ঢাকার শহীদ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে মহাসমাবেশে খালেদা জিয়া

আলোচনার উদ্যোগ না নিলে কাল থেকে তিনদিন হরতাল

 

স্টাফ রিপোর্টার: নির্বাচনকালীন নির্দলীয় সরকারের দাবিতে আলোচনার জন্য সরকারকে একদিন সময় দিয়েছেন বিএনপি চেয়ারপারসন বিরোধীদলীয় নেতা বেগম খালেদা জিয়া। এ সময়ের মধ্যে সরকার আলোচনার উদ্যোগ না নিলে আগামীকাল রোববার সকাল ৬টা থেকে টানা ৬০ ঘণ্টার হরতালের ঘোষণা দিয়েছেন তিনি।

খালেদা জিয়া বলেছেন, সরকার আলোচনার ব্যবস্থা না করলে আমাদেরকে শেষ কর্মসূচিতে চলে যেতে হবে। তাতে দেশের সর্বস্তরের মানুষকে রাজপথে নামার আহ্বান জানাচ্ছি। সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বলছি অবৈধ সরকারের নির্দেশ মানবেন না। পুলিশকে বলবো এখন আর সরকারের কর্মীর মতো আচরণ করবেন না। নির্বাচন ছাড়া কোনো পথ নেই। আমাদের ফর্মুলা গ্রহণ করে সংবিধান সামান্য সংশোধন করে হলেও সবার অংশগ্রহণে সুষ্ঠু নির্বাচনের ব্যবস্থা করুন। নেতা-কর্মীদের গুম করার জন্য কী বাহিনী করা হয়েছে, সে বাহিনীতে কারা রয়েছেন, তারা কোন গাড়ি ব্যবহার করে লোকদের তুলে নেয় আমাদের কাছে সকল তথ্য রয়েছে।

বিএনপি নেতৃত্বাধীন ১৮ দলীয় জোটের পক্ষ থেকে প্রস্তাবিত নির্বাচনকালীন সরকারের ফর্মুলা নিয়ে আলোচনার উদ্যোগ নেয়ার জন্য সরকারকে দু’দিনের সময় বেধে দিয়েছেন বিরোধীদলীয় নেতা বেগম খালেদা জিয়া। তিনি বলেছেন, আজ ও আগামীকালের মধ্যে (গতকাল শুক্রবার ও আজ শনিবার) সরকার আলোচনার উদ্যোগ না নিলে আগামীকাল ২৭ অক্টোবর রোববার ভোর ৬টা থেকে ২৯ অক্টোবর মঙ্গলবার সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত সারাদেশে বিরতিহীন সর্বাত্মক হরতাল পালিত হবে। এটা প্রাথমিক কর্মসূচি দিলাম। আশা করি এ সময়ের মধ্যে সরকারের শুভ বুদ্ধির উদয় হবে। সরকার যদি আলোচনার ব্যবস্থা করে তাহলে আলোচনা ও আন্দোলন পাশাপাশি চলবে। তিনি বলেন, এরপরেও কাজ না হলে আমাদের শেষ কর্মসূচিতে চলে যেতে হবে। তখন আরো কঠিন কর্মসূচি দেবো। সে কর্মসূচি সফল করার জন্য আমি মা-ভাই-বোন, মুরুব্বি, তরুণ ও যুবসমাজসহ দেশের জনগণকে রাজপথে নেমে আসার আহ্বান জানাচ্ছি। আওয়ামী লীগকে হটাতে সবাইকে একযোগে এগিয়ে আসতে হবে। ইনশাআল্লাহ্, বিজয় আমাদের সুনিশ্চিত। নির্দলীয় সরকারের অধীনে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দাবিতে গতকাল শুক্রবার রাজধানীর ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ১৮ দল আয়োজিত গণসমাবেশে তিনি হরতাল কর্মসূচি ঘোষণা করে এই আহ্বান জানান।

বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া বলেন, ২৭ অক্টোবরের পর থেকে এ সরকার অবৈধ। এ সরকারের তখন থেকে আর কোনো সাংবিধানিক বৈধতা থাকবে না। দেশে শান্তি ফিরিয়ে আনতে হলে এ অবৈধ সরকারকে হটাতে হবে। সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের উদ্দেশে তিনি বলেন, ২৭ অক্টোবরের পর আপনারা এ অবৈধ সরকারের আর কোনো আদেশ-নির্দেশ মানবেন না। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর উদ্দেশে তিনি বলেন, পুলিশ, ৱ্যাব ও বিজিবি’র বিরুদ্ধে আমাদের কোনো অভিযোগ নেই, এতোদিন আপনারা যা করেছেন মেনে নিয়েছি। তবে এখন থেকে আর সরকারের অবৈধ নির্দেশ মানবেন না। আপনাদের শুধু বলবো-দেশকে ভালোবাসুন। আপনাদের ছেলে-মেয়েরাও এদেশে থাকবে। কাজেই দেশের প্রতি আপনাদেরও দায়িত্ব রয়েছে। আপনারা আর এ সরকারের কর্মীর মতো আচরণ করবেন না। আমাদের নেতা-কর্মীদের অন্যায়ভাবে গ্রেফতার করবেন না, তাদের গুলি করবেন না, নিজেরা জ্বালাও-পোড়াও করে অন্যের ওপর দোষ চাপাবেন না। সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর উদ্দেশে বিরোধী দলীয় নেতা আরো বলেন, আপনারা প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী। আওয়ামী লীগ বলে বেড়ায় আমরা ক্ষমতায় গেলে নাকি আপনাদের বিদায় করে দেবো। এটা ভুল কথা। আমরা কাউকে বিদায় করবো না। আপনারা ভালো কাজ করুন। আমরা মেধা ও যোগ্যতার মূল্যায়ন করবো।

নির্বাচন কমিশনকে (ইসি) সতর্ক করে দিয়ে তিনি বলেন, নির্বাচন কমিশনকে বলে দিতে চাই একটি দলের সুবিধা করার জন্য আপনারা আরপিও সংশোধন করবেন না। একদলীয় নির্বাচন বন্ধ করুন। সব দলের অংশগ্রহণ ছাড়া এদেশে কোনো নির্বাচন হবে না। আপনারা বাড়াবাড়ি করলে ফল শুভ হবে না। তখন আপনাদেরও জনগণের কাছে জবাবদিহি করতে হবে। কাজেই আপনাদের বলবো সবদলের অংশগ্রহণে অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের ব্যবস্থা করুন। সরকারের উদ্দেশে বিএনপি চেয়ারপারসন বলেন- অনেক করেছেন, অনেক হয়েছে। সংবিধানের দোহায় দিয়ে লাভ নেই। শেখ হাসিনার অধীনে এদেশে কোনো নির্বাচন হবে না, জনগণ তাকে অনেক আগেই প্রত্যাখ্যান করেছে। আমরা নির্বাচন চাই, শান্তি চাই, গণতন্ত্র চাই। নির্বাচন ছাড়া আর কোনো পথ নেই। নির্দলীয় সরকারের অধীনে সবার জন্য সমান সুযোগ তৈরি করে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের ব্যবস্থা করুন। সে জন্য দ্রুত আলোচনার ব্যবস্থা করুন। না হলে সবাই যে আলোচনার কথা বলছে তা অর্থহীন হয়ে যাবে। আমরা আপনাদের বন্ধু হিসেবে বলছি, আমরা যে ফর্মুলা দিয়েছি তা গ্রহণ করতে হবে। এজন্য সংবিধান সংশোধন করতে হলেও সামান্য করতে হবে। আপনাদের কথা অনুযায়ী আমরা সংসদেও প্রস্তাব তুলে ধরেছি। আমার দলের মহাসচিব আপনাদের কাছে চিঠি দিয়েছেন। আপনারা পুলিশ, ৱ্যাব ও বিজিবি দিয়ে একতরফা নির্বাচন করতে চান। কিন্তু তা করতে দেয়া হবে না। দাবি না মানলে পরিণতি হবে ভয়াবহ। তখন দেশে কোনো বিশৃঙ্খলা হলে এর দায় আপনাদেরই নিতে হবে।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে উদ্দেশ্য করে খালেদা জিয়া বলেন, এখনও সময় আছে সোজা পথে আসুন। তা না হলে আপনি যে গর্ত খুঁড়ছেন, সে গর্তে আপনিই পড়বেন। আমাদের সাথে জনগণ রয়েছে, আমরা বেরিয়ে যাবো, গর্তে পড়বো না। আপনি যদি মনে করেন অনেক কাজ করেছেন, তাহলে জনপ্রিয়তা যাচাইয়ে নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন দিন। কিন্তু সেই সাহস আপনার নেই।  প্রধানমন্ত্রীর উদ্দেশে তিনি আরো বলেন, আপনার মুখে জনগণ ও গণতন্ত্রের কথা শোভা পায় না। কার্যকলাপের মাধ্যমে আপনিই সবসময় অসাংবিধানিক সরকার ডেকে আনেন। আপনারা সবসময় বলেন যে, বিএনপি নাকি গণতন্ত্র ধ্বংস করে। আমরা নয়, আপনারাই বারবার গণতন্ত্র ধ্বংস করেছেন। আপনি অতীতে সবসময়ই অবৈধ ও অসাংবিধানিক সরকারকে স্বাগত জানিয়েছেন। এরশাদ যখন ক্ষমতা নেয় তখন আপনিই বলেছিলেন “আই অ্যাম নট আনহ্যাপি”। মইন-ফখরুদ্দীনের শপথ অনুষ্ঠানে গিয়ে আপনি তাদের দায়িত্ব নেন, তখন বলেছিলেন, এটা আমাদের আন্দোলনের ফসল। পিলখানা হত্যাকাণ্ডের সাথে আপনার লোকজন জড়িত। সে জন্য তাদের বিচার হওয়া উচিত।

