ঝিনাইদহের চার উপজেলায় বড় দু দলের অস্তিত্বের লড়াই

 

নির্বাচনী আচরণবিধি লঙ্ঘনের অভিযোগ : প্রার্থীরা ছুটছেন ভোটারদের দ্বারে দ্বারে

আওয়ামী লীগে একক প্রার্থী বিএনপিতে কোন্দল

ঝিনাইদহ অফিস: প্রথম পর্যায়ে ঘোষিত তফশিল অনুযায়ী ঝিনাইদহের ৬ উপজেলার মধ্যে ৪ উপজেলায় আগামী ১৯ ফেব্রুয়ারি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। ঝিনাইদহ সদর, শৈলকুপা, কালীগঞ্জ ও কোটচাঁদপুর উপজেলায় অনুষ্ঠিত এ নির্বাচনে উপজেলা চেয়ারম্যান পদে আওয়ামী লীগের একক প্রার্থী থাকলেও বিএনপির একাধিক প্রার্থী রয়েছে। ৪ উপজেলায় চেয়ারম্যান প্রার্থী ১৫, ভাইস চেয়ারম্যান পদে ২২ ও মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান পদে ১৩ প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। রাজনৈতিক দলীয় ব্যানারে উপজেলা নির্বাচন অনুষ্ঠিত না হলেও দেশের প্রধান দু রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির দলীয় প্রার্থীরা অংশ নিচ্ছেন এ নির্বাচনে। রয়েছে জামায়াত ও জাতীয় পার্টির প্রার্থীও। প্রার্থীরা তাদের সমর্থকদের সাথে নিয়ে চষে বেড়াচ্ছেন পুরো নির্বাচনী এলাকা। ভোট প্রার্থনায় নির্ঘুম রাত কাটছে তাদের। দিন যতোই ঘনিয়ে আসছে নির্বাচন নিয়ে গ্রাম-গঞ্জে, বাজার ও চা স্টলে প্রার্থী-সর্মথক ও ভোটারদের মধ্যে চলছে জয়-পরাজয়ের শেষ হিসাব-নিকাশ। বিএনপি-জামায়াতের প্রার্থীরা সরাসরি নির্বাচনে অংশ নিলেও তারা নাগরিক সমাজের প্রার্থী বলে প্রচার-প্রচারণা করছেন। তবে প্রার্থীরা নানা প্রতিশ্রুতি দিলেও ভোটাররা ভোট দেয়ার ক্ষেত্রে প্রার্থীর যোগ্যতার পাশাপাশি এলাকার উন্নয়ন এবং সব ধরনের সঙ্কটে যারা পাশে থাকবেন তাদেরই ভোট দেবেন বলে জানিয়েছেন ভোটাররা।

ঝিনাইদহ সদর উপজেলা চেয়ারম্যান প্রার্থী ৪ জন। এরা হলেন- কনক কান্তি দাস (আওয়ামীলীগ) কাপ-পিরিচ, আব্দুল আলীম (বিএনপি) আনারস, মুন্সী কামাল আজাদ পান্নু (বিএনপির বিদ্রোহী) টেলিফোন ও হারুন অর রশীদ (জাতীয় পার্টি) মোটরসাইকেল প্রতীক নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। একক প্রার্থী নির্বাচনে আওয়ামী লীগ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেও বিদ্রোহী প্রার্থী নিয়ে বেকায়দায় পড়েছে বিএনপি। দলীয় সিদ্ধান্ত উপেক্ষা করে নির্বাচনে অংশ নেয়ায় ঝিনাইদহ সদর উপজেলা বিএনপির সভাপতি মুন্সি কামাল আজাদ পান্নুকে দলের সকল সদস্যপদ থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে।

এ উপজেলায় ভাইস চেয়ারম্যান প্রার্থী ৭ জন। এরা হলেন- আতিকুল হাসান মাসুম (আওয়ামী লীগ) তালা, কাজী এনামুল হক মিলন (আওয়ামী লীগ) উড়োজাহাজ, আব্দুর রশিদ মিয়া (আওয়ামী লীগ) টিয়া পাখি, এনামুল হক নিলু (স্বতন্ত্র) বৈদ্যুতিক বাল্ব, দাউদ হোসেন (আওয়ামী লীগ) চশমা, নুর এ আলম বিপ্লব (আওয়ামী লীগ) বই, হাবিবুর রহমান (জামায়াত) টিউবওয়েল প্রতীক এবং মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান প্রার্থী তহুরা খাতুন (বিএনপি) কলস ও মিসেস শিরিনা রহমান (আওয়ামী লীগ) হাঁস প্রতীক নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। এ উপজেলায় চেয়ারম্যান পদে আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জাতীয় পার্টির প্রার্থীর মধ্যে ত্রিমুখী লড়াই হবে। এলাকায় ব্যাপকভাবে মিটিং, কর্মী-সমাবেশসহ গণসংযোগ চালিয়ে যাচ্ছেন আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী কনক কান্তি দাস। তিনি দাবি করেন, মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের শক্তিসহ সকল পেশাজীবী গণমানুষের সমর্থন রয়েছে তার পক্ষে। এদিক থেকে তিনি নিশ্চিত বিজয় তার ঘরেই আসবে।

