ঢাবিতে ভর্তি কেলেঙ্কারি : জায়িয়াতচক্রের সদস্যসহ গ্রেফতার ৩৮

 

পাঁচ ধাপে জালিয়াতি : সক্রিয় অন্তত ২০ গ্রুপ : শনাক্ত ৯

স্টাফ রিপোর্টার: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় জালিয়াতি হয় পাঁচটি ধাপে। এগুলো হলো ভর্তিচ্ছুদের সংগ্রহ, প্রশ্নপত্র ফাঁস, হল সেট-আপ (আসন ঠিক করা), সলভিং (উত্তর তৈরি করা) এবং ক্লিয়ার (উত্তর পাঠানো)। প্রশ্নপত্র ফাঁস করে মোবাইলফোনের মেসেজে সঠিক উত্তর সরবরাহ করার প্রতিটি ধাপে কাজ করে আলাদা গ্রুপ। উত্তর পাঠানোর জন্য আলাদা মোবাইলফোন ব্যবহার করে অসাধুচক্র। পরীক্ষার কেন্দ্র যেখানেই হোক না কেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলেই তৈরি হয় উত্তর। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কেন্দ্রিক অন্তত ২০টি গ্রুপ এ অপকর্মে সক্রিয়।

আরো জানা গেছে, একজন শিক্ষার্থীকে ভর্তির চুক্তি হচ্ছে দেড় লাখ থেকে চার লাখ টাকা পর্যন্ত। অবৈধ উপায়ে ভর্তির এ বাণিজ্যে জড়িয়ে পড়েছে কেন্দ্র পরিদর্শক শিক্ষক, ছাত্রলীগের নেতা, কেন্দ্রের পিয়ন, শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা।

গতকাল শুক্রবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘ ইউনিটের পরীক্ষার দিন উত্তর জালিয়াতচক্রের ২০ জনকে আটক করে র‌্যাব। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার শেষ দিনে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ আরো ১৮ জনকে আটক করে পুলিশে সোপর্দ করেছে। তাদের মধ্যে ১৭ জন পরীক্ষার্থী এবং একজন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। র‌্যাবের হাতে আটক চক্রে আছে বিভিন্ন পর্যায়ের ১২ জন, বাকি আটজন ভর্তিচ্ছু। তাদের কাছ থেকে অপকর্মে ব্যবহৃত ৩২টি মোবাইলফোন ও ৯৭ হাজার টাকা উদ্ধার করেছে র‌্যাব। আটকদের জিজ্ঞাসাবাদে বেরিয়ে এসেছে চাঞ্চল্যকর এসব তথ্য।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, ভর্তি পরীক্ষায় মোবাইলফোন ব্যবহার নিষিদ্ধ করার পর গতকাল সেট কোডও গোপন রাখা হয়। এরপরও থামেনি জালিয়াতি। সম্প্রতি তিন ইউনিটে পরীক্ষায় ২৪ জন এবং গতকাল ৩৮ জনকে গ্রেফতার করা হলেও ভর্তি পরীক্ষার জালিয়াতচক্র অধরাই থেকে গেছে। আটকদের জিজ্ঞাসাবাদে ৯টি বড় সিন্ডিকেটের নাম বেরিয়ে এসেছে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তদন্তের পরও তাদের আইনের আওতায় আনা যায়নি। জালিয়াতিতে ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের জড়িত থাকার অভিযোগ উঠেছে। তাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নিচ্ছে না বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। তবে সংশ্লিষ্টরা বলছে, অপকর্মের সাথে যারা জড়িত তাদের প্রত্যেককে আইনের আওতায় আনার চেষ্টা চলছে।

