জিনের অপারেশনের দোহাই দিয়ে রমরমা অর্থবাণিজ্য

 

গাংনীর জুগিন্দা গ্রামে ভণ্ড কবিরাজ রহিমার বাড়িতে নারী রোগীদের লম্বা লাইন

 

জুগিন্দা থেকে ফিরে মাজেদুল হক মানিক:একটি নয় দুটি নয় শত শত জিন তার বশে। জিনের পরামর্শে গাছগাছড়া ও ঝাঁড়ফুঁক চিকিৎসা দেয়া হয়। ছোটখাটো রোগ ফু’তেই সারে। কঠিন রোগ হলে জিনবাবা অপারেশন করে ভালো করেন। এরকম বানোয়াট প্রচারণায় প্রতারণার দোকান খুলে বসেছে মেহেরপুর গাংনীর জুগিন্দা গ্রামের রহিমা। সরল-সোজা মানুষ সেখানে ভিড় জমাচ্ছে। চলছে রমরমা অর্থবাণিজ্য। প্রতারিত হচ্ছে সরল-সোজা মানুষ।

গত কয়েকমাস ধরে রহিমা খাতুন জিনের অপারেশনের অপপ্রচার করে চিকিৎসার নামে অপচিকিৎসা দিয়ে হাতিয়ে নিচ্ছেন লাখ লাখ টাকা। তার প্রতারণার ফাঁদে পড়ে নিঃস্ব হতে চলেছেন কয়েকজন দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত ব্যক্তি। তারাই কবিরাজের ভণ্ডামির বর্ণনা দিয়ে বলেছেন, সরল বিশ্বাসে এসেছি।

জানা গেছে, জুগিন্দা গ্রামের স্কুলপাড়ার দিনমজুর শহিদুল ইসলামের স্ত্রী মধ্য বয়স্কা রহিমা খাতুন গত তিন বছর ধরে কবিরাজি চিকিৎসা দিচ্ছেন। সপ্তাহের শনি ও মঙ্গলবার রহিমার রোগী দেখার দিন। ভ্যান, নসিমন-করিমন ও ইজিবাইকসহ বিভিন্ন যানযোগে ওই দুদিনে শত শত রোগী আসেন তার বাড়িতে। এদের মধ্যে নারী রোগীর সংখ্যা বেশি। গাংনী শহরের ব্যবসায়ী তোফায়েল আহম্মেদ জানান, তার শাশুড়ি দুরারোগ্য ব্যাধি ক্যান্সারে আক্রান্ত। সম্প্রতি রোগমুক্তির জন্য রহিমার সাথে সাত হাজার টাকার চুক্তি হয়। পরিবারের অগোচরে রহিমাকে চার হাজার টাকা পরিশোধ করা হয়। কয়েক দিন ওষুধ খেয়ে কোনো উপকার না হলে বিষয়টি তোফায়েলকে জানান তার শাশুড়ি। তোফায়েল গাংনী শহরের আর্টিস্ট তোহিদুল ইসলামের সাথে নিয়ে রহিমার বাড়িতে গিয়ে টাকা ফেরত চান। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে রহিমা খাতুন তাদেরকে জিনের ভয় দেখায়। বাগবিতণ্ডার এক পর্যায়ে দু দফায় ২ হাজার ৬শটাকা ফেরত দেন। তাও আবার কয়েক কিস্তিতে।

তোফায়ল আহম্মেদ আরো জানান, রহিমা তাদের জানায় রাতে গোরস্তানে গিয়ে দিগম্বর হয়ে কাফনের কাপড় পুড়িয়ে ওষুধ তৈরি করতে হবে। ওষুধে জিনবাবা ফুঁক দেবেন। ওই ওষুধ দিলে ক্যান্সার ভালো হবে। তিনি বলেন, রহিমার তাদেরকে আজগবি ও অবিশ্বাস্য কথা বলে টাকা হজমের অপচেষ্টা করে। কিন্তু পারেনি। এই ভণ্ড কবিরাজ প্রতিদিনই জিনের দোহাই দিয়ে সরল-সোজা মানুষের কাছ থেকে হাতিয়ে নিচ্ছেন লাখ লাখ টাকা। তাই রহিমার ভণ্ডামি বন্ধপূর্বক তার শাস্তি দাবি করেন তিনি। তাছাড়া দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত মানুষের সাথে ওই প্রতারণা ন্যাক্কারজনক বলেও আখ্যায়িত করেন তিনি।

তোফায়েল আহম্মেদের মতোই অনেক পরিবার জটিল ও কঠিন রোগ মুক্তির জন্য রহিমা খাতুনের অপচিকিৎসায় প্রতিনিয়ত প্রতারিত হচ্ছেন। তারপরও জিনের অপারেশনে দুরারোগ্য ব্যাধি ক্যান্সারের চিকিৎসা হচ্ছে এমন গুজবে অনেকেই ছুটে যাচ্ছেন রহিমা খাতুনের বাড়িতে।

