জীবননগরের আন্দুলবাড়িয়ায় ভুয়া প্রকল্প কাগজে-কলমে বাস্তবায়ন

ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে উপজেলা নির্বাহী অফিসারের ক্ষোভ প্রকাশ

নারায়ণ ভৌমিক: জীবননগরের আন্দুলবাড়িয়ার অনন্তপুর কাজি মসজিদে সোলার প্যানেল নির্মাণে বিন্দুমাত্র কাজ না করে অর্থ হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগ পেয়ে জীবননগর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নুরুল হাফিজ কাজি মসজিদটি সরেজমিনে পরির্দশন করেন। গতকাল রোববার বেলা সাড়ে ১০টার দিকে তিনি মসজিদটি পরিদর্শনকালে মসজিদের ভেতর ও বাইরে ঘুরে ফিরে দেখেন ও উপস্থিত জনতার সাথে কথা বলেন। পরিদর্শনকালে তিনি মসজিদে সোলার প্যানেল নির্মাণ কাজের কোনো আলমত না পেয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন। এ সময় উপজেলা প্রকল্প কর্মকর্তার অফিস সহকারী সাইফুল ইসলামের নিকট প্রকল্প সর্ম্পকে জানতে চাইলে তিনি সন্তোষজনক কোনো জবাব দিতে পারেননি। উপজেলা নিবার্হী কর্মকর্তা এক প্রশ্নের উত্তরে বলেন, প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজি রকিব উদ্দিন আহম্মদ ও মসজিদ প্রতিষ্ঠাতা কাজি সিরাজ বিষয়টি নিয়ে কথা বলেছেন। ঘটনাটি তদন্ত করে দেখা হচ্ছে। তদন্তে প্রমাণিত হলে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে তিনি জানান। আন্দুলবাড়িয়ার অনন্তপুর কাজি মসজিদ ও আন্দুলবাড়িয়া খাপাড়ার বাবু খানের আমবাগান থেকে বাজদিয়া রাস্তা সংস্কারের শতভাগ কাজ দেখিয়ে অর্থ হাতিয়ে নেয়ার সংবাদ গত শুক্রবার দৈনিক মাথাভাঙ্গা পত্রিকায় প্রকাশিত হলে প্রশাসনসহ বিভিন্ন মহলে ব্যাপক আলোচিত হয়ে ওঠে। এলাকার সচেতন মহল ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের নামে ভুয়া প্রকল্প দাখিল করে অর্থ হাতিয়ে নেয়ার সাথে জড়িতদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানান। এ ঘটনা ফাঁস হয়ে পড়লে উপজেলা প্রকল্প কর্মকতার্র অফিস সহকারী সাইফুল ইসলাম ঘটনাটি ধামাচাপা দিতে বিভিন্ন মহলে দৌড়ঝাঁপ শুরু করেছেন। তিনি তড়িঘড়ি একটি বেসরকারি সংস্থা দিয়ে কাজি মসজিদে সোলার প্যানেল বিদুতায়নকরণের কাজ করতে গেলে স্থানীয় জনতার তোপের মুখে পড়েন। জনতার বাঁধার মুখে সংস্থাটির শ্রমিক-কর্মচারীরা ফিরে গেছেন। স্থানীয় জনতার দাবি, ঘটনার সাথে কারা জড়িত তাদের নাম পরিচয় উদঘটন না হওয়া পর্যন্ত মসজিদে কোনো কাজ করতে দেয়া হবে না।

