ডেডলাইন ২৫ অক্টোবর- উত্তাপ বাড়ছে প্রতি মুহূর্তে

 

image_49836_0মাথাভাঙ্গা অনলাইন : দেশে এখন এক আতঙ্কের ডেটলাইন ২৫ অক্টোবর। ওই দিন সরকারি ও বিরোধী দল রাজধানীতে মহাসমাবেশের ডাক দিয়েই থেমে নেই; প্রতিদিনই চলছে পরস্পর পাল্টাপাল্টি হুমকি। সরকারি ও বিরোধী দলের আক্রমণাত্মক বক্তব্য প্রতি মুহূর্তে উত্তাপ ছড়াচ্ছে দেশজুড়ে।

সরকার দাবি করছে, তারা গোয়েন্দাতথ্যের মাধ্যমে জানতে পেরেছে, ২৫ অক্টোবর থেকে বিরোধী দলের আন্দোলন সহিংস রূপ নিতে পারে, এমনকি ঢাকার বিভিন্ন স্থানে লাগাতার অবস্থান নিতে পারে তারা। তাই সরকার এ ব্যাপারে ঝুঁকি নেবে না। ২৫ অক্টোবর বিএনপিকে সমাবেশ করতে দেয়া হবে কি না, তা নিয়ে ভাবছে তারা। তবে এখন পর্যন্ত সরকার কঠোর অবস্থানে আছে বলে জানান দলের একাধিক জ্যেষ্ঠ নেতা।

অন্যদিকে, ২৫ অক্টোবর যেকোনো মূল্যে সমাবেশ সফল করতে সারা দেশে থেকে নেতা-কর্মীদের ঢাকায় আসার প্রস্তুতি চলছে। এতে বাধা দিলে ১৮ দল কঠোর কর্মসূচির দিকে যাবে। বিএনপির নেতারা নতুন বার্তা ডটকমকে বলেছেন, এত দিন যেভাবে তাদের কর্মসূচি অহিংসভাবে চলে এসেছে, আন্দোলন কর্মসূচি সে রকম অহিংসই থাকবে। তবে তা আগের চেয়ে বহুগুণ বেশি জোরালো হবে। তাদের আন্দোলনের গতি-প্রকৃতি সরকারের আচরণের ওপর নির্ভর করবে।

বেশ কয়েক মাস ধরেই আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু এই ২৫ অক্টোবর। বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও পরে স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী ২৪ অক্টোবর পর্যন্ত সংসদ চলবে বলে ঘোষণা দেয়ার পর তা বিপুলভাবে আলোচনায় আসে। সংবিধানমতে ২৪ অক্টোবরের পর পরবর্তী নির্বাচনের ক্ষণগণনার সময়। বিরোধী দলের দাবি, ২৪ অক্টোবরের পর সরকারের বৈধতা আর প্রশ্নের বাইরে থাকবে না। এরপর সরকার গণ্য হবে অন্তর্বর্তী হিসেবে। তবে সরকার বলছে, বিরোধী দলের এসব দাবি সংবিধান সমর্থন করে না।

এরই প্রেক্ষাপটে ২৪ অক্টোবরের পরের পরিস্থিতিতে পরস্পরকে মোকাবিলার জন্য জোরেশোরে প্রস্তুতি নিচ্ছে দুই পক্ষ। এই মোকাবিলা কোনো গণতান্ত্রিক রীতিনীতি মেনে হবে না বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে বিভিন্ন মহল থেকে। সরকারি ও বিরোধী দলের নেতাদের মুখেও এই আশঙ্কা ব্যক্ত হয়েছে বহুবার। কিন্তু এর মধ্যেই দুই দলের নেতাদের মধ্যে পরস্পরকে ঘায়েল করার দামামা বেজে চলেছে অবিরত।