গতকাল পর্যন্ত র‌্যাবের হাতে আটক জালিয়াতচক্রের সদস্যরা হলো এফকেএম খালেদুর রহমান খালেদ, শুকুর আলী নীরব, শ্রীকান্ত ভদ্র, আবুল বাশার, মীর রেজওয়ান মাহমুদ তন্ময়, মোজাম্মেল হক লেলিন, মনিরুল ইসলাম, জামিল খান মিতুল, জুবায়ের আহম্মেদ, জসিম উদ্দীন, সুমন মিয়া ও কাজী শামীম হাবিব। পরীক্ষা শুরুর পর শেরে বাংলানগর বালক উচ্চ বিদ্যালয়ের কেন্দ্র থেকে র‌্যাব ভর্তিচ্ছু অরিত্র সিনহা, নূরুজ্জামান ও কাফির হাসানকে আটক করে। প্রায় একই সময় ধানমণ্ডির গভর্মেন্ট ল্যাবরেটরি হাই স্কুল কেন্দ্র থেকে আটক করা হয় সুব্রত, রাশেদ শেখ ও সবুজকে। এছাড়া মিরপুর আইডিয়াল ল্যাবরেটরি ইনস্টিটিউট কেন্দ্র থেকে শামীম শিকদার ও সঙ্গীতা দাসকে আটক করে র‌্যাব। তাদের সবার কাছেই মোবাইলফোন পাওয়া গেছে, যেগুলোতে এসএমএস’র মাধ্যমে উত্তর এসেছে।

র‌্যাব কর্মকর্তারা জানান, আটক ব্যক্তিদের মধ্যে আনোয়ারা বেগম স্কুল অ্যান্ড কলেজের প্রভাষক জুবায়ের আহম্মেদ পরীক্ষার হলের পরিদর্শক ছিলেন। আট চক্রটির অন্যতম হোতা মোজাম্মেল হক লেলিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক। চক্রের সমন্বয়কারী খালিদা একজন কম্পিউটার প্রকৌশলী।

এদিকে গতকাল পরীক্ষার কেন্দ্র থেকে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের হাতে আটক ১৭ জনকে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদ শেষে শাহবাগ থানায় সোপর্দ করা হয়েছে। তারা হলেন অগ্রণী স্কুল অ্যান্ড কলেজ কেন্দ্র থেকে বুলটি বালা, মেহেদী হাসান রানা, মেহেদী হাসান খান, কাকরাইলের উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুল অ্যান্ড কলেজ কেন্দ্র থেকে মেহেদী হাসান, কৌশিক ফারহান, আজিমপুর গার্লস স্কুল অ্যান্ড কলেজ কেন্দ্র থেকে খায়রে উম্মে সালমা, শারমিন আক্তার মিশু, বদরুন্নেসা মহিলা কলেজ কেন্দ্র থেকে আবিদ ইসলাম রিতন, শাহরুখ আলম, লালবাগ মডেল স্কুল কেন্দ্র থেকে ইমদাদুল ইসলাম, শেখ বোরহান উদ্দিন কলেজ কেন্দ্র থেকে রিয়াদ আরফিন, মতিঝিল মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজ কেন্দ্র থেকে ফৌজিয়া জামান নবনী, খিলগাঁও সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্র থেকে ফাতিমা বিনতে জাফর, মিরপুর বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ কেন্দ্র থেকে মেহেদী হাসান, টিকাটুলি সেন্ট্রাল মহিলা কলেজ কেন্দ্র থেকে ওমর ফারুক, সিদ্ধেশ্বরী গার্লস কলেজ কেন্দ্র থেকে রিহাদ হাসান রিফাত ও মোহাম্মদপুর সেন্ট্রাল কলেজ কেন্দ্র থেকে রনি হাসান। এছাড়া রাতে মুহসীন হলে অভিযান চালিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্যুরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট বিভাগের ইভিনিং এমবিএর ছাত্র সাব্বির আহমেদকে আটক করে থানায় সোপর্দ করা হয়েছে।

পাঁচ ধাপে জালিয়াতি: গতকাল বিকেলে র‌্যাব সদর দপ্তরে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে আট ভর্তিচ্ছুকে আটক এবং তাদের স্বীকারোক্তির একটি ভিডিও ফুটেজ দেখানো হয়। সংবাদ সম্মেলনে র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার মুফতি মাহমুদ খান বলেন, কয়েকটি ধাপে এ কাজ করে থাকে তারা। প্রথম গ্রুপটি সহজেই ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থী সংগ্রহ করে। তারা তাদের সাথে চুক্তি করে। এক্ষেত্রে দু লাখ থেকে চার লাখ টাকা পর্যন্ত চুক্তি হয়। দ্বিতীয় ধাপ হলো প্রশ্নপত্র সংগ্রহ করা। তৃতীয় ধাপ হলো যে কেন্দ্রে সিট বসবে সেই কেন্দ্রে কোন শিক্ষক দায়িত্ব পালন করবেন তা খুঁজে বের করা এবং আসন ঠিক করা। সর্বশেষ ধাপ হলো সলভ করা অর্থাৎ প্রশ্নের উত্তর বলে দেবে এমন ব্যক্তি।