এদিকে উপজেলা প্রকল্প অফিস থেকে গত ৫ দিনে কোনো তথ্য মেলেনি। তথ্য অধিকার আইনে এ প্রতিবেদকের আবেদনপত্রে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নুরুল হাফিজ প্রকল্প কর্মকর্তাকে ওই প্রকল্পের যাবতীয় তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করার নির্দেশ দিলেও কোনো তথ্য প্রকল্প অফিস থেকে দেয়া হয়নি ।এ নির্দেশপত্র নিয়ে অফিসে গিয়ে কাউকে পাওয়া যায়নি। অফিসে না পেয়ে উপজেলা ভারপ্রাপ্ত প্রকল্প কর্মকতা (পিআইও) সাথে মোবাইলফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি ফোন রিসিভ করেননি। অফিস সহকারী সাইফুল ইসলামের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বুধ ও বৃহস্পতিবার নানা টালবাহনা করে রোববার আসতে বলেন। গতকাল রোববার যোগযোগ করা হলে তিনি এ প্রতিবেদককে বলেন, প্রকল্প কর্মকর্তা ঢাকায় অবস্থান করছেন। তিনি অফিসে না আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। কবে আসবে এ প্রতিবেদকের এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, বলতে পারবো না।

জানা গেছে, চলতি অর্থবছরে গ্রামীণ অবকাঠামো উন্নয়ন (কাবিটা) প্রকল্পর আওতায় উপজেলার আন্দুলবাড়িয়া ইউনিয়নের অনন্তপুর কাজি মসজিদে সোলার প্যানেল নির্মাণে আড়াই লাখ টাকা ও আন্দুলবাড়িয়া খাপাড়ার বাবু খানের আমবাগান থেকে বাজদিয়া রাস্তা সংস্কারে আড়াই লাখ টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়। উপজেলা প্রকল্প কর্মকর্তা ৩০ জুনের মধ্যে কাজ সম্পূর্ণ করা নির্দেশ দেন। অভিযোগ উঠেছে, প্রকল্প ২টির পিআইসি উপজেলা প্রকল্প কর্মকর্তাকে ম্যানেজ করে প্রকল্পের কোনো কাজ না করে শতভাগ কাজের অগ্রগতির রিপোট দাখিল করে ৫ লাখ টাকা হাতিয়ে নেন। চুয়াডাঙ্গা জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা গোলাম সরোয়ার শতভাগ কাজের অগ্রগতির রিপোর্ট পেয়ে তিনি গত ২৩ আগস্ট সরেজমিনে আন্দুলবাড়িয়ার অনন্তপুর কাজি মসজিদ পরিদর্শন করেন। পরিদর্শনকালে তিনি সংশ্লিষ্ট মসজিদে সোলার প্যানেল নির্মাণের কোনো আলামত না পেয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন।। সন্দেহ দেখা দিলে তিনি আন্দুলবাড়িয়া খাপাড়ার আমতলা থেকে বাজদিয়া রাস্তা সংস্কারের কাজ পরিদর্শন করেন। পরিদর্শনকালে তিনি উভয় প্রকল্পের কাজের আলামত না পেয়ে স্থানীয়দের সাথে কথা বলেন।

স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, গত কয়েক বছরের মধ্যে এ রাস্তার মাটি ভরাটের কোনো কাজ হয়নি। এ ব্যাপারে জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকতার গোলাম সরোয়ার ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করে মাথাভাঙ্গা এ প্রতিবেদককে বলেন, ২টি প্রকল্পের শতভাগ কাজের অগ্রগতির রিপোট পেয়েছি। আমি শুনেছি আন্দুলবাড়িয়ার অনন্তপুর কাজি মসজিদটি আমাদের প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজি রকিব উদ্দিন আহম্মদের পরিবারের। সেজন্য কাজের কোন ত্রুটি-বিচ্যুতি আছে কি-না  তা দেখতে সরেজমিনে পরিদর্শন করি। সেখানে গিয়ে কাজের কোনো আলামত পাইনি। মসজিদ কমিটি ও স্থানীয়দের সাথে কথা বললে তারা জানান, এ ধরনের কোনো প্রকল্পের কাজ করতে কখনও কেউ এখানে আসেননি। প্রকল্পের পিআইসি কে? এ প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, নামধাম আমার জানা নেই। জীবননগগর উপজেলা প্রকল্প কর্মকর্তা (পিআইও) বলতে পারেন।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দামুড়হুদা উপজেলা প্রকল্প কর্মকর্তা  (পিআইও)  আশরাফ আলী জীবননগর উপজেলার ভারপ্রাপ্ত প্রকল্প কর্মকর্তা হিসেবে অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করছেন। অফিসে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, তিনি সপ্তাহে সোম ও বুধবার অফিস করেন। ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আশরাফ আলীকে অফিসে না পেয়ে গত কয়েক দিনে এ প্রতিবেদক মোবাইলফোনে একাধিকবার কল দিলে তিনি রিসিভ করেননি। তথ্য অনুসন্ধান নিয়ে জানা গেছে, ভারপ্রাপ্ত প্রকল্প কর্মকর্তা আশরাফ আলী অফিস নিয়মিত না করায় অফিস সহকারী সাইফুল ইসলাম দীর্ঘদিন যাবত দাপটের সাথে উপজেলা প্রকল্প অফিস নিয়ন্ত্রণ করে আসছেন।

