জেএসসি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস মানতে নারাজ কর্তৃপক্ষ

স্টাফ রিপোর্টার: ফাঁস হওয়া প্রশ্নেই নেয়া হয়েছে জেএসসির (জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট) ইংরেজি দ্বিতীয় পত্রের পরীক্ষা। গতকাল বৃহস্পতিবার সারাদেশে এ পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। গত চারদিন ধরে বাজারে প্রশ্নের আকারে যা পাওয়া যায়, তার বেশির ভাগ প্রশ্নই হুবহু মিলে যাওয়ার পরও শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং শিক্ষা বোর্ডের কর্মকর্তারা তাকে নিছক ‘সাজেশন’ বলেই উড়িয়ে দিচ্ছেন। পরীক্ষা বাতিল না করে যথারীতি চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তারা। শুধু তাই নয়, বিষয়টি তদন্ত করারও কোনো সিদ্ধান্ত নেয়া হয়নি।

অবাক হলেও সত্য যে, এবার জেএসসি পরীক্ষা শুরুর পর থেকেই প্রশ্নপত্র ফাঁসের গুঞ্জন ওঠে। আগামীকাল বিজ্ঞান বিষয়ের পরীক্ষা আছে। বাজারে সেই পরীক্ষার ‘কথিত প্রশ্ন’ও পাওয়া যাচ্ছে। অভিভাবকরা জানিয়েছেন, গণিতসহ অন্যান্য বিষয়ের প্রশ্নও তারা পেয়েছেন। এর আগে ইংরেজি প্রথমপত্রের পরীক্ষার প্রশ্নও ফাঁস হয়েছিলো বলে অভিভাবকরা দাবি করছেন। দেশের ১০টি শিক্ষা বোর্ডের ফোরাম ‘আন্তঃশিক্ষা বোর্ড সমন্বয় সাব-কমিটির আহ্বায়ক ও ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক তাসলিমা বেগম বলেন, ফাঁস বলে যে প্রশ্নপত্র পাওয়া গেছে, তার ১০টির মধ্যে মাত্র ৬টি মিলেছে। অভিজ্ঞ শিক্ষকরা সাজেশন করলে এরকম মিলে যেতেই পারে। এটা কাকতালীয়। তিনি পরীক্ষা বাতিলের প্রশ্নে বলেন, পরীক্ষা বাতিলের প্রশ্নই আসে না। বরং সামনের পরীক্ষাগুলো কী করে সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করা যায় সে বিষয়টিকেই অগ্রাধিকার দিচ্ছেন তারা। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, তারা কোনো তদন্ত কমিটিও গঠন করেননি। তবে শিক্ষামন্ত্রীর সাথে আলাপ করে পরবর্তীতে এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।

জেএসসি পরীক্ষার প্রশ্নফাঁসের গুজবের বিষয়টি গত কয়েকদিন ধরে ‘টক অব দ্য ক্যাপিটাল’-এ পরিণত হয়েছে। বিশেষ করে গত বৃহস্পতিবার ইংরেজি প্রথমপত্রের পরীক্ষার আগে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে কথিত প্রশ্ন ছড়িয়ে পড়ে। পরীক্ষার দিন সকালে সংশ্লিষ্ট এলাকায় স্কুলে স্কুলে অভিভাবকদের মধ্যে এ নিয়ে আলোচনা আর প্রশ্ন বিনিময় শুরু হয়। প্রশ্নবঞ্চিত অভিভাবকরাই বিষয়টি গণমাধ্যমের নজরে আনেন এবং পরের পরীক্ষাগুলোর প্রশ্ন সংগ্রহে অনেকে মরিয়া হয়ে ওঠে। সাংবাদিকদের কাছে গত ১০ অক্টোবরই ইংরেজি দ্বিতীয়পত্রের প্রশ্নপত্র হিসেবে কিছু প্রশ্ন কারও কাছে এসএমএসে আবার কারও কাছে প্রিন্টেড কপিই চলে আসে। এরপর কয়েকটি জাতীয় দৈনিক গুজব আকারে তা বৃহস্পতিবারের সংখ্যায় প্রকাশ করে। পরীক্ষার পর মূল প্রশ্নপত্রের সাথে তার মিল পাওয়া যায়। এরপর সাংবাদিকরা বিষয়টি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব (মাধ্যমিক) এএস মাহমুদের নজরে নেন। তিনি ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের সঙ্গে যোগাযোগ করে বিকালেই তাৎক্ষণিক মিটিং আহ্বান করেন।

