টিআইবি রিপোর্ট : বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষা ছাড়াই ৫০ হাজার টাকায় সার্টিফিকেট

 

স্টাফ রিপোর্টার: শিক্ষা মন্ত্রণালয়, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) ও বেসরকারিবিশ্ববিদ্যালয়ের একাংশের ত্রিমুখি সমাঝোতায় নানা অনিয়ম ও দুর্নীতি হচ্ছেবেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে। এক থেকে তিন কোটি টাকা অবৈধ লেনদেনেরবিনিময়ে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের অনুমতি পাওয়া যায়। আর ৫০ হাজারথেকে ৩ লাখ টাকা দিলেই পাওয়া যায় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সনদ। উপহার বানগদ অর্থের বিনিময়ে শিক্ষকরা নম্বর বাড়িয়ে দেন, পরীক্ষায় পাস করা যায়।

গতকালসোমবার রাজধানীর ব্র্যাক ইন সেন্টারে ‘বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়: সুশাসনেরচ্যালেঞ্জ ও উত্তরণের উপায়’শীর্ষক ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালবাংলাদেশের (টিআইবি) গবেষণা প্রতিবেদনে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্নস্তরে ব্যাপক অনিয়ম ও আর্থিক দুর্নীতির চিত্র তুলে ধরা হয়।

প্রতিবেদনেবলা হয়, উপাচার্য, সহউপাচার্য ও কোষাধ্যক্ষ নিয়োগ অনুমোদনের জন্য অবৈধঅর্থ লেনদেন হয় ৫০ হাজার থেকে দু লাখ টাকা। এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনেরজন্য পরিদর্শনে ৫০ হাজার থেকে এক লাখ, বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরুদ্ধে অভিযোগনিষ্পত্তির জন্য ১০ থেকে ৫০ হাজার টাকা, অনুষদ অনুমোদনের জন্য ১০ থেকে ৩০হাজার, বিভাগ অনুমোদনের জন্য ১০ থেকে ২০ হাজার, পাঠ্যক্রম অনুমোদনের জন্য৫ থেকে ১০ হাজার টাকা অবৈধ লেনদেন হয়।অনুষ্ঠানে টিআইবির নির্বাহীপরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘শিক্ষা মন্ত্রণালয়, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরিকমিশন ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্তদের একাংশের আঁতাতের ফলেশিক্ষার্থীরা প্রতারণার শিকার হচ্ছেন। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় অলাভজনকহিসেবে যাত্রা শুরু করলেও বর্তমানে অনেকে একে মুনাফা অর্জনের উপায় হিসেবেদেখছেন। ফলে শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য বিনষ্ট হচ্ছে এবং উচ্চশিক্ষা এক ধরনেরবাণিজ্যিক পণ্যে রূপান্তরিত হচ্ছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়, স্বতন্ত্র ওস্বাধীন অ্যাক্রিডিটেশন কাউন্সিল ৪ বছরেও গঠন না করা, অলাভজনক খাত সত্ত্বেওক্রমাগত মুনাফাভিত্তিক হয়ে ওঠা, অব্যাহত রাজনৈতিক প্রভাবে বেসরকারিবিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেলেও সুনির্দিষ্ট কিছুবিশ্ববিদ্যালয় ছাড়া মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করা যায়নি। এছাড়া বিদেশিবিশ্ববিদ্যালয়ের শাখা ক্যাম্পাস বা স্টাডি সেন্টার বিধিমালা ২০১৪প্রবর্তনের ফলে নিয়ন্ত্রণহীন প্রতিযোগিতার মুখে পড়তে যাচ্ছে দেশেরবেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো।

সিন্ডিকেট, একাডেমিক কাউন্সিল ও অর্থকমিটিসহ অন্যান্য কমিটির দায়িত্ব ও কার্যক্রম ট্রাস্ট্রি বোর্ডেরপ্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপে নিয়ন্ত্রিত হয়। এছাড়া সমঝোতার মাধ্যমে নিজস্বঅন্যান্য ব্যবসা পরিচালনার ক্ষেত্র হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়কে ব্যবহার করাহচ্ছে। ইউজিসিকে না জানিয়ে সাধারণ তহবিলের টাকা ব্যক্তিগত কাজে ব্যবহার ওবিশ্ববিদ্যালয়ের নামে ভুয়া কাগজপত্র ও স্বাক্ষর জাল করে ব্যাংক ঋণ গ্রহণ ওআত্মসাত্ করা হচ্ছে, কম যোগ্য ব্যক্তিকে বিভাগীয় প্রধান করাসহ নানা অনিয়ম ওদুর্নীতির সাথে যুক্ত ট্রাস্টি বোর্ডের কোনো কোনো সদস্য।

প্রতিবেদনেবলা হয়, বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পরে সর্বোচ্চ ১২ বছরের মধ্যেস্থায়ী সনদ গ্রহণ করার নিয়ম থাকলেও এ পর্যন্ত মাত্র ২টি বিশ্ববিদ্যালয় সকলশর্ত পূরণ করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কাছ থেকে স্থায়ী সনদ গ্রহণ করেছে। ৭৯টিবিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে মাত্র ১৭টি স্থায়ী ক্যাম্পাসে কার্যক্রম পরিচালনাকরছে ও অন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সাময়িক অনুমতি নিয়ে তা বার বার নবায়নেরমাধ্যমে কার্যক্রম পরিচালনা করছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়, ইউজিসিরঅনুমোদন ছাড়া কোর্স কারিকুলাম পড়ানো হয়। বিভাগ খোলা ও শিক্ষার্থী ভর্তিএবং অর্থ লেনদেনের মাধ্যমে অনুমোদন, ক্লাস না করিয়ে, পরীক্ষা না নিয়ে ওব্যবহারিক ক্লাস (বিশেষায়িত ল্যাব সুবিধা অপর্যাপ্ত) না নিয়ে টাকার বিনিময়েসার্টিফকেট প্রদান করা হয়। কাগজে কলমে শিক্ষকের কোটা পূরণ দেখালেওবাস্তবে শিক্ষকের উপস্থিতি না থাকা, গবেষণার জন্য অর্থ বরাদ্দ রাখার নিয়মথাকলেও তা ব্যয় না করা, মাস্টার্সের থিসিস, জার্নালে লেখা ও ব্যক্তিউদ্যোগের কাজকে বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা বলে চালানো, সমঝোতার মাধ্যমেনিরীক্ষা কার্যক্রম পরিচালনার মাধ্যমে প্রকৃত চিত্র গোপন করার মত নানাঅনিয়ম ও দুর্নীতি বিদ্যমান রয়েছে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনারক্ষেত্রে।