বিরোধীদলীয় নেতা বলেন, পাঁচ বছর আমরা অনেক ধৈর্য ধরেছি। শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি পালন করেছি। তারপরেও সরকার আমাদের ওপর অনেক নির্যাতন ও জুলুম চালিয়েছে। দেশে আজ গণতন্ত্র নেই, আইনের শাসন নেই, মানবাধিকার ও মৌলিক অধিকার বলতে কিছু নেই। আজ আমরা পরাধীনতার শৃঙ্খলে আবদ্ধ। এ সরকার জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। তারা এখন জনগণকে ভয় পায়। এ কারণে তারা জনগণের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। মানুষের ভোটের অধিকার ছিনতাই করার অপচেষ্টা করছে। দেশের বিভিন্ন স্থানে ১৪৪ ধারা জারি করে, সভা-সমাবেশে বাধা দিয়ে সরকারই সারাদেশ অবরুদ্ধ করে ফেলেছে। বিএনপি-জামায়াতের কার্যালয় অবরুদ্ধ করে রেখেছে। খালেদা জিয়া সমাবেশে আসেন বিকেল ৪টার দিকে। ৪টা ৪০ মিনিট থেকে বিকেল ৫টা ১০ মিনিট পর্যন্ত তিনি বক্তব্য রাখেন। গুমের তথ্য আছে খালেদা জিয়া বলেন, এ সরকার বহু মানুষকে খুন ও গুম করেছে। গুম করার জন্য কী বাহিনী করা হয়েছে, সে বাহিনীর নাম আমরা জানি। ওই বাহিনীতে কারা কারা কাজ করছে তাও জানা আছে। তারা কি কি গাড়ি ব্যবহার করে, কোন কোন গাড়িতে তারা ঘুরে লোকদের তুলে নেয় সব তথ্য আমাদের কাছে আছে।

