ডিস্টিলারি বিভাগের লাভ সামনে আনা হলেও আড়ালে অন্যখাতের লোকসান

দর্শনা কেরুজ চিনিকল থেকে ২০১৬-১৭ অর্থবছরে সরকারকে ৬৬ কোটি টাকা রাজস্ব দিয়েও লাভ পৌনে ৭ কোটি টাকা

নজরুল ইসলাম: দর্শনা কেরু অ্যান্ড কোং (বাংলাদেশ) লিমিটেডের ডিস্টিলারি বিভাগে গত অর্থ বছরে পৌনে ৭ কোটি টাকা লাভ হলেও চিনি উৎপাদন বিভাগে লোকসান দাঁড়িয়েছে প্রায় ৪৫ কোটি টাকা। রাষ্ট্রয়াত্ব চুয়াডাঙ্গার একমাত্র ভারি শিল্প প্রতিষ্ঠানটির আয়-ব্যায়ের হিসেব জানতে গেলে শুধু ডিস্টিলারি বিভাগের ওপর ভর করে দেখানো লাভের অঙ্কটাই সামনে মেলে ধরা হয়। বলা হয়, সরকারের ৬৫ কোটি ৭৫ লাখ টাকা রাজস্ব দিয়েও লাভের পরিমাণ পোনে ৭ কোটি। তবে অন্য বিভাগের বিশদ তথ্য দিতে কর্তৃপক্ষের অনেকটাই অনিহা।
চুয়াডাঙ্গা দর্শনার কেরু অ্যান্ড কোম্পানি (বাংলাদেশ) লিমিটেডের লাভ-ক্ষতির যে হিসেব নিকেশটা সামনে আনা হচ্ছে, সেটা মূলত ডিস্টিলারি বিভাগের ওপর ভর করে করা। ফলে সার্বিক হিসাব নিকাশ শাক দিয়ে মাছ ঢাকার মতো অবস্থায় দাঁড়িয়েছে বলেও মন্তব্য করেছেন অনেকে। তবে একটি সূত্র বলেছে, একই অর্থ বছরে প্রতিষ্ঠানটি শুধুু চিনি উৎপাদন বিভাগেই লোকসান করেছে প্রায় ৪৫ কোটি টাকা। তবে লোকসানের ব্যাপারে কর্তৃপক্ষের রয়েছে নানা যুক্তি। অপর একটি সূত্র বলেছে, প্রতিবছর ক্রয় বিভাগে যে পরিমাণ অনিয়ম হয় তা রোধ করতে পারলে প্রতিষ্ঠানটির লোকশানের বোঝা হয়তো কিছুটা হলেও কম হতো।
জানা গেছে, ১৯৩৮ সালে ১৬৬ দশমিক ১৮ একর (আবাসিক এলাকাসহ) জমির ওপর প্রতিষ্ঠিত হয় দর্শনা কেরুজ চিনিকল কমপ্লেক্স প্রতিষ্ঠনটি। বাংলাদেশের চিনিশিল্প স্থাপনা গুলোর মধ্যে কেরু অ্যান্ড কোম্পানি (বাংলাদেশ) লি. একটি প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠান। জেলার সীমান্তবর্তী জনপদ দর্শনায় চিনিশিল্প, ডিস্টিলারি ও বাণিজ্যিক খামারের সমন্বয়ে এ বৃহৎ শিল্প কমপ্লেক্সটি প্রতিষ্ঠিত। যা জেলার আর্থ সামাজিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। অদ্যবদি প্রতিষ্ঠনের পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন ২৫ জন কর্মকর্তা। এর মধ্যে বে-সরকারি প্রতিষ্ঠান থাকাকালীন দায়িত্ব পালন করেছেন ৭ জন। আর সরকারিকরণ হওয়ার পর দায়িত্ব পালন করেছেন চলতি হিসাব অনুযায়ী ১৮ জন। প্রতিষ্ঠালগ্নে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান হিসেবে ১৯৩৮-৪৯ সাল পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেছেন জেড ডি নিকাশ। বর্তমানে ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন প্রেকৌশলী এনায়েত হোসেন।