কে এই সাইফুল: জীবননগর উপজেলার ধোপাখালী গ্রামের মৃত আমির মল্লিক মাস্টারের ছেলে সাইফুল ইসলাম। তিনি উপজেলা প্রকল্প অফিসের অফিস সহকারী পদে কর্মরত। তিনি এ উপজেলার বাসিন্দা হয়ে দীর্ঘ ৭ বছর যাবত বহাল তবিয়তে জীবননগর উপজেলার পিআইও অফিসের অফিস সহকারী পদে দায়িত্ব পালন করছেন। সরকারি নিয়মনীতি উপেক্ষা করে তিনি এ উপজেলায় দীর্ঘ ৭ বছর প্রভাব দেখিয়ে উপজেলা প্রকল্প অফিস নিয়ন্ত্রণ করে আসছেন। সূত্র জানায়, তিনি বিএনপিপন্থি কাজকর্ম করায় বর্তমান ক্ষমতাসীনদের ভয়ে তিনি ২০০৮ সালে সংসদ নির্বাচনের সময় অন্যত্র বদলি হন। সেখানে কিছুদিন চাকরি করার পর খুঁটির জোরে ফের জীবননগর  উপজেলায় প্রকল্প অফিসে যোগদান করেন।

সূত্রমতে, যখন যে দল ক্ষমতায় আসে তখন সেই দলের নেতৃস্থানীয়দের ম্যানেজ করে প্রভাব দেখিয়ে নানা দুনীতির সাথে জড়িয়ে পড়েন তিনি। যেকোনো প্রকল্পের পিআইসিরা তার মোটা অঙ্কের ঘুষ না দিলে ফাইলের অনুমতি মেলে না। এর বাইরে রয়েছে তার বরাদ্দকৃত গম-চালের কমিশন সিন্ডিকেট ও ঠিকাদারি ব্যবসা। তথ্য অনুসন্ধানে এ রকমই তথ্য উঠে এসেছে। তথ্য অনুসন্ধান কালে কয়েকজন নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, শুধু অনন্তপুর কাজি মসজিদ ও খাপাড়ার রাস্তা সংস্কারের ভুয়া প্রকল্প না ২০১৫-২০১৬ অর্থবছরে কর্ম সুজন নন ওয়েজ প্রকল্প কাজের পুকুর চুরি করা হয়েছে। বরাদ্দকৃত প্রকল্পের কোনো সাইনবোর্ড না দিয়ে লোকচক্ষুর আড়ালে এ অপকর্ম করা হয়। সাংবাদিকদের অনুসন্ধান টিম বের হলে এ ধরনের আরো ভুয়া প্রকল্প বের হয়ে আসবে বলে তথ্যদাতারা দাবি করেন। তথ্য অনুসন্ধান নিয়ে জানা গেছে, জীবননগর উপজেলা হাসপাতালপাড়ার পাশে রয়েছে তার ৩তলা আলিশান বাড়িসহ ঢাকায় ফ্লাট ও জীবননগর স্থলবন্দর এলাকায় নামে বেনামে রয়েছে জমি। এছাড়াও  নামে বেনামে রয়েছে ব্যাংক ব্যালেন্স। তিনি সামান্য অফিস সহকারী পদে চাকরি করে আঙুল ফুলে কলাগাছ, কলাগাছ থেকে জোড়া বটগাছে পরিণত হয়েছেন। সূত্র জানায়, গত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় সেনাবাহিনী তাকে দুনীতির অভিযোগে আটক করে। সূত্রমতে, দুদকের অনুসন্ধানী টিম তদন্ত করলে এসব দুর্নীতির থলের বিড়াল বেরিয়ে পড়বে।