অন্য নেতারা যা বললেন, ঢাকা মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক সাদেক হোসেন খোকার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এ সমাবেশে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, বর্তমান সরকারের ক্ষমতায় থাকার আর কোনো নৈতিক অধিকার নেই। পাঁচ বছর এ সরকার আমাদের ওপর নির্যাতন-নিপীড়ন চালিয়েছে। এখন তারা জনগণের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। প্রায় সারাদেশে ১৪৪ ধারা জারি করেছে। গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমেই এ সরকারের পতন ঘটবে। জামায়াতের ভারপ্রাপ্ত আমির মকবুল আহমদ সরকারের উদ্দেশে বলেন, মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের নামে রাজনৈতিক প্রহসন করা হচ্ছে। অবিলম্বে এ ট্রাইব্যুনাল বন্ধ করুন, আমাদের নেতাদের মুক্তি দিন। নির্দলীয় সরকারের দাবি মেনে নিয়ে পদত্যাগ করুন। খালেদা জিয়া যে কর্মসূচি দেবেন আমরা জানপ্রাণ দিয়ে তা বাস্তবায়ন করবো। এলডিপি সভাপতি ড. কর্নেল অলি আহমদ (অব.) বলেন, শেখ হাসিনাকে চিরদিন ক্ষমতায় রাখার জন্য এ সরকার সংবিধান সংশোধন করেছে। কিন্তু সরকারকে বলবো- সময় নির্ধারিত, বেশি সময় নেই, কীভাবে বিদায় নেবেন তা ভেবে দেখুন। বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি (বিজেপি) চেয়ারম্যান ব্যারিস্টার আন্দালিভ রহমান পার্থ বলেন, আজ সরকারের মন খারাপ। কারণ সরকারের বিদায় ঘণ্টা বেজে গেছে। আরো চারবার এ সরকারের মন খারাপ হবে। যেদিন তত্ত্বাবধায়কের দাবি পূরণ হবে, যেদিন তারেক রহমান দেশে ফিরবেন, যেদিন খালেদা জিয়া প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেবেন এবং যেদিন হেফাজতে ইসলামের ওপর চালানো দেড় লাখ গুলির বিচার হবে-সেদিন। কল্যাণ পার্টি চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব.) সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম বলেন, আগামীকাল রোববার সকাল থেকে শেখ হাসিনার বিদায় ক্ষণ শুরু হবে। জাগপা সভাপতি শফিউল আলম প্রধান বলেন, এ মুহূর্ত থেকে সরকার অবৈধ। তাই শেখ হাসিনাকে আর মানি না। বর্তমানে আমাদের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধানমন্ত্রী হচ্ছেন খালেদা জিয়া। এনপিপি চেয়ারম্যান শেখ শওকত হোসেন নিলু বলেন, শেখ হাসিনা প্রতিদিন বিটিভিতে মিথ্যাচার করছেন। বিএনপি-জামায়াত-হেফাজত নয়, কোরআন পুড়িয়েছে আওয়ামী লীগ। বন্ধ হওয়া দিগন্ত টিভি ও ইসলামিক টিভির কাছে সে ফুটেজ আছে। সভাপতির বক্তব্যে সাদেক হোসেন খোকা বলেন, প্রধানমন্ত্রী ও এ সরকারের মন্ত্রীরা শুধু সংবিধান-সংবিধান করছেন। এটাকে যেভাবে তারা কাটাছেঁড়া করেছেন সেটি আর সংবিধান নেই। এটা এখন একটি তেজপাতার সংবিধান। বিরোধীদলীয় চিফ হুইপ জয়নুল আবদিন ফারুক ও ঢাকা মহানগর বিএনপির সদস্য সচিব আব্দুস সালামের পরিচালনায় সমাবেশে অন্যদের মধ্যে বক্তব্য রাখেন- ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম মিয়া, হান্নান শাহ, ড. আব্দুল মঈন খান, মির্জা আব্বাস, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন, আব্দুল লতিফ নেজামী, গোলাম মোর্তুজা ও শাহাদাত হোসেন সেলিম প্রমুখ।