প্রতিবেদন অনুযায়ী ইউজিসির নির্দেশনা অনুসারে ২টির বেশিবিশ্ববিদ্যালয়ে কাজ করা নিষিদ্ধ থাকলেও তা না মেনে অধিকসংখ্যকবিশ্ববিদ্যালয়ে সম্পৃক্ত থাকাসহ শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে উপঢৌকন গ্রহণ করেপাস করিয়ে দেয়া, পরীক্ষার পূর্বে প্রশ্ন বলে দেয়া ও সে অনুসারে শ্রেণিকক্ষেপাঠদান, শিক্ষার্থীদের যৌন হয়রানির মতো অনিয়ম ও অনৈতিক কর্মকাণ্ডের সাথেযুক্ত আছেন কিছু শিক্ষক।সরকারি আদেশে কিছু আউটার ক্যাম্পাস বন্ধঘোষণা করা হলেও কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি ও পরামর্শ কেন্দ্র নামেআউটার ক্যাম্পাস চালু রেখেছে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের মান উন্নত দেখানোরজন্য অবৈধভাবে বিভিন্ন শিক্ষকের নাম ব্যবহার করে কিছু বিশ্ববিদ্যালয়।কাগজে-কলমে ঠিক থাকলেও বাস্তবে খণ্ডকালীন শিক্ষকের সংখ্যা বেশি। একটিবিশ্ববিদ্যালয় ইউজিসিকে সংরক্ষিত তহবিলের ভুয়া রশিদ প্রদান করেছে।

শিক্ষামন্ত্রণালয়ের অনিয়ম: উচ্চ পর্যায়ের চাপ ও মামলা সংক্রান্ত দীর্ঘসূত্রতারকারণে অননুমোদিত ও আইন ভঙ্গকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রম বন্ধ করতেপারেনি। আইন লঙ্ঘনের ক্ষেত্রে শাস্তি প্রদান না করে বার বার আলটিমেটাম দিয়েদায়িত্ব শেষ করে শিক্ষামন্ত্রণালয়।ইউজিসির অনিয়ম: বিভিন্নবিশ্ববিদ্যালয় পরিদর্শনের সময় ও বিভিন্ন উপলক্ষে ইউজিসির কিছু কর্মকর্তাআর্থিক সুবিধা ও উপঢৌকন গ্রহণ করেন। পরিদর্শন শেষে সঠিকভাবে প্রতিবেদন দেয়না, অর্থের বিনিময়ে তথ্য গোপন রাখে এবং অবৈধ অর্থ আদায়ের জন্য সমস্যাজিইয়ে রাখেন এই প্রতিষ্ঠানটির কিছু কর্মকর্তা।

সংবাদ সম্মেলনেপ্রতিবেদন উপস্থাপন করেন টিআইবি’র গবেষণা ও পলিসি বিভাগের পরিচালকমোহাম্মদ রফিক হাসান ও ডেপুটি প্রোগ্রাম ম্যানেজার নীনা শামসুন নাহার।অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন টিআইবি’র নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান এবংউপ-নির্বাহী পরিচালক ড. সুমাইয়া খায়ের।

সম্মেলনে জানানো হয়, ২০১২সালের জুন থেকে ২০১৪ সালের মে পর্যন্ত নির্বাচিত ২২টি বেসরকারিবিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে এ গবেষণা প্রতিবেদন প্রণীতহয়েছে।সংবাদ সম্মেলনে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সুশাসনেরসার্বিক চ্যালেঞ্জ চিহ্নিত করে তা থেকে উত্তরণে ১৬ দফা সুপারিশ উত্থাপিতহয়। উল্লেখযোগ্য সুপারিশসমূহের মধ্যে রয়েছে- বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন২০১০-এর প্রয়োজনীয় সংশোধনী এবং পূর্ণাঙ্গ বিধিমালা প্রণয়ন, অবিলম্বেঅ্যাক্রিডিটেশন কাউন্সিল গঠন, ইউজিসির জনবল, সক্ষমতা ও এখতিয়ার বৃদ্ধিরমাধ্যমে মনিটরিং ব্যবস্থা শক্তিশালীকরণ, আইন লঙ্ঘনের ক্ষেত্রে দ্রুতশাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ, শুধু উচ্চ রেটিং প্রাপ্ত বিদেশিবিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে শর্ত মেনে শাখা ক্যাম্পাস পরিচালনা, বিশ্ববিদ্যালয়পরিচালনার ক্ষেত্রে বোর্ড অব ট্রাস্টির একচ্ছত্র ক্ষমতার নিয়ন্ত্রণ, ভিসি, প্রো-ভিসি এবং অন্যান্য পদে নিয়োগের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক প্রভাব দূর, অডিটপ্রতিবেদনসহ বিশ্ববিদ্যালয় সংক্রান্ত সকল ধরনের তথ্য উন্মুক্ত করা।