আখের ওপর ভিত্তি করে দেশের উত্তর পশ্চিমাঞ্চলে সরকারি ব্যবস্থাপনায় গড়ে উঠেছে ১৫টি চিনিশিল্প প্রতিষ্ঠান। যেখানে কৃষক তার উৎপাদিত পণ্য সরকার কর্তৃক নির্ধারিত মূল্যে বিক্রি করতে পারবে। কৃষি পণ্যের মূল্য নিশ্চিত করে কৃষকের আর্থিক ও সামাজিক অবস্থার উন্নয়নের লক্ষ্যে ১৯৭২ সালে অন্যান্য শিল্প কারখানার ন্যায় চিনিকলগুলো জাতীয়করণ করা হয়। তখন থেকে অদ্যবদি এটি কেরু অ্যান্ড কোং (বাংলাদেশ) লি. নামে বাংলাদেশ সুগার অ্যান্ড ফুড ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশনের অধীনে পরিচালিত হয়ে আসছে। চিনিশিল্পের একমাত্র কাঁচামাল হচ্ছে আখ। আর এ আখচাষ চিনিকলের নিজেস্ব জমির পাশাপাশি মিলজোন এলাকার চাষিরা আখচাষ করে থাকেন। ২০১৬-১৭ রোপণ মরসুমে চিনিকলের নিজেস্ব জমিতে আখচাষ হয়েছে ১ হাজার ৭শ ৫০ একর। আর চাষিরা আখচাষ করেছে ৩ হাজার ৮শ ৯৬ একর জমিতে। যা লক্ষ্যমাত্রার থেকে ৬ হাজার ৪শ ৪ একর কম। কারণ দিন দিন মানুষ আখচাষ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। বিভিন্ন সময় দায়িত্ব পালনকালে প্রতিষ্ঠান প্রধানরা অদক্ষতা আর চাষিদেরকে উপেক্ষা করার কারণে এমনটি হয়েছে বলে চাষি মহল মনে করছেন।
এদিকে ২০১৬-১৭ অর্থ বছরে প্রতিষ্ঠানটি সরকারকে আয়কর ভ্যাট ও আবগারিশুল্কসহ মোট রাজস্ব দিয়েছে ৬৫ কোটি ৭৫ লাখ টাকা। রাজস্ব দেয়ার পাশাপাশি প্রতিষ্ঠানটি লাভ করেছে ৬ কোটি ৭৫ লাখ টাকা। তবে জনশ্রুতি রয়েছে চিনি উৎপাদন বিভাগে লোকসান করেছে প্রায় ৪৫ কোটি টাকা। প্রতিকেজি চিনি উৎপাদন খরচ পড়ে ১শ ৭২ টাকা সেখানে প্রতিকেজি চিনি বিক্রি মূল্য ৬০-৬৫ টাকা। এদিকে লাভের তথ্য কর্তৃপক্ষ আনন্দ চিত্বে দিলেও লোকসানের তথ্য দিতে অনিহা প্রকাশ করেছেন। যেখানে সরকার সব ক্ষেত্রে দুর্নীতি রোধে কোঠর নজদারি করছে এবং তথ্য পরিবেশনের ক্ষেত্রে তথ্য অধিকার আইন চালু করেছে। সেখানে সঠিক তথ্য পরিবেশন করতে কর্তৃপক্ষের অনিহার হেতু প্রশ্ন বিদ্ধ হয়েছে। কারণ দেশের সকল সরকারি প্রতিষ্ঠান দেশের জনগণের সম্পদ। আর যারা দায়িত্ব পালন করেন তাদের পারিশ্রমিক আসে জনগণের কাছ থেকে। আর চাকরি জীবীরা জনগণের সেবক শাসক নয়।
