দর্শনা অনির্বাণের একুশে মেলায় দু গুণীজনকে সংবর্ধনা ও সমাপনি দিনে এমপি আলী আজগার টগর

হারুন রাজু/হানিফ মণ্ড: প্রতি বছরের মতো এ বছরো একুশের মেলার আয়োজন করেছে অনির্বাণ থিয়েটার। একুশ বহিবো মনে- সকল শুভক্ষণে শীর্ষক অনির্বাণ থিয়েটারের একুশে মেলার আনুষ্ঠানিক সম্পন্ন হয়েছে। দর্শনা কলেজ মাঠে অনুষ্ঠিত একুশে মেলার নিয়মিত আলোচনা পর্বের মধ্যে গত শুক্রবারের পর্বে ছিলো ভিন্নতা। গতকাল শনিবার সন্ধায় নিয়মিত আলোচনাসহ সকল আয়োজনের মধ্যদিয়ে মেলার সম্পন্ন করা হয়েছে অনির্বাণের পক্ষ থেকে। এবারের মেলায় ও দর্শনার বিশিষ্ট দু গুণীজনের সংবর্ধনার আয়োজন করে অনির্বাণ থিয়েটার।

গত শুক্রবার ও শনিবারের আলোচনা পর্বের প্রধান অতিথি ছিলেন চুয়াডাঙ্গা-২ আসনের সংসদ সদস্য হাজি আলী আজগার টগর। দু দিনের আলোচনা পর্বের সভাপতিত্ব করেন অনির্বাণ থিয়েটারের সভাপতি ফজলুল হক। শুক্রবার সন্ধ্যায় দর্শনা সরকারি কলেজের অবসরপ্রাপ্ত উপাধ্যক্ষ, দর্শনা প্রেসক্লাবের উপদেষ্টা মণ্ডলীর অন্যতম সদস্য বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ মোশাররফ হোসেন ও দামুড়হুদা উপজেলার সাবেক চেয়ারম্যান জেলা আ.লীগের সাধারণ সম্পাদক বিশিষ্ট রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব বীর মুক্তিযোদ্ধা আজাদুল ইসলাম আজাদকে ফুলেল শুভেচ্ছা ও সম্মাননা ক্রেস্ট দিয়ে সংবর্ধনা দেয়া হয়েছে। এছাড়া বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনীতিক দলের পক্ষ থেকে এ দু গুণীজনকে ফুলেল শুভেচ্ছা ও উত্তরীয় পরিয়ে সংবর্ধনা দেয়া হয়। অনুষ্ঠানের শুরুতেই কবিগুরু রবিন্দ্রনাথের ‘ওগো আলোর পথযাত্রী, এখানে থেমে যেওনা’ গানের মুর্ছনা মোমবাতি প্রজ্জ্বলন করা হয়। সবংবর্ধনা শেষে অনুষ্ঠিত হয় আলোচনাসভা।

আলোচনায় প্রধান অতিথি চুয়াডাঙ্গা-২ আসনের সংসদ সদস্য হাজি আলী আজগার টগর বলেন, স্বাধীনতার এতো বছর পরেও স্বাধীনতা বিরোধী অপশক্তি আবারো মাথাচারা দিয়ে উঠেছে। ইতিহাসের যুগ সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে মহান একুশের চেতনায় উব্ধুব্ধ হয়ে মানবতা বিরোধীদের রুখে দাঁড়াতে হবে। সেই সাথে যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির দাবিতে তরুণ সমাজকে এগিয়ে আসতে হবে। একুশের ইতিহাস রক্ত আর সন্তানহারা দুখিনি মায়ের অশ্রু দিয়ে লেখা ইতিহাস। ১৯৫২’র ভাষা আন্দোলনে যাদের রক্তে লাল হয়েছিলো বাংলার মাটি, আমরা তাদের ভুলবো না কোনো দিন। রাজপথের সেই রক্তের দাগ হয়তো মুছে গেছে, কিন্তু যতোদিন থাকবে এ পৃথিবী বিদ্যমান, ততোদিন বাঙালি জাতির অন্তর থেকে মুছবে না সে শোকের ক্ষত। যে ভাষার জন্য এতো ত্যাগ, সেই মায়ের ভাষা আজ বিকৃত হচ্ছে নানাভাবে। তাই আসুন একুশের মহিমায় মহিম্মান্নিত হয়ে বাংলা ভাষার মহত্মকে অক্ষুণ্ণ রাখি। ভাষার প্রতি সকলে হই দরদি, নিংড়ে দিয়ে সবটুক ভালোবাসা, মায়ের মুখের হাসি রাখি অটুট। তাই আসুন একুশের চেতনা বুকে ধারণ করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সোনার বাংলা গড়তে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাতকে আরো শক্তিশালী করি।