ইতিমধ্যে বিএনপির চলমান বিভাগীয় জনসভাগুলো থেকে ঘোষণা করা হয়েছে, ২৪ অক্টোবরের পর দেশ চলবে বেগম খালেদা জিয়ার নির্দেশে। ক্ষমতায় থাকতে দেয়া হবে না শেখ হাসিনাকে । ২৫ অক্টোবরের মহাসমাবেশে সরকার বাড়াবাড়ি করলে টানা হরতালসহ অবরোধের মতো কর্মসূচির ঘোষণা আসতে পারে বিরোধী দলের পক্ষ থেকে। তাদের লক্ষ্য থাকবে রাজধানী ঢাকাকে সারা দেশ থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলা। আর এর প্রস্তুতি হিসেবে বিভিন্ন বিভাগীয় শহরে ধারাবাহিক সমাবেশের কর্মসূচি পালন করছে ১৮ দলীয় জোট।

বিরোধী দলের এই হুংকার সরকারি দল খুব একটা গুরুত্ব দিচ্ছে না। বরং শেখ হাসিনার অধীনেই আগামী নির্বাচন হবে এবং পরবর্তী সরকার না আসা পর্যন্ত তিনি প্রধানমন্ত্রী পদে বহাল থাকবেন, এই ছকমতোই এগোচ্ছে আওয়ামী লীগ। সম্প্রতি দলের মহানগর কমিটির সভায় রাজপথ নিজেদের দখলে রাখবে বলেও ঘোষণা দিয়েছে তারা। ১৩ অক্টোবর রোববার দলের কার্যনির্বাহী কমিটির সভায়ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা হুঁশিয়ার করে দিয়েছেন, বিরোধী দল জনগণের জানমাল নিয়ে ছিনিমিনি খেললে তা মোকাবিলার দায়িত্ব সরকারের। তার জন্য যা যা করণীয় সরকার তা  করবে।

বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের দমন-পীড়নের জন্য সরকার পুলিশের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তার নেতৃত্বে টর্চার স্কোয়াড গঠন করেছে, যেখানে আওয়ামী লীগের বাছাই করা নেতা-কর্মীরা থাকবেন। রোববারই এমন  অভিযোগ তুলেছে বিএনপি।  ইতিমধ্যে দেশের বিভিন্ন জায়গায় দলের নেতা-কর্মীদের গ্রেপ্তারের জন্য পুলিশ অভিযান চালাচ্ছে বলেও অভিযোগ করেছেন দলের যুগ্ম সম্পাদক রুহুল কবির রিজভী।

এরই প্রেক্ষাপটে সোমবার ঢাকা মহানগরের এক যৌথ সভায় মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক সাদেক হোসেন খোকা সরকারি দলের যেকোনো আক্রমণ প্রতিহত করতে প্রয়োজনে দা-কুড়াল নিয়ে প্রস্তুত থাকতে নির্দেশ দিয়েছেন দলের নেতা-কর্মীদের। এই বক্তব্যের পর রাতেই খোকার গুলশানের বাসায় এবং পরদিন গোপীবাগের বাসায় অভিযান চালায় পুলিশ।

দেশে সরকার ও বিরোধী দলের এই যুদ্ধংদেহী মূর্তি আতঙ্কগ্রস্ত করে তুলেছে সাধারণ মানুষকে। সরকারের নানা পদক্ষেপ আর বিরোধী দলের হুঁশিয়ারি প্রতি মুহূর্তে উত্তাপ ছড়াচ্ছে। কী হবে ২৪ অক্টোবরের পর, এমন অজানা ভয় ঘিরে আছে দেশজুড়ে।

সুশীল সমাজের লোকজন বলছেন, দেশ অবধারিত সংঘাতের দিকেই যাচ্ছে। ২৪ অক্টোবরের পর এই সংঘাত অনিবার্য হয়ে উঠবে বলে তাদের আশঙ্কা। প্রধানমন্ত্রীর নতুন ঘোষণা অনুযায়ী  ২৪ অক্টোবরের পরও সংসদ চললে আরো কিছুদিন সংসদে সমঝোতার সুযোগ থাকছে বটে, কিন্তু সরকারের অবস্থান এখনো পরিষ্কার না হওয়ায় তাদের মধ্যে দ্বিধা থেকেই যাচ্ছে।

জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান এরশাদও যেমন বলেছেন, সরকারের আচরণ ও বক্তব্যে বাকশালের গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। ২৫ অক্টোবরের পর দেশে সংঘাত অনিবার্য বলে তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন।

এটা ঠিক যে, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পক্ষে বিপুল জনমত থাকা সত্ত্বেও বিরোধী দল গত দেড় বছরে তেমন কোনো জোরালো আন্দোলন গড়ে তুলতে পারেনি। এমনকি শেয়ারবাজার, পদ্মা সেতু, সোনালী ব্যাংকের অর্থ লুটসহ নানা জনস্বার্থ ক্ষতিকর কেলেঙ্কারি দেশের মানুষকে সরকারের প্রতি বিরক্ত করে তুললেও বিরোধী দল এ নিয়ে তাদের আন্দোলনে জনসম্পৃক্ততা বাড়াতে পারেনি। এমনকি নিজেদের নেতা-কর্মীদেরও গা বাঁচিয়ে চলতে দেখা গেছে।  এখন এই স্বল্প সময়ে তারা আন্দোলন বেগবান করতে পারবে না বলে মনে করেন অনেকে।

কিন্তু রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, সরকারের এই শেষ সময়ে আন্দোলন আর আগের মতো থাকবে না। প্রশাসনও নড়েচড়ে বসবে এই ‘ট্রানজিশনাল পিরিয়ডে”। এটা শুধু এই সরকারের আমলে নয়, সব সরকারের সময়ই এমনটা দেখা যায়। সরকারের শেষ সময়ে সরকারি দলের লোকজন নিজেদের বাঁচিয়ে চলে, আর বিরোধী দলের লোকজন মরিয়া হয়ে রাস্তায় নেমে আসে। জনসম্পৃক্ততাও এই সময়ে দ্রুত বৃদ্ধি পায়।

তাদের আশঙ্কা, এবারের আন্দোলন সর্বাত্মক হওয়ার পেছনে জামায়াতসহ কিছু ইসলামী দলের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকবে। হেফাজতে ইসলামও অঘোষিতভাবে আন্দোলনে রসদ জোগাতে পারে। এমনকি আশঙ্কা করা হচ্ছে, এই রাজনৈতিক অস্থিতিশীল পরিস্থিতির সুযোগে সক্রিয় হয়ে উঠতে পারে আন্ডারগ্রাউন্ড চক্রগুলো। দেশে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটাতে পারে তারা।

ঢাকা মহানগর পুলিশের ঊর্ধ্বতন একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, এখন সরকারি দলের লোকজনের আদেশ-নির্দেশ-তদবির একটু কমে এসেছে। পুলিশ প্রশাসনে সরকারপন্থী-বিরোধীপন্থী, সুবিধাপ্রাপ্ত-সুবিধাবঞ্চিত, দাপটখাটানো আর কোণঠাসা এমন নানা বিভাজন এখন স্পষ্ট হচ্ছে। এখন অনেকের মধ্যে বাতাস বোঝার পালা চলছে। এমনকি এই সরকারের সুবিধাভোগীরাও নিজেদের নিয়ে নতুন করে ভাবছেন। তবে আওয়ামী লীগপন্থী বলে পরিচিত কর্মকর্তা আর সদস্যদের মধ্যে পুরো সক্রিয়তা অটুট আছে। সামনের দিনগুলোতে রাজনৈতিক ক্ষেত্রে সামগ্রিকভাবে পুরো পুলিশ বাহিনী আগের মতো ‘সক্রিয়’ থাকবে বলে মনে করেন না তিনি।

