জীবন রক্ষাকারী ওষুধে ভেজাল

 

স্টাফ রিপোর্টার: জীবন রক্ষাকারী ওষুধে ভেজাল মেশানোর অমার্জনীয় অপরাধ এখনও করেই চলেছে বেশ কয়েকটি ওষুধ কোম্পানি। সমপ্রতি স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতে জমা দেয়া বিশেষজ্ঞ কমিটির চূড়ান্ত তদন্ত প্রতিবেদনের সুপারিশ অনুযায়ী ভেজাল ওষুধ তৈরির অপরাধে ২০টি ওষুধ উত্পাদনকারী প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স বাতিলের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।

জানা গেছে, এসব প্রতিষ্ঠানের মধ্যে কেউ কেউ ক্যান্সারের মতো মারণঘাতী ওষুধেও ভেজাল দিচ্ছে। এমনকি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দিকনির্দেশনা না মেনে তৈরি করা হচ্ছে নিম্নমানের এন্টিবায়োটিক। বিশেষজ্ঞ তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে এমন ভয়াবহ চিত্র উঠে এসেছে।

অপরদিকে ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরের একশ্রেণির দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা নিম্নমানের ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান থেকে নিয়মিত মাসোহারা পেয়ে থাকেন বলেও অভিযোগ পাওয়া গেছে। তাদের নাকের ডগায় এসব ভেজাল ওষুধ তৈরি হয়ে আসছে ও বাজারজাত হচ্ছে। কোনো কোনো কর্মকর্তা সেই সব প্রতিষ্ঠানের পরামর্শক হিসেবে নিয়োজিত রয়েছেন বলেও জানা গেছে।

অধ্যাপক আবম ফারুকের নেতৃত্বাধীন বিশেষজ্ঞ তদন্ত কমিটি দেশের ৮৪টি ওষুধ উত্পাদনকারী প্রতিষ্ঠান সরেজমিন পরিদর্শন শেষে এই প্রতিবেদন তৈরি করে। প্রতিবেদনের আলোকে ২০টি ওষুধ উত্পাদনকারী প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স বাতিল ছাড়াও ১৪টি কোম্পানির সব ধরনের এন্টিবায়োটিক (নন-পেনিসিলিন, পেনিসিলিন ও সেফালোস্পোরিন গ্রুপ) ওষুধ উত্পাদনের অনুমতি বাতিল এবং ২২টি কোম্পানির পেনিসিলিন ও সেফালোস্পোরিন গ্রুপের এন্টিবায়েটিক উত্পাদনের অনুমতি বাতিল করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে দ্রুত এসব সুপারিশ বাস্তবায়িত না হলে এবং অভিযুক্ত কোম্পানিগুলোর বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা না হলে দেশের স্বাস্থ্যখাতে ভয়াবহ বিপর্যয় নেমে আসবে এমন আশংকার কথা বলা হয়। এরপরই ওই কোম্পানিগুলোর লাইসেন্স বাতিলের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। অবিলম্বে বাতিলের আদেশ জারি করা হবে

জানা গেছে, ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির  নির্বাচনের পর দশম জাতীয় সংসদ গঠিত হলে সে বছরের ২০ সেপ্টেম্বর ভেজাল এবং নিম্নমানের ওষুধ উত্পাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো চিহ্নিত করতে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি ৫ সদস্যের একটি বিশেষজ্ঞ তদন্ত কমিটি গঠন করে। বিশেষজ্ঞ দল গত দেড় বছরে ৮৪টি ওষুধ কারখানা পরিদর্শন করে। এর মধ্যে নতুন ১৫টি এবং পুরনো ৬৯টি প্রতিষ্ঠান রয়েছে। দীর্ঘ তদন্ত শেষে গত ১ ফেব্রুয়ারি তারা তাদের প্রতিবেদন সংসদীয় কমিটির কাছে জমা দেয়। গতকাল বুধবার অনুষ্ঠিতব্য সংসদীয় কমিটির বৈঠকে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়। পরে লাইসেন্স বাতিলের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।

