দলীয় আভ্যন্তরীণ কোন্দল আর লোকসানের আশঙ্কায় ইজারায় অংশ নেননি কেউ

চুয়াডাঙ্গার গড়াইটুপি মেলার ৫শ বছরের ঐতিহ্য বিলীন হওয়ার পথে : রাজস্ব হারাচ্ছে সরকার

নজরুল ইসলাম: আজ ১ আষাঢ়। আষাঢ় এলেই চুয়াডাঙ্গা সদরের ঐতিহ্যবাহী গড়াইটুপি মেলার আঙিনাসহ আশপাশ এলাকায় বিরাজ করতো সাজসাজ ভাব।  আগেভাগেই আসা সার্কাস, যাত্রাপালা, মিষ্টির দোকানসহ বিভিন্ন ব্যবসায়ীদের পদচারণায় মুখরিত হয়ে উঠতো মেলার আঙিনা। কিন্তু এ বছর ঐহিত্যবাহী এ মেলা প্রাঙ্গণে নেই কোনো উত্তাপ। শুনশান আর নিস্তব্দ মেলার স্থান। স্থানীয় দলীয় কোন্দল ও লোকসানের ভয়ে ৫শ বছরের এ মেলার ইজারায় এখন পর্যন্ত অংশগ্রহণ করেননি কেউ। এ মেলাকে কেন্দ্র করে গত বছর ঘটেছে অনেক অঘটন। আইনি মারপ্যাচে পড়ে অনেককেই টানতে হয়েছে জেলের ঘানি। ইতিহাস খ্যাত ঐতিহ্যবাহী চুয়াডাঙ্গা জেলার গড়াইটুপি মেলা বন্ধের উপক্রম হয়েছে। মেলাটি বন্ধ হলে সরকার হারাতে পারে প্রায় অর্ধকোটি টাকার রাজস্ব। তাই জনমনে প্রশ্ন ইতিহাস মণ্ডিত গড়াইটুপি মেলা কী হারাতে বসেছে তার ঐতিহ্য?

প্রতিবছর ৭ আষাঢ় চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলার তিতুদহ ইউনিয়নের গড়াইটুপির খাজা মালিক-উল-গাউছের মাজারকে কেন্দ্র করে সরকারি শূন্য দশমিক ৪৭ একর খাস জমির ওপর বসে মেলা। গড়াইটুপির এ মেলা কবে কখন শুরু হয়েছে সে ব্যাপারে সুনির্দিষ্টভাবে কেউ দিনক্ষণ বলতে না পারলেও দীর্ঘদিন থেকে এলাকার মানুষের বিনোদনের খোরাক হিসেবে আনন্দ দিয়ে আসছে এ মেলা। শুরুর আগে থেকেই মেলার আশপাশ এলাকায় বেচা বিক্রির পসরা সাজিয়ে বসে দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে আসা দোকানিরা। ৯০’র দশকের পর এ মেলাটি বাণিজ্যিকভাবে রূপ নিলে সরকারের দৃষ্টি পড়ে। সামান্য জমি ইজারা দিয়ে প্রতি বছর লাখ লাখ টাকা রাজস্ব আদায় করে থকে। প্রতিবছরের ন্যায় এ বছর ২৩ মে ১৫ শতাংশ ভ্যাট, ৫ শতাংশ আয়করসহ ৪২ লাখ টাকায় মেলাটি ইজারা দেয়ার নিমিত্তে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে জেলা প্রশাসন। ৩১ মে শেষ দিন পর্যন্ত ইজারাই কেউ অংশগ্রহণ করেনি। ৮ জুন পর্যন্ত ইজারার দ্বিতীয় দিন থাকলেই এখন পর্যন্ত কেউ অংশগ্রহণ করেননি। তাই আগামী ১৯ জুন পর্যন্ত তৃতীয়বারের মতো ইজারার জন্য অপেক্ষা করছে জেলা প্রশাসন। গত বছর এ মেলা থেকে ৪০ লাখ টাকা ইজারামূল্য এবং আয়কর ভ্যাট বাবদ আরও ৮ লাখ টাকা সর্বমোট ৪৮ লাখ টাকা রাজস্ব পায় সরকার। সরকার রাজস্ব পেলেও ইজারাদারকে গুনতে হয় মোটা অঙ্কের লোকসান। যার জের এখনও চলছে। সে মেলা নিয়ে পুলিশ প্রশাসনের ভিন্ন মত থাকায় শুরু থেকেই ইজারাদার এবং পুলিশ প্রশাসনের মধ্যে টান পড়েন চলে ঘটে নানা অঘটন। আইনের মারপ্যাচে পড়ে অনেকেই টানতে হয় জেলের ঘানি। একটি সূত্র বলেছে, লোকসান আর স্থানীয় ক্ষমসীন দলের আভ্যন্তরীণ কোন্দলের কারণে এখন পর্যন্ত ইজারায় কেউ অংশগ্রহণ করেননি। অর্ধকোটি টাকা সরকারি রাজস্ব আর আয়োজনের আরও অর্ধকোটি মোট ১ কোটি টাকা বিনিয়োগ করে ঝুঁকি নিতে চাচ্ছেন না কেউ।

১৩ শতকের সূচনালগ্নে সুলতানি শাসনামল শুরু হয়। তখন থেকেই বাংলায় মুসলিম শাসনের সূত্রপাত হয়। তবে এর অনেক আগে থেকেই বাংলার সাথে আরব মুসলমানদের যোগাযোগ ছিলো। অবশ্য সে যোগাযোগের স্বরূপ ছিলো বাণিজ্যিক ও ধর্মীয়। তৎকালীন দক্ষিণবঙ্গের ইসলাম ধর্ম প্রচারের দায়িত্ব নিয়ে আর্বিভাব হন হযরত খানজাহান আলী (র.)। তিনি খুলনা বাগেরহাটে পৌঁছুনোর আগে কিছু অনুসারী রেখে যান। তার মধ্যে অন্যতম ছিলেন- খাজা মালিক-উল-গাউছ (র.)। তিনি মেলার স্থানে টবগাছের নিচে আস্তানা করে থাকতেন। ইসলামধর্ম প্রচার কালে তিতুদহের কালুরপোলে অবস্থিত রাজা গন্ধর্প রায়ের সাথে বিরোধ বাঁধে খাজা মালিক-উল-গাউছ (র.)। জনশ্রুতি রয়েছে খাজা মালিক-উল-গাউছ (র.) মৃত্যুবরণ তাকে সমাধি করা হয় বটগাছের নিচে। সেই থেকে মনবাসনা পূরণে ভক্তরা এখানে আসতেন। আস্তে আস্তে আস্তানাটি রূপ নেয় বাণিজ্যিক মেলাকেন্দ্র হিসেবে। বর্তমানে তার পরিধি পায় ব্যাপকতা। ইউপি চেয়ারম্যান আকতার হোসেন ক্ষোভের সাথে বলেন, ক্ষমতাসীন দলের আভ্যন্তরীণ কোন্দলের জেরে ৫শ বছরের ইতিহাস আর ঐতিহ্যের এ মেলাটি বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছে। জানানি না ৭ আষাঢ় কী ঘটবে।