জানা গেছে, ওই মিটিংয়ে ঢাকা বোর্ডের চেয়ারম্যান ও পরীক্ষা নিয়ন্ত্রকের পক্ষ থেকে বিষয়টিকে ‘নিছক সাজেশন’ হিসেবে প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করা হয়। একই সাথে তারা ‘২০ লাখ শিক্ষার্থীবহুল অনেক বড় পরীক্ষা’, ‘চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং যথাসময়ে পরীক্ষা শেষ না করতে পারার আশংকা’ ইত্যাদি বিবেচনায় পরীক্ষা বাতিল না করার সিদ্ধান্ত হয়।

ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান বলেন, তারা আপাতত পরীক্ষা বাতিলের চিন্তাভাবনা করছেন না। তবে গুজব হোক আর সাজেশনের ৬০ ভাগ মিলুক- যাই হোক, তা কেন হলো তা তারা খতিয়ে দেখছেন। একই বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক অধ্যাপক শেখ মো. ওয়াহিদুজ্জামান প্রশ্ন ফাঁস না হওয়ার পক্ষে জোরালো যুক্তি তুলে ধরে বলেন, গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রশ্নপত্র তারা মিলিয়ে দেখেছেন, মাত্র ৬০ ভাগ মিলেছে। যদি ফাঁসই হবে, তাহলে শতভাগ প্রশ্ন কেন মিললো না। ‘তাহলে প্রিপজিশন প্রশ্নের জন্য পাঠ্যবই থেকে দেয়া একটি মাত্র প্যারাগ্রাফ বা সাফিক্স-প্রিফিক্সের মতো বিষয়গুলো সাজেশন দিলেই হুবহু তা কীভাবে মিলতে পারে’- এমন এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, অভিজ্ঞ শিক্ষকরা সাজেশন দিলে তা মিলে যেতে পারে।

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা বলেন, প্রশ্নফাঁসের ঘটনা তারা উড়িয়ে দিলেও বিষয়টি গুরুত্বের সাথে নিয়েছেন। ইংরেজি প্রথম পত্রের পর দ্বিতীয়পত্রের প্রশ্ন ফাঁসের অভিযোগ উত্থাপিত হওয়ায় তারা রীতিমতো নড়েচড়ে বসেছেন। ওই সূত্র জানায়, বৃহস্পতিবার বিকেলে এ নিয়ে আয়োজিত মিটিঙে বিস্তারিত আলাপ হয়। তাতে ঘটনায় জড়িত হিসেবে প্রাথমিকভাবে পেশাদার বিভিন্ন কোচিং সেন্টার, কোচিংবাজ বা কোচিঙের মালিক বিভিন্ন শিক্ষক, বিজি প্রেস এবং মাঠ পর্যায়ের ট্রেজারিকে সন্দেহের দৃষ্টিতে দেখছেন। এ বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য উদঘাটনে মন্ত্রণালয় থেকে বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা এবং পুলিশকে অনুরোধ করার চিন্তাভাবনা চলছে। শিক্ষামন্ত্রী সিলেট থেকে ও শিক্ষাসচিব প্যারিস থেকে ঢাকায় ফিরলে এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে বলে জানা গেছে।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে যুগ্ম সচিব (মাধ্যমিক) এএস মাহমুদ বলেন, তারা একটি অভিযোগ পেয়েছেন। বিষয়টি নিয়ে শিক্ষা বোর্ডের কর্মকর্তাদের সাথে আলোচনা হয়েছে। মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ফিরলে এ ব্যাপারে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।

