ঝিনাইদহে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির চরম অবনতি :৬ মাসে ৪০ খুন : জনমনে পুলিশি আতঙ্ক

 

 

ঝিনাইদহ অফিস: ঝিনাইদহে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি চরম অবনতি ঘটেছে। প্রতিনিয়ত খুন, অপহরণ, চুরি-ডাকাতি, চাঁদাবাজি, ছিনতাই ও ধর্ষণের ঘটনা এ জেলায় নিত্যদিনের সঙ্গী হয়ে দাঁড়িয়েছে। পুলিশ মাঝে মধ্যে এসব ঘটনার সাথে জড়িতদের আটক করলেও রাজনৈতিক প্রভাবে তাদের ছেড়ে দিতে বাধ্য হচ্ছে। যার কারণে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি পুলিশের নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হচ্ছে না। বর্তমানে ঝিনাইদহ সদর উপজেলার পশ্চিমাঞ্চলের গ্রামগুলোতে চরমপন্থি ও ডাকাতের আনাগোনা বৃদ্ধি পেয়েছে। এসব গ্রামের লোকজন রাত জেগে গ্রাম পাহারা দিলেও থেমে নেই নীরব চাঁদাবাজি।

সংশ্লিষ্টসূত্র জানায়, চলতি বছরের ৬ মাসে নারী শিশুসহ জেলায় খুন হয়েছেন ৪০ জন, ডাকাতি, চুরি- চাঁদাবাজি, ছিনতাই ও ধর্ষণের ঘটনা অহরহ ঘটেই চলেছে। তবে পুলিশের রহস্যজনক ভূমিকার কারণে আইনশৃঙ্খলার পরিস্থিতি এমন দশা হচ্ছে বলে সচেতন লোকজন মনে করছেন। মূলত ঝিনাইদহে এখন পুলিশি আতঙ্ক বিরাজ করছে। মামলা থাক আর নাই বা থাক আটক হলেই পুলিশের দাবি অনুযায়ী অর্থের জোগান দিতে হচ্ছে। তা না পারলে তার ভাগ্যে চরম দুর্ভোগ নেমে আসছে। ঝিনাইদহ সদর থানার কয়েকজন অসাধু এসআই লিপ্ত রয়েছেন আটক বাণিজ্যে। অভিযোগের শেষ নেই এসআই আনোয়ার হোসেন ও থানার সেকেন্ড অফিসার দাউদ হোসেনের বিরুদ্ধে। তারা আওয়ামী লীগ বা তার অঙ্গ সংগঠনের নেতা-কর্মী বাদে যাকেই ধরেন সেই বনে যান চিহ্নিত ছিনতাইকারী বা সন্ত্রাসী। তখন তার কাছে মোটা অঙ্কের টাকা দাবি করা হয়। দাবি মেটাতে পারলে ভালো, না হলে থানায় নিয়ে দেখা হয় কোনো ছিনতাই বা ডাকাতি মামলায় ঢোকানো যায় কি না। এসআই আনোয়ার হোসেনের সাথে মাদকসেবী ও ব্যবসায়ীদের সখ্যতা রয়েছে। তাদের কাছ থেকে তিনি মাসোহারা নিয়ে থাকেন বলে অভিযোগ রয়েছে।

গত ৬ মাসে ঝিনাইদহ সদর উপজেলার এনায়েতপুর গ্রামে লুৎফর রহমানের ছেলে আব্দুল খালেক মণ্ডল, হরিণাকুণ্ডু উপজেলার আদর্শ-আন্দুলিয়া গ্রামে মজিবর রহমানের ছেলে মসিয়ার রহমান, কালীগঞ্জ পৌরসভার সাবেক প্যানেল মেয়র ইসমাইল হোসেন, আড়পাড়ার ৫ মাসের শিশু নুসরাত, মহেশপুর ঘুঘরী গ্রামে কৃষক আমিনুল হক, করিঞ্চা গ্রামের আব্দুর রাজ্জাক, শৈলকুপার দুধসর গ্রামের কৃষক বিশারত শেখ, শ্রমিক নেতা আব্দুল গাফফার বিশ্বাস, হরিণাকুণ্ডু উপজেলার কাপাশহাটিয়া গ্রামে এক গৃহবধূ, শিকারপুর গ্রামের মহিউদ্দীন, শৈলকুপার চতুরা গ্রামে আইয়ূব হোসেন, কোটচাঁদপুরের ইউপি সদস্য হাফেজ আবুল কালাম, ঝিনাইদহ শহরের আরাপপুর এলাকায় শৈলকুপার মাদরাসাছাত্র জিহাদ, হরিণাকুণ্ডুর তোলা গ্রামে জাহাঙ্গীর, শৈলকুপার মিনগ্রামে আজাদ, ঝিনাইদহ শহরের খাজুরা গ্রামের কৃষক শাহীন, কোটচাঁদপুর উপজেলার গোবিন্দপুর গ্রামের বিলকিস খাতুন, কালীগঞ্জ উপজেলার অজ্ঞাত এক মহিলা, ঝিনাইদহ সদর উপজেলার মাড়ুন্দি গ্রামের সিরাজুল ইসলাম ওরফে রিন্টু মুন্সি, ঝিনাইদহ সদর উপজেলার বানিয়াকান্দর গ্রামের কৃষক ইউনুচ, ঝিনাইদহ শহরের পবহাটী গ্রামের ঝুমুর, কোটচাঁদপুর উপজেলার দোড়াগ্রামের লিটন হোসন, কালীগঞ্জ উপজেলায় পোল্ট্রি ব্যবসায়ী মহসিন আলী ও শৈলকুপা উপজেলার শেখপাড়ায় হাবিবুর রহমান কুইন নামে এক যুবকসহ অন্তত ৪০ ব্যক্তি হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন।

