬০ রাউন্ড গুলি লুট করে নিয়ে যায়। তারা কারখানার অভ্যন্তরে একটি মাইক্রোবাস, কারখানার জানালার কাঁচ, আনসার সদস্যদের গার্ডরুম, সিসি ক্যামেরা, কম্পিউটার ও আসবাবপত্র ভাঙচুর করে। পরে অন্য আনসার সদস্যরা কারখানার পার্শ্ববর্তী একটি ড্রেন থেকে ভাঙা অবস্থায় চারটি রাইফেল উদ্ধার করলেও ১৩৫ রাউন্ড গুলির কোনো সন্ধান পাওয়া যায়নি। বহিরাগত শ্রমিকদের হামলায় আনসার সদস্য আলম মৃধা, মাহে আলম ও রায়হান গুরুতর আহত হন। তাদেরকে স্থানীয় একটি ক্লিনিকে ভর্তি করা হয়েছে। এ ছাড়া এ ঘটনায় ওই কারখানার আনসার কমান্ডার আপন মোল্লা, শেখর, তরিকুল ইসলাম ও আবুল কালাম আহত হন। সকাল দশটার দিকে গাজীপুর জেলা আনসার অ্যাডজুটেন্ট আলমগীর হোসেন ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন।

কলোসাস অ্যাপারেলস লিমিটেডের ম্যানেজার নূরে আলম জানান, তাদের কারখানায় এক হাজার শ্রমিক কাজ করলেও বেতন ভাতা নিয়ে তাদের কোনো অভিযোগ নেই। কিন্তু বহিরাগত শ্রমিকরা এসে জোরপূর্ব কারখানায় হামলা চালালে বাধ্য হয়ে ভাঙচুর এড়াতে নিজেদের কারখানার শ্রমিকদের ছুটি দিয়ে দেয়া হয়েছে। পুলিশ ও স্থানীয় সূত্র জানায়, গাজীপুর জেলা সদরের চান্দনা চৌরাস্তা, বোর্ডবাজার, বড়বাড়ি, ভোগড়া, বাসন সড়ক, ভোগড়া বাইপাস, সাইনবোর্ড, নাওজোর, জয়দেবপুর তিন সড়ক, তেলিপাড়া, হোতাপাড়া, কোনাবাড়ি, কাশিমপুরসহ আশপাশের বিভিন্ন গার্মেন্টস কারখানার শ্রমিকরা কাজে যোগ না দিয়ে বিক্ষিপ্তভাবে সকাল আটটার দিকে মহাসড়কে নেমে আসে এবং মজুরি বৃদ্ধির দাবিতে বিক্ষোভ শুরু করে। বিক্ষুব্ধ শ্রমিকরা নাওজোড় এলাকার দিগন্ত সোয়েটার কারখানার সামনে অবরোধ করলে ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। কোনাবাড়ি শিল্প এলাকার ইন্টার স্টপ, তুশুকা গার্মেন্টস, ইন্টার লিংক, সানমুন, এমএম গার্মেন্টস, সিদ্দিক ফ্যাশন, ভোগড়া এলাকার বলমন্ট ফ্যাশন্স, মেন ট্রাস্ট, গাজীপুর সদরের তিন সড়ক এলাকার স্পেরো অ্যাপারেলসসহ আশপাশের কয়েকটি কারখানার শ্রমিকরা বিভিন্ন স্থানে সড়কে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ করে। শ্রমিকরা লাঠিসোটা নিয়ে চান্দনা চৌরাস্তা মোড়ে ঢাকা ময়মনসিংহ ও ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কে যানবাহন ভাঙচুর করতে থাকে। এ সময় জয়দেবপুর থানার পুলিশ, শিল্প পুলিশ ও ইন্ডাস্ট্রিয়াল পুলিশ শ্রমিকদের বাধা দিলে তাদের সাথে শ্রমিকদের ধাওয়া পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। এতে কমপক্ষে অর্ধশত শ্রমিক ও পথচারি আহত হয়।