ইংরেজি দ্বিতীয়পত্রের প্রশ্ন: গত কয়েকদিন ধরে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে প্রশ্নপত্রের হাতে লেখা কপি বিক্রি হতে দেখা গেছে। রাজধানীতে হাতে লেখা দুটি সেটের ফাঁস হওয়া প্রশ্ন পানির দরে ৫০ থেকে ১০০ টাকায় বিক্রি হয়। এ ছাড়া মুঠোফোনের খুদে বার্তার মাধ্যমে সারাদেশে এ প্রশ্ন ছড়িয়ে দেয়া হয়। এর আগে প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগের মধ্যেই বাংলা প্রথমপত্র, বাংলা দ্বিতীয়পত্র ও ইংরেজি প্রথম পত্রের পরীক্ষা নেয়া এবং কথিত ওইসব প্রশ্নের সাথে পরীক্ষার প্রশ্নের হুবহু মিলের কারণে অভিভাবকরাও ইংরেজি দ্বিতীয়পত্রের প্রশ্নের পেছনে হণ্যে হয়ে ঘুরে বেড়ান। পরীক্ষার আগে সাংবাদিকদের কাছে ইংরেজি দ্বিতীয়পত্রের দু সেট প্রশ্নের কপি আসে।

জানা গেছে, সারাদেশে একই প্রশ্নপত্রে পরীক্ষা হয়। এর জন্য বোর্ড সমন্বয় কমিটি প্রশ্নপ্রণেতাদের মাধ্যমে মোট চারটি সেট প্রশ্ন তৈরি করে। যার মধ্যে দুটি সেট ছাপানো হয়। বাকি দুটি সিলগালা করে রেখে দেয়া হয়। বিষয়টি নিশ্চিত করে ঢাকা বোর্ডের চেয়ারম্যান বলেন, বিশেষ পরিস্থিতি হলে সেগুলো ছাপিয়ে পরীক্ষা নেয়া হয়। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, পরীক্ষার আগের রাতে তিনিও কথিত প্রশ্নের দুটি সেটই পেয়েছেন। ‘দুটি সেটই তাহলে আগে মিলিয়ে দেখেছেন কিনা’- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, তার কাছে তা সাজেশনের বেশি কিছু মনে হয়নি।
বৃহস্পতিবারের পরীক্ষা নেয়া হয় ‘ক’ সেটে। ফাঁস হওয়া প্রশ্নের সাথে মূল প্রশ্নের যদিও ৬০ ভাগ মিলেছে বলে কর্তৃপক্ষ দাবি করেছে, তবে দেখা গেছে, মিলেছে ৭০ ভাগ। এর মধ্যে গ্রামার অংশে ১ নম্বর প্রশ্নে অৎঃরপষব, ৩ নম্বর প্রশ্নে ঞধনষব, ৪ নম্বর প্রশ্নে ওহফরৎবপঃ ংঢ়ববপয, ৬ নম্বর প্রশ্নে জব-ৎিরঃব/ঈধঢ়রঃধষরুধঃরড়হ, ৭ নম্বর প্রশ্নে ঝঁভভরীবং ধহফ চৎবভরী. পরীক্ষায় কমপজিশন অংশে ঈড়সঢ়ড়ংরঃরড়হ ছাপা হওয়া প্রশ্নের সাথে হুবহু মিলে গেছে।

এ প্রসঙ্গে অধ্যাপক তাসলিমা বেগম বলেন, তাতে প্রশ্ন ফাঁস হয়েছে বোঝায় না। ওই ফাঁস হওয়া প্রশ্নকে তিনি শর্ট সাজেশন বলে দাবি করেন।