মাহমুদ খান জানান, মূলত হল পরিদর্শকের সহায়তা নিয়েই জালিয়াতচক্রের সদস্যরা চুক্তি করা শিক্ষার্থীদের মোবাইলফোন নিয়েই হলে প্রবেশ করায়। এরপর হলে পরিদর্শকের সহায়তায় চুক্তির সেই ছাত্রের প্রশ্নপত্রের কপি এবং সেট বাইরে জানিয়ে দেয়। বাইরে থেকে সেই সময় এক্সপার্টদের সহায়তায় তারা প্রশ্নের উত্তরগুলো মোবাইলফোনে এসএমএস’র মাধ্যমে পরীক্ষার্থীর কাছে পাঠানো হয়।

র‌্যাব কর্মকর্তারা জানান, গোয়েন্দা নজরদারির মাধ্যমে গত বৃহস্পতিবার রাতে আগারগাঁওয়ের চীন মৈত্রী সম্মেলন কেন্দ্রের সামনে থেকে খালিদ ও ছাত্রলীগ নেতা লেলিনকে আটকের পর পুরো চক্রটিকে আটক করে র‌্যাব। অভিযানের কারণে গতকালের পরীক্ষায় জালিয়াতি পুরোটাই বন্ধ করা গেছে বলে র‌্যাবের দাবি।

জিজ্ঞাসাবাদে জানা গেছে, শেখ বোরহান উদ্দিন কলেজের সমাজকর্ম বিভাগের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র মিতুলের কাজ ছিলো প্রশ্নটি পরীক্ষার কেন্দ্র থেকে বের করা। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র নিরবের কাজ অভিজ্ঞতাসম্পন্ন ব্যক্তিদের দিয়ে প্রশ্নপত্র দ্রুত সমাধান করা। কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কম্পিউটার সায়েন্সে অনার্স করা এবং পরে গার্মেন্ট সামগ্রীর ব্যবসায়ী খালেদ সমাধানগুলো দ্রুত পরীক্ষার্থীদের কাছে এসএমএসের মাধ্যমে পাঠিয়ে দেন। এ ছাড়া খালেদ পরীক্ষার কেন্দ্রে নিজেদের পরীক্ষার্থীদের সুবিধাজনক অবস্থানে সিট ফেলা বা সেটআপের কাজ করে। নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির বিবিএ তৃতীয় বর্ষের ছাত্র শ্রীকান্ত ভদ্র পরীক্ষার্থীদের যাবতীয় বিষয় রেজিস্টারে লিপিবদ্ধ করে রাখেন। পুরান ঢাকার আনোয়ারা বেগম স্কুল অ্যান্ড কলেজের সমাজকল্যাণ বিভাগের প্রভাষক জুবায়ের পরীক্ষার হলে নিজেদের পরীক্ষার্থীদের মোবাইলফোন ব্যবহার করাসহ অন্যান্য সুবিধা প্রদান করে থাকেন। ছাত্রলীগ নেতা এবং সোনালী ব্যাংকের সদরঘাট শাখার সিনিয়র অফিসার লেলিন চক্রটিকে নিরাপত্তা দিয়ে চুক্তি সম্পন্ন করেন। এছাড়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামী ইতিহাস বিভাগের দ্বিতীয়বর্ষের ছাত্র তন্ময়, সাবেক ছাত্র আবুল বাশার, শেখ বোরহান উদ্দিন কলেজের সমাজকর্ম বিভাগের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র জামিল, বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্যুরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট বিভাগের প্রথম বর্ষের ছাত্র সুমন মিয়া, ঢাকা ক্লাবের কর্মকর্তা শামীম আকতার, সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজের ছাত্র রাহুল বিশ্বাসও ছাত্র সংগ্রহ করেন।