রহিমার বাড়িতে গিয়ে দেখা যায় একটি খড়ের খুপরি ঘর, যেখানে তিনি জিনের সহায়তায় চিকিৎসা দিয়ে থাকেন। সেখানে কিছু গাছগাছড়াও পাওয়া গেলো। তবে সাংবাদিকদের উপস্থিতির খবরে রোগীদের লম্বা লাইন অনেকটাই ছোট হয়ে যায়। চারিদিকে তখনও বেশ কিছু রোগীর ভিড়। রহিমার কাছে থাকা জিনবাবা সব রোগের অপারেশন করে ভালো করেন বলে রহিমার কয়েকজন সাগরেদ বার বার সাংবাদিকদের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করেন। কিন্তু জিন কেউ দেখেছেন কিংবা অপারেশন করা দেখেছেন এমন কাউকে পাওয়া গেলো না। কয়েকজন তার কাছে চিকিৎসা নিয়ে ভালো হয়েছেন বলেও দাবি করলেন। তবে স্থানীয় কিছু মানুষের প্রতিরোধ থাকা সত্ত্বেও রহিমা বেশ দাপটের সাথে চালিয়ে যাচ্ছে কবিরাজি ব্যবসা। জানতে চাইলে জিনের বিষয়টি এড়িয়ে গিয়ে রহিমা জানালেন, রোগীদের চাপেই তিনি চিকিৎসা দিচ্ছেন। অনেকেই ভালো হয়ে তাকে অর্থ দেন। তিনি প্রতারণা করছেন না। কিছু মানুষ তার পিছু নিয়েছে। তার নামে বদনাম রটানো হচ্ছে। রহিমার ভিটেয় রয়েছে নতুন একটি একতলা ভবন। স্থানীয় কয়েকজন জানালেন, তার স্বামী দিন মজুরি করে সংসার চালাতেন। কিন্তু গত তিন বছর ধরে কবিরাজি করার তাদের অবস্থা এখন ‘আঙুল ফুলে কলা গাছ’। কবিরাজির অর্থ দিয়ে একতলা আলিশান বাড়ি নির্মাের পাশাপাশি জমিও কিনেছেন। গ্রামের মধ্যে সে এখন ধনী ব্যক্তি।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রহিমার চিকিৎসার কাজে সহযোগিতায় করেছেন কিছু দালাল। তারাই মূলত জিনের অপারেশনের বিষয়ে অপপ্রচার চালায়। তারা রোগী দেখার সময় রোগীদের কাছে গিয়ে রহিমার অলৌকিক ক্ষমতার কথা বলেন। সহজ-সরল নারী রোগীদের মগজধোলাই করা হয়। এতে তারা বাড়িতে গিয়ে রহিমার বিষয়ে প্রচার চালায়। এতেই প্রতিদিনই রোগীর লাইন বাড়তে থাকে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে কারো রোগ ভালো হয়েছে তা নিশ্চিত করে কোনো রোগী বলতে পারেননি।

হিজুলী গ্রামের এক নারীর ক্যান্সার ভালো হয়েছে এমন অপপ্রচারে প্রতিদিনই রোগীরা ভিড় করছেন। তবে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রহিমার ওষুধ খাওয়ার পর হিজুলী গ্রামের ওই রোগীর এখনো পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়নি। তাহলে ক্যান্সার ভালো হয়েছে সেটি কীভাবে দাবি করছেন কথিত কবিরাজ রহিমা খাতুন?চিকিৎসরা বলছেন, ক্যান্সার ভালো হওয়ার কোনো কারণ নেই। রহিমা খাতুন ওই রোগীকে ভাঙিয়ে এখন দেদারসে অর্থ উর্পাজন করছে।

কথিত কবিরাজ রহিমার চিকিৎসার বিষয়টি গাংনী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের আবাসিক মেডিকেল অফিসার (আরএমও) ডা. আনোয়ারুল ইসলামের দৃষ্টি আকর্ষণ করলে তিনি জানান, মানুষের শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা রয়েছে। তাই ওষুধ সেবন না করলেও কিছু কিছু রোগ ভালো হয়ে যায়। ভণ্ড কবিরাজ রহিমা খাতুন সেসুযোগ কাজে লাগিয়ে অপচিকিৎসা দিচ্ছে। এসব অপচিকিৎসায় মানুষের মৃত্যুও হতে পারে। এজন্য সবাইকে সজাগ থাকতে হবে। তাছাড়া জিন যদি অপারেশন করতো তাহলে তো কেউ আর ডাক্তারি পড়তেন না।

জিনের অপারেশন কিংবা কবরস্থানে গিয়ে উলঙ্গ হয়ে কাফন পোড়ানো ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকেও বিশ্বাস অযোগ্য বলে জানালেন গাংনী বাজার কেন্দ্রীয় মসজিদের ইমাম মাও. রুহুল আমিন। তিনি আরো বলেন, সহজ-সরল মানুষের ধোঁকা দিয়ে যিনি চিকিৎসা দিচ্ছেন তাকে এই মুহূর্তেই প্রতিরোধ করা দরকার। এই ভণ্ডামি বন্ধ না করলে ধর্মের অপব্যাখ্যা হবে।