বিজ্ঞানের কথিত প্রশ্ন: বৃহস্পতিবার বিকেলে সাধারণ বিজ্ঞানের সৃজনশীল প্রশ্নপত্রের নামে একটি ছাপানো কপি যুগান্তরে চলে আসে। ওই প্রশ্নে ৬০ নম্বরের দুই ঘণ্টা ২০ মিনিটের এ পরীক্ষায় ৯টি প্রশ্নের মধ্যে যে কোনো ছয়টি প্রশ্নের উত্তর করতে বলা হয়েছে। ১ নম্বর প্রশ্নে (ক) তড়িৎ বিশ্লেষ্য কাকে বলে? (খ) প্রশমন বিক্রিয়া ব্যাখ্যা কর। (গ) চুনের পানির বিক্রিয়া সমীকরণসহ লিখ। বিক্রিয়ার তুলনা কর। ২ নম্বর প্রশ্নে (ক) ভিনেগারে কোন এসিড বিদ্যমান? (খ) ‘অ্যামোনিয়া একটি ক্ষারক’ ব্যাখ্যা কর। (গ) অ এর সাথে ঈধঈড়৩ বিক্রিয়ায় কি উৎপন্ন হয়? সমীকরণসহ লিখ। (ঘ) পাকস্থলীর এসিডিটি দূরীকরণে ই যৌগটির ভূমিকা বিশ্লেষণ কর। ৩ নম্বর প্রশ্নে একটি চিত্র উল্লেখ করে প্রশ্ন করা হয়েছে (ক) ছায়াপথ কাকে বলে? (খ) ছ এর কয়টি উপগ্রহ রয়েছে? (গ) যোগাযোগের ক্ষেত্রে জ এর গুরুত্ব ব্যাখ্যা কর। উদ্দীপককে জ এর চলার কৌশল বিশ্লেষণ কর। ৪ নম্বর প্রশ্নে এক্স ভরের একটি বস্তুকে চাঁদে নিয়ে ওজন মাপা হলে ওজন ৩০ নিউটন পাওয়া গেল। (ক) ভর কাকে বলে? (খ) লিফটে কখন বস্তু বস্তুহীন অনুভব করবে? ব্যাখ্যা কর। (গ) উদ্দীপককে ঢ এর মান নির্ণয় কর। (ঘ) চাঁদের ওজনের কি পরিবর্তন ঘটলো? এর পরিবর্তনের কারণ ব্যাখ্যা কর।
৫ নম্বর প্রশ্নে ইমান তান বাসায় দুটি বাল্ব ও একটি ফ্যানকে একটি বর্তনীতে যুক্ত করে কিছুদিন ব্যবহার করার পর একদিন সুইচ চালুর পর ……… (ক) ভোল্টমিটার কাকে বলে? (খ) ওহমের সূত্রটি ব্যাখ্যা কর। (গ) উদ্দীপকের বর্তনীটি একে এর বৈশিষ্ট্য ব্যাখ্যা কর। (ঘ) উদ্দীপকের বাল্ব ও ফ্যান বর্তনীতে কিভাবে সংযোজিত হলে ভাল বাল্পটিকে জ্বালানো যেত? যুক্তিসহ বিশ্লেষণ কর। ৬ নম্বর প্রশ্নে ইলিশ মাছ জীবনের সম্পূর্ণ অংশ পানিতে কাটায় ……..। (ক) অ্যাসিডিয়ার দেহে নটোকর্ডের অবস্থান লিখ। (খ) কেঁচো ও মানুষের মধ্যে পার্থক্য লিখ (গ) উদ্ধৃতাংশের উদ্ভিদে কোন ধরনের অঙ্কুরোদগম ঘটবে? ব্যাখ্য কর। (ঘ) ফলটি উৎপাদনে নিষেক কৌশল বিশ্লেষণ কর।

৮ নম্বর প্রশ্নে চিত্র উল্লেখ করে (ক) ফল পাকাতে কোন জৈব পদার্থ সাহায্য করে? (খ) উদ্ভিদ জীবনে ফ্লোরিজেন এর গুরুত্ব ব্যাখ্যা কর। (গ) অ অংশ সূর্যালোকের প্রতি কোন ধরনের চলন প্রদর্শন করবে ব্যাখ্যা কর। (ঘ) অ অংশ উপস্থিত হরমোনটি গুরুত্ব বিশ্লেষণ কর। ৯ নং প্রশ্নে আছে ব্যাঙাচি, সবুজ উদ্ভিদ, বক, মানুষ, শামুক, হাঁস, টাকি মাছ, শেওলা।

প্রসঙ্গত, অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের এই সমাপনী পরীক্ষায় এবার দেশের ২৭ হাজার ৭৪৮টি স্কুল ও মাদরাসার ১৯ লাখ ২ হাজার ৭৪৬ জন শিক্ষার্থী অংশ নিচ্ছে। এর মধ্যে জেএসসিতে ১৫ লাখ ৮৭ হাজার ৩১৩ জন এবং জেডিসিতে তিন লাখ ১৫ হাজার ৪৩৩ জন শিক্ষার্থী অংশ নিচ্ছে।