অন্যদিকে গুম ও অপহরণ তালিকায় রয়েছেন- ঝিনাইদহ সদর উপজেলা ছাত্রদলের সদস্য ইলিয়াস, নারায়ণপুর গ্রামের ব্যবসায়ী জালাল উদ্দিন ও শৈলকুপা উপজেলার চতুড়া গ্রামের মাদরাসাছাত্র মোহাম্মদ হাবিবুল্লাহ। ঝিনাইদহ শহরের কালিকাপুর গ্রামের এক গৃহবধূ নিখোঁজ রয়েছেন। সদর উপজেলার রহিম নামে এক মাদরাসাছাত্রকে অপহরণ করে ৫ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করা হয়েছে। সেও নিখোঁজ রয়েছে।

মহেশপুর উপজেলার বিভিন্ন গ্রাম এবং ঝিনাইদহ শহরতলীর নতুন কোর্টপাড়া, উপশহরপাড়া, সদর উপজেলার হলিধানী সাগান্না, ফকিরাবাদ, নারায়ণপুর, সাহেবনগর, গোবিনাথপুরসহ বিভিন্ন গ্রামে প্রতিনিয়ত ডাকাতির ঘটনা ঘটছে। এসব গ্রাম থেকে নগদ টাকা স্বর্ণালঙ্কার ও মোবাইল সেটসহ বাড়ির মূল্যবান জিনিসপত্র লুট করে নিয়ে যাচ্ছে। বাধা দেয়ায় ইতোমধ্যে ডাকাতদের হাতে স্বামী-স্ত্রীসহ প্রায় ১০/১৫ জন আহত হয়েছে। এছাড়া মোহাম্মদপুর, সাধুহাটি, বোড়াই, নাথকুণ্ডু ও বংকিরা, হাজরা গ্রামে ডাকাতের ভয়ে গ্রামবাসী একত্রে পালাক্রমে রাত জেগে গ্রাম পাহারা দিচ্ছে। কোটচাঁদপুর-জীবননগর সড়কে পুলিশ সদস্যরাও ডাকাতির কবলে পড়েছেন। বিষয়খালী এলাকায় গ্রামীণ ব্যাংকে ডাকাতি হয়েছে।

এদিকে এ সময়ে ডজন খানেক নারী ও শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। হরিণাকুণ্ডু ও সদর উপজেলায় দু ছাত্রীকে অপহরণের পর পুলিশ উদ্ধার করে। তাদেরকে আটকে রেখে ধর্ষণ করা হয়েছে। জেলা শহরের চাকলাপাড়া ও কাঞ্চনপুরে দু শিশু ধর্ষণ করা হয়। ডাকবাংলা বাজারের নিকটে এক মাইক্রো চালককে কুপিয়ে টাকা ছিনিয়ে নেয়া হয়।

এদিকে বিভিন্ন চরমপন্থি দলের নামে নীরব চাঁদাবাজি করা হচ্ছে। জিনের বাদশার অত্যাচারে গ্রামের মানুষ অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে। শহরে ৬ মাসে শতাধিক মোটরসাইকেল চুরিসহ পাড়া-মহল্লায় প্রতিনিয়ত কোনো না কোনো চুরি হচ্ছে। গ্রামগঞ্জে রাজনৈতিক কারণে সংঘর্ষ হচ্ছে প্রতিনিয়ত। এসব ঘটনায় জেলার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ওপর বড় ধরনের প্রভাব বিস্তার করেছে।

এ ব্যাপারে ঝিনাইদহের পুলিশ সুপার আলতাফ হোসেন জানান, পুলিশ সাধ্যমতো আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। তাছাড়া অপরাধীদের গ্রেফতার ও মামলা করা হচ্ছে।