অনন্তপুর আর রহমান কাজি মসজিদের প্রতিষ্ঠাতা ঢাকাস্থ চুয়াডাঙ্গা জেলা সমিতির সভাপতি কাজি সিরাজের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি মাথাভাঙ্গাকে বলেন, আমি ঘটনাটি শুনে চুয়াডাঙ্গা-২ এমপি হাজি আলী আজগার টগরকে বলেছি। তিনি খোঁজখবর নিয়ে আমাকে জানাবেন বলে বলেছেন। এখনও কিছু জানাননি। ফলে মসজিদের নামে কারা ভুয়া প্রকল্প দাখিল করে টাকা পয়সা হাতিয়ে নিয়েছে  জড়িতদের বিষয়ে খোঁজখবর নেয়া হচ্ছে। তথ্য উদঘাটন না পাওয়া পর্যন্ত মসজিদে সোলার বিদুতায়ন কাজ না করার জন্য আমি মসজিদ কমিটিকে নির্দেশ দিয়েছি।

কাজি মসজিদের কেয়ারটেকার রুহুল আমিন সন্টু বলেন, জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা পরিদর্শন করার পর আমরা জানতে পেরেছি। উনি পরির্দশন না করলে আমরা জানতে পারতাম না। তিনি আরও বলেন, ঘটনাটি ফাঁস হলে পড়লে গত সোমবার দামুড়হুদা উপজেলার কার্পাসডাঙ্গা পল্লি শক্তি ফাউন্ডেশনের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা গত সোমবার সোলারের মালামাল নিয়ে মসজিদের কাজ করতে গেলে তারা জনগণের বাঁধার মুখে ফিরে যান। কার্পাসডাঙ্গা পল্লি শক্তি ফাউন্ডেশনের ম্যানেজিং ডিরেক্টর গনি ইযামিনের সাথে মোবাইলফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি সত্যতা স্বীকার করে বলেন, উপজেলা প্রকল্প অফিসের নির্দেশে শ্রমিক-কর্মচারী নিয়ে কাজ করতে গেলে জনগণের বাঁধার মুখে কাজ না করে মাল সামানা নিয়ে ফিরে এসেছি।

অপরদিকে আন্দুলবাড়িয়া খাপাড়ার বাবু খানের বাড়ির সামনের আমতলা থেকে বাজদিয়া রাস্তা সংস্কারে কোন মাটির কাজ করা হয়নি। ওই রাস্তার পার্শ্ববর্তী বাসিন্দা আলী, আমির হোসেন খা জানান, শীতকালে রাস্তার দুধারে ঝোঁড় জঙ্গল পরিষ্কার করা হয়। স্থানীয় বাসিন্দা শেখ ছবদুল ও বকুল শেখ অভিন্ন ভাষায় বলেন, গত চৈত্র, বোশেখ মাসের দিকে রাস্তার মাটি চাচার কাজ করা হয়েছে। গত ২ বছরের মধ্যে রাস্তায় কোনো মাটি ভরাটের কাজ হয়নি।