২৫ অক্টোবরের পরের অবস্থা নিয়ে অনিশ্চয়তা আর উদ্বেগ এখন দেশের সব স্তরের মানুষের মধ্যে। উত্তরার একজন পোশাক কারখানার মালিক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, “নানা কারণে বিদেশী ক্রেতাদের কাছে দেশের ভাবমূর্তি এই মুহূর্তে তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে। রাজনৈতিক পরিস্থিতি যেভাবে উত্তপ্ত হচ্ছে, তাতে পোশাকশিল্পে ধস নেমে আসার বিপদ গুনছি।” একই সঙ্গে নিরাপদ জীবনযাপনের বিষয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করে তিনি বলেন, সরকারের আরো নমনীয় হওয়া উচিত।

একটি  বেসরকারি ব্যাংকের কর্মকর্তা শাহীনূর। হরতাল-অবরোধ বা যেকোনো পরিস্থিতিই থাক, অফিসে তাকে যেতেই হয় জানিয়ে বলেন, “হরতাল অবরোধ মানে সহিংসতা। এই জীবনে আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জামায়াতের  এসব কর্মকাণ্ড তো কম দেখিনি। চোখের সামনে বোমার আঘাতে নীরিহ পথচারীর লুটিয়ে পড়তে দেখেছি, রক্তাক্ত হতে দেখেছি। এসব মনে পড়লে গা শিউরে ওঠে। তখন ভাবি আমিও তো কোনোদিন এমন পরিস্থিতির শিকার হতে পারি।” তিনি বলেন, “২৪ অক্টোবরের পর আসলে কী ঘটবে? হয়তো কিছুই ঘটবে না। আবার হয়তো ভাবনার চেয়েও বড় কিছু ঘটতে পারে। তাই এক ধরনের অজানা ভয় আছি।”

রাজধানীর খিলক্ষেতে থাকেন একটি বেসরকারি কলেজের শিক্ষক আবদুর রহমান। তার দুই ছেলের একজন পড়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে, অন্যজন তিতুমীর কলেজে। তিনি চিন্তিত তাদের পড়াশোনা আর নিরাপত্তা নিয়ে। ছেলে বলেই দুর্ভাবনা বেশি তার। দেশে সংঘাতময় পরিস্থিতির সৃষ্টি হলে, আর তা দীর্ঘায়িত হলে কত দিন ঘরে আটকে রাখতে পারবেন তাদের।

২৫ অক্টোবর নিয়ে মানুষের এই উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার বিষয়ে জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য এম কে আনোয়ার বলেন, “আমি মনে করি না ২৫ অক্টোবর নিয়ে উদ্বেগের কিছু আছে। আমরা আগে যেমন নিয়মতান্ত্রিক ও অহিংস আন্দোলন করেছি, সামনেও তা-ই হবে। তবে সরকার আমাদের কর্মসূচিতে বাধা দিলে কিংবা গণতান্ত্রিক আন্দোলন করতে না দিলে তার প্রতিবাদ তো হবেই।”

বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা শামসুজ্জামান দুদু বলেন, “সরকারের দমন-পীড়ন, অগণতান্ত্রিকে আচরণে আমাদের পিঠ দেয়ালে ঠেকে গেছে। ২৫ অক্টোবরে সমাবেশে বাধা দিলে কিংবা সমাবেশ করতে না দিলে আমরা কঠোর কর্মসূচির কথা ভাবছি। টানা পাঁচ-সাত দিন হরতাল এমনকি অবরোধের মতো কর্মসূচি দিতেও বাধ্য হব আমরা।” তবে সবকিছুই সরকারের আচরণের ওপর নির্ভর করছে বলে জানান তিনি।

সরকারি দলের নেতারা দৃঢ়ভাবে বলছেন, ২৪ অক্টোবরের পর দেশে উদ্বিগ্ন হওয়ার মতো কিছুই ঘটবে না। বিরোধী দলের অগণতান্ত্রিক কর্মকাণ্ড দেশের মানুষকে নিয়ে তারা প্রতিহত করবেন।