অপরদিকে নির্বাচনকে কেন্দ্র করে এখানে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের আশঙ্কা করছেন বিএনপি সমর্থিত প্রার্থী আব্দুল আলীম। তিনি মনে করেন, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন হলে জয় তারই হবে। জাতীয় পার্টি সমর্থিত প্রার্থী হারুন অর রশীদের বিরুদ্ধে কালো টাকা ছড়ানো ও ভোটারদের ভয়ভীতি দেখানোর অভিযোগ উঠেছে। এছাড়া তার মালিকানাধীন এনজিও সৃজনী বাংলাদেশের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের চাকুরিচ্যুত করার হুমকি দিয়ে নির্বাচনী কর্মকাণ্ড পরিচালনা করতে বাধ্য করা হচ্ছে।

শৈলকুপা উপজেলা চেয়ারম্যান প্রার্থী দু জন। মোশাররফ হোসেন সোনা শিকদার (আওয়ামী লীগ) আনারস ও রাকিবুল হাসান খান দিপু (বিএনপি) মোটর সাইকেল প্রতীক নিয়ে প্রতিদ্বন্দিতা করছেন। এখানে তাদের দুজনের মধ্যেই হাড্ডা-হাড্ডি লড়াই হবে। এ উপজেলায় ভাইস চেয়ারম্যান প্রার্থী ৫জন হলেন- কামরুজ্জামান লিটন (বিএনপি) তালা, কামরুল ইসলাম (বিএনপি) টিউবওয়েল, জাহিদুন্নবী কালু (আওয়ামী লীগ বিদ্রোহী) চশমা, মজিবর রহমান (স্বতন্ত্র) মাইক, শামীম হোসেন (আওয়ামী লীগ) উড়োজাহাজ এবং মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান প্রার্থী ৫ জন হলেন- আফরোজা নাসরিন লিপি (আওয়ামী লীগ) হাঁস, সুলতানা বুলবুলি (আওয়ামী লীগ, বিদ্রোহী) কলস, সেতারা আফরোজা (বিএনপি) বৈদ্যুতিক পাখা, রোকসানা আক্তার (বিএনপি) পদ্মফুল, স্বপ্না সুলতানা (বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি) ফুটবল প্রতীক নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন।

দলীয় সিদ্ধান্ত অমান্য করে প্রার্থী হওয়ায় শৈলকুপা উপজেলা মহিলা আওয়ামী লীগ সভানেত্রী সুলতানা বুলবুলি ও আওয়ামী লীগ নেতা জাহিদুন্নবী কালুকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। এ উপজেলায় বিএনপি সমর্থিত চেয়ারম্যান প্রার্থী রাকিবুল হাসান খান দিপু অভিযোগ করেছেন, তার প্রতিদ্বন্দী প্রার্থী মোশাররফ হোসেন সোনা শিকদার নির্বাচনী আচরণবিধির কোনোটিই মানছেন না। কর্মী সমর্থকদের হত্যার হুমকি, পোস্টার ছেড়া, প্রচার মাইক ভাঙচুরসহ ভোটকেন্দ্র দখলের হুমকি দিচ্ছেন আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী। তিনি অবিলম্বে লেবেল প্লেয়িং ফিল্ড করে নির্বাচনী পরিবেশ ফিরিয়ে আনার দাবি জানান।

কোটচাঁদপুর উপজেলা চেয়ারম্যান প্রার্থী ৩ জন- শরিফুন্নেছা মিকি (আওয়ামী লীগ) মোটরসাইকেল, সিরাজুল ইসলাম (বিএনপি) আনারস ও তাজুল ইসলাম (জামায়াত) দোয়াত-কলম প্রতীক নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। এ উপজেলায় ভাইস চেয়ারম্যান প্রার্থী ৫ জন হলেন- মির কাশেম আলী (আওয়ামী লীগ) উড়োজাহাজ, ইকরামুল হক (বিএনপি) চশমা, মোয়াবিয়া হোসেন (জামায়াত) মাইক, শাহজাহান আলী (জাতীয় পার্টি) তালা ও শামীম আখতার (জাসদ) টিউবওয়েল প্রতীক এবং মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান প্রার্থী ৫ জন হলেন- নাসিমা ইসলাম (বিএনপি) ফুটবল, মাহফুজা খানম (স্বতন্ত্র) কলস, মেহেরুন্নেছা মেরী (আওয়ামী লীগ) হাঁস ও নাজমা খাতুন (জামায়াত) সেলাইমেশিন প্রতীক নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। এখানে চেয়ারম্যান পদে আওয়ামী লীগ, জামায়াত ও বিএনপি সমর্থিত প্রার্থীর মধ্যে ত্রিমুখী লড়াই হবে। তবে একক প্রার্থী নির্ধারণ করতে পারায় আওয়ামী লীগ নিশ্চিত বিজয়ের আশা করলেও শরিক দল জামায়াতের প্রার্থী নিয়ে বেকায়দায় পড়েছে বিএনপি। জামায়াতের প্রার্থী নির্বাচনে অংশ নেয়ায় জয়-পরাজয় নিয়ে অনিশ্চয়তায় ভুগছেন বিএনপি নেতাকর্মীরা। কোটচাঁদপুর উপজেলা জামায়াতের নেতা তাজুল ইসলাম প্রার্থী হওয়ায় বিএনপির জন্য মরার ওপর খাঁড়ার ঘা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