চুয়াডাঙ্গা জেলা প্রশাসক মো. দেলোয়ার হোসাইন বলেন, আলোকিত মানুষদের আত্মত্যাগ ও বর্ণাঢ্য কর্মজীবন আমাদের চলার পথকে করে আলোকিত। আমি তাদের সর্বাঙ্গীন মঙ্গল কামনা করছি। অনির্বাণ থিয়েটারের এ আয়োজন সংস্কৃতিচর্চার বহির্প্রকাশ। কেরুজ চিনিকলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক কৃষিবিদ আজিজুর রহমান বলেন, একুশ শোকের চাদরে মোড়ানো একটি ঐতিহাসিক দিন। ১৯৫২ সালে বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়ে যারা অর্জন করেছিলো আজকের এ মায়ের ভাষায় কথা বলার অধিকার আমরা তাদের ভুলিনি ও ভুলবোনা কখনো। দর্শনা পৌর মেয়র মহিদুল ইসলাম বলেন, ভাষার জন্য লড়াই করে যারা রক্ত দিয়েছে, তারা আমাদের গর্ব আমাদের অহঙ্কার। তাদের আত্মত্যাগ যুগ যুগ স্মরণ করবে বাঙালি। অনির্বাণ থিয়েটারের সাধারণ সম্পাদক আনোয়ার হোসেনের প্রাণবন্ত উপস্থাপনায় সংবর্ধনুষ্ঠানে সংবর্ধিতসহ বিশেষ অতিথিদের ফুলেল শুভেচ্ছা ও সম্মাননা ক্রেস্ট প্রদানসহ অভিনন্দিত করা হয়েছে থিয়েটারের পক্ষ থেকে। অনুষ্ঠানে আরো উপস্থিত ছিলেন, ঢাকা থিয়েটারের প্রতিনিধি কামাল বায়েজিদ, দামুড়হুদা উপজেলা আ.লীগের যুগ্মসম্পাদক ইউপি চেয়ারম্যান জাকারিয়া আলম, আ.লীগ নেতা আলী মুনসুর বাবু। সংবর্ধিত গুণীজন শিক্ষাবিদ মোশাররফ হোসেন বলেন, নিষ্ঠার সাথে কাজ করলে অনেক অসম্ভবকে সম্ভব করা যায়। বিকশিত করা যায় নিজের শ্রেষ্ঠত্বকে। শিক্ষা ও সামাজিক জীবনের সন্ধিক্ষণে এসে অবহেলিত আমার এ জেলার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, কর্মসংস্থানসহ বিভিন্ন রকমের উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডে নিজেকে নিয়োজিত রেখেছি। দর্শনার মানুষ আমাকে এতো ভালোবাসে আজকের দিনটাই তা উপলদ্ধি করছি। আমাকে সম্মননাকে অনির্বাণ ও দর্শনাবাসীর জন্য উৎসর্গ করলাম। বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ আজাদুল ইসলাম আজাদ বলেন, দর্শনা তথা এ জেলাবাসীর অনুপ্রেরণা আমাকে এতোদূর এগিয়ে নিয়েছে। অর্থনৈতিক মুক্তির লক্ষ্যে এলাকাবাসী আমাকে যে সহযোগিতা ও ভালোবাসা পেয়েছি তা কখনো ভুলার নয়। যতোদিন বেঁচে থাকবো, মানুষের কল্যাণে কাজ করে যাবো। অনির্বাণের জন্ম না হলে আমার জীবনে এতো বড় গৌরবের দিন আসতো কি-না জানি না। অনির্বাণকে আমি ধন্যবাদ জানাই।