অপর একটি সূত্র বলেছে, কেরুজ চিনি কলটিতে অনেকেই দীর্ঘদিন থেকে একই স্থানে দায়িত্ব পালন করায় দুর্নীতি জেকে বসেছে। কারণ দেশের ১৫টি চিনিকলের মধ্যে লাভ লোকসান মিলিয়ে দর্শনা কেরুজ চিনিকলটি সুবিধাজনক অবস্থায় আছে। যদিও আখ উৎপাদনের ক্ষেত্রে রয়েছে নাজুক অবস্থায়। বয়সের ভারে ন্যুয়ে পড়া চিনিকলটির আধুনিকায়নে এলাকাবাসীর দাবি ছিলো দীর্ঘদিনের। সে লক্ষ্যে চিনিকলটি আধুনিকায়ন করণের জন্য সরকারের সংশি-ষ্ট মন্ত্রণালয় থেকে ২০১২ সালে ৪৭ কোটি ৫৭ লাখ টাকা বরাদ্দ দেয়। সে বরাদ্ধের টাকার কতোটুকু কাজ হয়েছে তা রয়েছে তিমিরে।
অপরদিকে চিনিকলটিকে টিকিয়ে রাখতে বর্তমান করপোরেশনের চেয়ারম্যান নিরন্তন প্রচেষ্টা ও সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সাথে দেনদরবার করে চলেছেন। তারই অংশ হিসেবে চলতি রোপণ মরসুমে চিনি কলের প্রত্যেক কর্মকর্তা, শ্রমিক ও কর্মচারীকে বাধ্যতামূলক আখ লাগানোর তাগিতও দেয়া হয়েছে। চিনিকলের উন্নয়নে ছুটছেন সারাক্ষণ। সেখানে কতিপয় কর্মকর্তার কারণে মাঝে মধ্যে চিনিকল প্রতিষ্ঠানটিকে পড়তে হয় বিব্রতকর পরিস্থিতির মধ্যে।
একটি সূত্র জানিয়েছে, প্রতিবছর প্রতিষ্ঠানটি মোটা অঙ্কের টাকার মালামাল ক্রয় করে থাকে। ক্রয়কৃত মালামাল মানসম্মত না হওয়ায় কিছুদিন পরেই আবারও সে সমস্থ মালামাল ক্রয় করতে হয়। অথচ প্রতিষ্ঠানটিকে উপযুক্ত মূল্য পরিশোধ করতে হয়। তাই মূল্য অনুযায়ী সঠিক মালামাল বুঝ করে নিলে লোকসানের বোঝা কিছুটা হলেও কম হোতো বলে অভিজ্ঞ মহল মনে করছেন। এ চিনিকলে এক সময় সাড়ে ৪ হাজার মানুষ কর্মরত ছিলো। তখন তাদের সর্বপ্রকার সুযোগ সুবিধা দিয়েও প্রতিষ্ঠানটি লাভের মুখ দেখতো। অথচ লোকবল কমতে কমতে তলানিতে ঠেকেছে তাতেও লোকসান ঠেকানো যাচ্ছে না। তাহলে প্রশ্ন উঠেছে আসল গলদটা কোথায়? দক্ষতার নাকি পরিকল্পনার? নাকি মোটা দাগে দুর্নীতি?
২০১০ সালে প্রতিষ্ঠানে যোগদানকারী হিসাব বিভাগের প্রধান মোশারফ হোসেনর নিকট আয় এবং ব্যয়ের তথ্য জানতে চাইলে তিনি গড়িমিশি করে সর্বশেষ বলেন, প্রতিষ্ঠান প্রধানের নিকট যান। এ ব্যাপারে চিনিকলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রেকৌশলী এনায়েত হোসেন বলেন, আমি শুধু লাভের তথ্য দেবো। লোকসানের তথ্য দেবো না। কারণ এ প্রতিষ্ঠানটির হিসাব বিভাগ কমবাইন্ড। তাই আলাদা করে লোকসানের তথ্য দেয়া যাবে না।