প্রতিবেদনে মানসম্পন্ন ওষুধ উত্পাদনে চূড়ান্তভাবে ব্যর্থ হওয়ায় যে ২০টি কোম্পানির উত্পাদনের লাইসেন্স বাতিল করা হয়েছে সেগুলো হল- এক্সিম ফার্মাসিউটিক্যালস, এভার্ট ফার্মা, বিকল্প ফার্মাসিউটিক্যালস, ডলফিন ফার্মাসিউটিক্যালস, ড্রাগল্যান্ড, গ্লোব ল্যাবরেটরিজ, জলপা ল্যাবরেটরিজ, কাফমা ফার্মাসিউটিক্যালস, মেডিকো ফার্মাসিউটিক্যালস, ন্যাশনাল ড্রাগ ফার্মা, নর্থ বেঙ্গল ফার্মাসিউটিক্যালস, রিমো কেমিক্যালস, রিদ ফার্মাসিউটিক্যালস, স্কাইল্যাব ফার্মাসিউটিক্যালস, স্পার্ক ফার্মাসিউটিক্যালস, স্টার ফার্মাসিউটিক্যালস, সুনিপুণ ফার্মাসিউটিক্যালস, টুডে ফার্মাসিউটিক্যালস, ট্রপিক্যাল ফার্মাসিউটিক্যালস এবং ইউনিভার্সেল ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেড।

এছাড়াও নন-পেনিসিলিন, পেনিসিলিন ও সেফালোস্পোরিন গ্রুপের ওষুধ উত্পাদনের অনুমতি বাতিল করা ১৪টি কোম্পানি হচ্ছে- আদ-দ্বীন ফার্মাসিউটিক্যালস, আলকাদ ল্যাবরেটরিজ, বেলসেন ফার্মাসিউটিক্যালস, বেঙ্গল ড্রাগস অ্যান্ড কেমিক্যালস, ব্রিস্টল ফার্মা, ক্রিস্টাল ফার্মাসিউটিক্যালস, ইন্দো-বাংলা ফার্মাসিউটিক্যালস, মিল্লাত ফার্মাসিউটিক্যালস, এমএসটি ফার্মা অ্যান্ড হেলথকেয়ার, অরবিট ফার্মাসিউটিক্যালস, ফার্মিক ল্যাবরেটরিজ, ফিনিক্স কেমিক্যাল ল্যাবরেটরি, রাসা ফার্মাসিউটিক্যালস এবং সেভ ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেড।

পেনিসিলিন ও সেফালোস্পোরিন গ্রুপের ওষুধ উত্পাদনের অনুমতি বাতিল করা ২২টি কোম্পানি হচ্ছে- আমিকো ফার্মাসিউটিক্যালস, অ্যাজটেক ফার্মাসিউটিক্যালস, বেঙ্গল টেকনো ফার্মা, বেনহাম ফার্মাসিউটিক্যালস, সেন্ট্রাল ফার্মাসিউটিক্যালস, ডিসেন্ট ফার্মা, ড. টিআইএম’স ল্যাবরেটরি, গ্লোবেক্স ফার্মাসিউটিক্যালস, গ্রিনল্যান্ড ফার্মাসিউটিক্যালস, ইনোভা ফার্মাসিউটিক্যালস, ম্যাকস ড্রাগস, মেডিমেট ল্যাবরেটরিজ, মডার্ন ফার্মাসিউটিক্যালস, মিস্টিক ফার্মাসিউটিক্যালস, ন্যাশনাল ল্যাবরেটরিজ, অর্গানিক হেলথ কেয়ার, ওয়েস্টার ফার্মা, প্রিমিয়ার ফার্মাসিউটিক্যালস, প্রাইম ফার্মাসিউটিক্যালস, সীমা ফার্মাসিউটিক্যালস, ইউনাইটেড কেমিক্যাল অ্যান্ড ফার্মাসিউটিক্যালস এবং হোয়াইট হর্স ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেড। এছাড়া টেকনো ড্রাগের তিনটি কারখানার ক্যান্সার ও জন্ম নিয়ন্ত্রণের ওষুধ উত্পাদনের অনুমতি বাতিল  করা হয়েছে।

স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী শেখ ফজলুল করিম সেলিমের সভাপতিত্বে গতকাল বুধবারের বৈঠকে কমিটির সদস্য স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম, স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ প্রতিমন্ত্রী জাহিদ মালেক, সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী ডা. আ. ফ. ম রুহুল হক, স্বাস্থ্য সচিব সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম, স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. দীন মোহাম্মদ নুরুল হক, ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরের মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মোস্তাফিজুর রহমান, বিশেষজ্ঞ পরিদর্শন দলের সভাপতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওষুধ প্রযুক্তি বিভাগের প্রফেসর আ.ব.ম ফারুক, ওষুধ শিল্প সমিতির সভাপতি নাজমুল হাসান পাপন প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।

স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম এ প্রসঙ্গে বলেন, দেশে নিম্নমানের ও ভেজাল ওষুধ তৈরি করতে দেয়া হবে না। যেসকল প্রতিষ্ঠান এসব ওষুধ তৈরিতে জড়িত থাকবে তাদের কারখানা বন্ধ করে দেয়া হবে। এছাড়া আইনানুগ ব্যবস্থাও গ্রহণ করা হবে।