উল্লেখ্য, বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ মোশাররফ হোসেন ১৯৪৮ সালে ১ জানুয়ারি ভারতের নদীয়া জেলার চাকদা শহরে পিত্রালয়ে জন্মগ্রহন করেন। পিতা মানিক মণ্ডল ও মা শরিফুন্নেছা। ৪ ভাই ৩ বোনের মধ্যে তিনি সকলের ছোট। ১৯৭২ সালে তিনি ঢাকার বঙ্গবাসী কলেজে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে নৈশকালীন প্রভাষক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। ১৯৭৩ সালে যোগদান করেন তৎকালীন দর্শনা মহাবিদ্যালয়ে। ২০০৪ সালে দর্শনা সরকারি কলেজের উপাধ্যক্ষ হিসেবে কর্মরত অবস্থায় অবসর গ্রহণ করেন। তিনি ২ সন্তানের জনক। আজাদুল ইসলাম আজাদ ১৯৫৩ সালের ১৪ জুলাই দর্শনা শ্যামপুরে জন্মগ্রহণ করেন। পিতার নাম আজিজুল ইসলাম ও মাতা বেগম লুতফুন্নেছা। শিক্ষাজীবন শুরু হয় শ্যামপুর প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে। যথাক্রমে দর্শনা মেমনগর মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে এসএসসি ও চুয়াডাঙ্গা সরকারি কলেজ থেকে এইচএসসি ও বিকম পাস করেন। ছাত্রজীবন থেকেই তিনি রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত হন। দেশ মাতৃকার টানে ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানে নেতৃস্থানীয় ভূমিকা পালন করেন। মুক্তিযুদ্ধকালীন মুজিববাহিনীর দামুড়হুদা থানার ডেপুটি কমান্ডার এবং মুক্তিযুদ্ধত্তোর চুয়াডাঙ্গা মহকুমা ছাত্রলীগের আহ্বায়ক নির্বাচিত হন। ১৯৭৩ সালে মহাকুমা যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে নির্বাচিত হন। ১৯৭৪ সালে দেশের যুবপ্রতিনিধি হিসেবে পূর্ব এশিয়া সফর করেন। জেলা আ.লীগের বিভিন্ন পদে দায়িত্বভার গ্রহণ শেষে ২০০৪ সালে তিনি জেলা আ.লীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। সেই থেকে তিনি একই পদে দায়িত্ব পালন করে আসছেন। ২০০৯ সালে তিনি দামুড়হুদা উপজেলা চেয়ারম্যান পদে নির্বাচিত হন।

গতকাল শনিবার মেলার সমাপনী দিনের আলোচনা পর্বে বিশেষ অতিথির বক্তব্যে চুয়াডাঙ্গা-৬ বর্ডার গার্ডের পরিচালক লে. কর্নেল মনিরুজ্জামান বলেন, একুশকে বুকে নিয়ে একাত্তরের চেতনায় বলিয়ান হয়ে দেশে যারা অরাজকতা সৃষ্টি করছে তাদের বিরুদ্ধে রুখে দাড়াতে হবে। সোনার বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয়ে মাদকমুক্ত সমাজ গঠনে সকলকে হতে হবে সচেষ্ট। মায়ের ভাষা অক্ষুণ্ণ রাখতে যারা ঝরিয়েছিলো রক্ত তারা এ জাতীর অহঙ্কার এ জাতির গর্ব। বাংলার ওই শ্রেষ্ঠ সন্তানদের কখনো ভুলবে না এ জাতি। স্বাগত বক্তব্য রাখেন- অনির্বাণ থিয়েটারের সাধারণ সম্পাদক আনোয়ার হোসেন। আলোচনা শেষে প্রতিযোগীদের মধ্যে পুরস্কার তুলে দেন প্রধান অতিথি ও বিশেষ অতিথি। পুরস্কার বিতরণ শেষে সঙ্গীতানুষ্ঠান ও সবশেষে লাকি কুপণের ড্র’র মধ্যদিয়ে ৭ দিনব্যাপি একুশে মেলা সম্পন্ন করা হয়।