দু শতাধিক ভর্তির চুক্তি: অভিযানকালে র‌্যাব কর্মকর্তারা খালিদ, লেলিন ও শ্রীকান্তর কাছ থেকে একটি খাতা জব্দ করেছেন। এ খাতায় দু শতাধিক ভর্তিচ্ছুর তালিকা আছে, যেখানে পরীক্ষার্থীদের নাম, রোল নম্বর, সেন্টারের নাম, কক্ষ নম্বর, মোবাইল ফোন নম্বর ও কার রেফারেন্সে এসেছে তা উল্লেখ করা আছে। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদের পর র‌্যাব কর্মকর্তারা বলছেন, শ্রীকান্ত এ তালিকাটি সংরক্ষণ করেছেন। তবে চুক্তি করেছেন বেশি খালিদ ও লেলিন। খাতায় থাকা মোবাইলফোন নম্বরগুলো থেকেই উত্তর পাঠানোর কথা ছিলো। একদিনই ব্যবহার করা হতো এ সিমকার্ড।

শিক্ষক জুবায়ের দাবি করেছেন, তিনি গ ইউনিটের পরীক্ষার সময় কেন্দ্রে পরিদর্শক ছিলেন। তখন তিনি মাত্র পাঁচ হাজার টাকার বিনিময়ে মোবাইলফোনে নকলে সহায়তা করেছেন এক ছাত্রকে। গতকালের পরীক্ষার জন্যও তিনি চুক্তিবদ্ধ হন। মিতুল জানান, জুবায়েরের বড় ভাই ও আনোয়ারা স্কুল অ্যান্ড কলেজের ব্যবস্থাপনা কমিটির সদস্য আব্দুল আউয়াল মানিকও ছাত্র সংগ্রহ করেন। ছাত্রলীগ নেতা লেলিন জিজ্ঞাসাবাদে জানিয়েছেন, জাকির  নামে এক বড় ভাইয়ের মাধ্যমে তিনি কিছু ছাত্রের সঙ্গে চুক্তি করেছিলেন। গত বছরও তিনি দু-একজনের সঙ্গে চুক্তি করেছেন।

৯টি গ্রুপ শনাক্ত: খালিদ জিজ্ঞাসাবাদে জানিয়েছেন, তিনি ফার্মগেট এলাকায় গত বছর আলমগীর নামের একজনের সাথে পরিচিত হন, যার মাধ্যমে তিনজনকে ভর্তি করান। এর বিনিময়ে ৯৫ হাজার টাকাও পান তিনি। প্রতিটি ছাত্র ভর্তির জন্য গড়ে দেড় লাখ টাকায় চুক্তি হয়। এবার তিনি লেলিন, মিতুল, শ্রীকান্তসহ কয়েকজনের সাথে আলাদা হয়ে কাজ করতে চেয়েছেন। গ ইউনিটের পরীক্ষার দিন দেরিতে প্রশ্নপত্র বের হওয়ায় অন্তত তিন লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে খালিদের। এ ক্ষতি পুষিয়ে নিতে গতকাল ১৮টি কেন্দ্রের হল সেটআপ দেন খালিদ। তাঁর ভাষ্য মতে, এসব কেন্দ্রের পিয়নদের সাথে আলাপ করেছেন তিনি। পরীক্ষার আগে গড়ে পাঁচ হাজার টাকা করে দিয়ে চুক্তি করা শিক্ষার্থীর আসন পেছনের দিকে ফেলার কথা ছিলো। তবে র‌্যাবের অভিযানে ভেস্তে গেছে সবই।

খালিদ দাবি করেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় অন্তত ২০টি গ্রুপ প্রশ্নপত্র ফাঁসসহ পরীক্ষায় জালিয়াতির মাধ্যমে ভর্তি বাণিজ্যে জড়িত। এদের মধ্যে আসাদুজ্জামান জুয়েল, আলমগীর, রাসেল, দেবাশীষ নামে চারজন চারটি গ্রুপের হোতা। বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হল, শহীদুল্লাহ হল, জহুরুল হক হলসহ কয়েকটি হলেই ফাঁস হওয়া প্রশ্নপত্রের উত্তর তৈরি করে চক্রগুলো।