জীবন নামের রেলগাড়িটার দু দিকে দু স্টেশন : দোলনা থেকে করে শুরু খাটিয়াতে সমাপন

নজরুল ইসলাম: বছর দশেক আগে স্বামী করেছে ত্যাগ। মাথা গোঁজার ঠাঁই না পেয়ে আবাসনে হয়েছে আশ্রয়স্থল। প্রতিদিন সকালে ভাঙা একটি হুইল চেয়ারে মেয়ে মিতুকে বসিয়ে জীবন জীবিকার সন্ধানে বাড়ি থেকে বের হন মা তানিয়া। মেয়ের ভাঙা হুইল চেয়ার ঠেলতে ঠেলতে সে আজ বড় ক্লান্ত। নিজেকে নিজের বুঝের জন্য এবং অনুরোধ পেলে শোনান জীবনের প্রিয় গান ‘জীবন নামের রেলগাড়িটার দু দিকে দু স্টেশন, দোলনা থেকে করে শুরু খাটিয়াতে সমাপন’। কষ্টের দিন শেষ করতে বিত্তবানদের সহযোগিতা পেলে বাড়ির সামনে বসাবেন দোকান। কারণ বয়স হচ্ছে মিতুকে আর বেশি দিন নিয়ে ঘুরতে পারবে না মনে শুধু এ শঙ্কা।

শুক্রবার দোকানি ও পথচারীরা অসহায়, ভিক্ষুক ও সাহায্য প্রার্থীদের একটু আলাদাভাবে দেখেন। অন্যান্য দিনের তুলনায় গতকাল  একটু সকালেই রওনা দেন স্বামী পরিত্যক্তা চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলার বেগমপুর ইউনিয়নের রজনীগন্ধা আবাসনে আশ্রয় নেয়া তানিয়া। সাথে নিয়েছেন ভাঙাচোরা হুইল চেয়ারে বসা শারীরিক প্রতিবন্ধী ১২ বছরের মেয়ে মিতুকে। দর্শনা বাসস্ট্যান্ডে জেসমির অটোর সামনে হুইলচেয়ার ঠেলতে ঠেলতে এসে হাত পাততেই আমাদের এই প্রতিনিধি জিজ্ঞাসা করলেন, ‘হুইল চেয়ারে বসা আপনার ছেলের এমন অবস্থা কবে থেকে? উত্তর দেয়ার আগেই দু চোখ দিয়ে ফোঁটায় ফোঁটায় ঝরছে পানি। বললেন, ছেলে না এটা আমার মেয়ে। সেইসাথে শোনালেন তার কষ্টের কথা। চুয়াডাঙ্গা পৌর শহরের বুজরুকগড়গড়ি পাড়ায় বাড়ি। মাথা গোঁজার ঠাঁই না হওয়ায় চুয়াডাঙ্গার এক নেতার সুপারিশে আবাসনে আশ্রয় নিই বছর সাতেক আগে। এ ধরায় রক্তের সম্পর্কের তেমন কেউ নেই আমার। মেয়ে মিতু ও ছেলে হৃদয়ের বয়স ১০ বছর। বড় স্বপ্ন নিয়ে ঘর বেধেছিলাম সোহেল ওরফে মালেক নামের একজনের সাথে। বছর দশেক আগে সেও ছেড়ে চলে গেছে। খোঁজখবর নেয় না। শুনেছি আর একজনকে নিয়ে সংসার বেধেছে। ছেলেকে বাসায় রেখে মেয়ে মিতুকে সাথে নিয়ে যেদিন শরীরটা ভালো থাকে সকালে বের হই জীবন জীবিকার সন্ধানে। কখন বাড়ি ফিরবো বলতে পারছি না। তবে এতোটুকু জানি; যখনই হোক বাড়ি ফিরতে হবে। প্রতিদিন যা আয় রোজগার হয় তাই দিয়ে সংসার চলে। মিতুর কথা জিজ্ঞাসা করতেই জানান, জন্মের সময় থেকেই তার এ অবস্থা। অর্থাভাবে দিতে পারিনি চিকিৎসা। নিজে চলবো নাকি ছেলে-মেয়ের চিকিৎসা করাবো। বিধাতা কপালে যা লিখেছে, তা কেউ খণ্ডাতে পারবে না। লোকের কাছে হাত পাততে লজ্জা লাগে। না পেতে উপায়ও নেই। তাই মুখ ঢেকে যাই মানুষের দুয়ারে দুয়ারে। মানুষের কাছে হাত পেতে কিছু নেয়া এ যে কি কষ্টের তা বোঝাতে পারবো না। শুধু এতোটুকু বলবো, আমার মতো যেন কারো না হয়। বয়স হয়ে যাচ্ছে। এ ভাঙা হুইল চেয়ার বইতে বইতে আমার বুক ও হাতে যন্ত্রণা করে। পেটের যন্ত্রণার কাছে বুকের হাতের যন্ত্রণা তেমন কিছু মনে হয় না। এসব বলতে বলতে বললেন, তা হলে একটা গান শোনাই। তখনও অঝরে ঝরছে চোখের পানি। শোনালেন তার প্রিয় এ গানখানি ‘জীবন নামের রেলগাড়িটার দু দিকে দু স্টেশন, দোলনা থেকে করে শুরু খাটিয়াতে সমাপন’। সব প্রশ্নের উত্তর রয়েছে আমার এ গানের মধ্যে। আর পারি না। কারো সহযোগিতা পেলে বাড়িতে একটি দোকান দিতাম। মিতুকে বহন করা আমার জন্য অনেক কষ্ট হয়ে পড়েছে। মিতুর মায়ের এ কষ্ট হয়ত দূর করার মতো সামর্থ এই প্রতিনিধির নেই। তবে লাঘব করতে পারলে ধন্য হবো।