কালীগঞ্জ উপজেলায় চেয়ারম্যান প্রার্থী ৬ জন হলেন- জাহাঙ্গীর সিদ্দিকী ঠাণ্ডু (আওয়ামী লীগ) টেলিফোন, হামিদুল ইসলাম (বিএনপি) কাপ-পিরিচ, নুরুল ইসলাম (বিএনপি) মোটরসাইকেল, ওলিউর রহমান (জামায়াত) হেলিকপ্টার, এএসএম আমিরুল ইসলাম (জাতীয় পার্টি) আনারস ও বাবুল হোসেন (ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ) দোয়াত-কলম প্রতীক নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। এ উপজেলায় আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী জাহাঙ্গীর সিদ্দিকী ঠাণ্ডু বিসিআইসির সার ডিলার হওয়ার কারণে তার প্রার্থিতা বাতিল হয়। পরে সুপ্রীম কোর্টে রিট আবেদন করে তিনি প্রার্থিতা ফিরে পান। এ উপজেলায় বিএনপি, আওয়ামী লীগ ও জামায়াত প্রার্থীদের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে। বিএনপি ও জামায়াতের ৩ জন প্রার্থী থাকায় একক প্রার্থী নিয়ে কালীগঞ্জ উপজেলায় আওয়ামী লীগ সুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছে। এ উপজেলায় ভাইস চেয়ারম্যান প্রার্থী পাঁচ জন হলেন- আজিজুর রহমান (জামায়াত) বই, আজিজুল ইসলাম (বিএনপি) চশমা, ইসরাইল হোসেন (বিএনপি) উড়োজাহাজ, মতিয়ার রহমান (আওয়ামী লীগ) টিউবওয়েল, হাসনুর রশিদ মন্নু (আওয়ামী লীগ বিদ্রোহী) তালা প্রতীক এবং মহিলা ভাইস চোয়ারম্যান প্রার্থী তিথী রাণী বিশ্বাস (আওয়ামী লীগ) কলস, শাহনাজ পারভীন (বিএনপি) হাঁস প্রতীক নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন।

ঝিনাইদহ জেলা রিটার্নিং অফিসার অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক শেখ রফিকুল ইসলাম জানান, উপজেলা নির্বাচনের সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়েছে। ভোটাররা যাতে সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণভাবে ভোট দিতে পারে তার জন্য প্রশাসনের পক্ষ থেকে নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে। এছাড়া নির্বাচনী আচরণবিধি লঙ্ঘনের বিষয়ে লিখিত কোনো অভিযোগ পাওয়া যায়নি। মৌখিক অভিযোগগুলো ব্যাপারে ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে।

১৭টি ইউনিয়ন ও একটি পৌরসভা নিয়ে ঝিনাইদহ সদর উপজেলা গঠিত। মোট ভোটার ৩ লাখ ২ হাজার ৫৮৬ জন। এর মধ্যে পুরুষ ভোটার ১ লাখ ৪৯ হাজার ৮৫৪ জন এবং মহিলা ১ লাখ ৫২ হাজার ৭৩২ জন। ভোট কেন্দ্রের সংখ্যা ১৪৬টি।

১৪টি ইউনিয়ন ও একটি পৌরসভা নিয়ে গঠিত শৈলকুপা উপজেলা। এ উপজেলায় মোট ভোটার ২ লাখ ৪৮ হাজার ১১৭ জন। এর মধ্যে পুরুষ ১ লাখ ২৩ হাজার ৭২০ জন ও মহিলা ১ লাখ ২৪ হাজার ৩৯৭ জন। মোট ভোট কেন্দ্রের সংখ্যা ১১২টি। একটি পৌরসভা ও ১১টি ইউনিয়ন নিয়ে কালীগঞ্জ উপজেলা গঠিত। মোট ভোটার ১ লাখ ৯৩ হাজার ১৩৭ জন। পুরুষ ভোটার ৯৭ হাজার ১৫৬ জন ও মহিলা ৯৫ হাজার ৯৮১ জন। মোট ভোট কেন্দ্র ৮৩টি। একটি পৌরসভা ও ৫টি ইউনিয়ন নিয়ে কোটচাঁদপুর উপজেলা গঠিত। এ উপজেলায় ভোটার ৯৬ হাজার ৯৭৪ জন। এর মধ্যে পুরুষ ৪৮ হাজার ৫১১ ও মহিলা ৪৮ হাজার ৪৬৩ জন। ভোট কেন্দ্র ৪৭টি।