জাল ভোট ব্যালট ছিনতাইয়ে শেষ হলো ১৪৭ আসনের নির্বাচন

অধিকাংশ কেন্দ্র ছিলো ফাঁকা, পাঁচ শতাধিক কেন্দ্রের ভোট স্থগিত

স্টাফ রিপোর্টার: বিএনপিসহ ১৮ দলীয় জোটের বর্জন ও ব্যাপক সহিংসতার মধ্যদিয়ে দশম জাতীয় সংসদের ১৪৭টি আসনের ভোট গ্রহণ সম্পন্ন হয়েছে। নির্বাচনকে কেন্দ্র করে গত দু দিনে চার শতাধিক ভোট কেন্দ্রে অগ্নিসংযোগ, হামলা ও ব্যালট পেপার ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটেছে। কিছু স্থানে কেন্দ্র দখল ও জাল ভোট প্রদানেরও ঘটনা ঘটে। অর্ধশতাধিক কেন্দ্রে ব্যালট পেপারই পাঠাতে পারেনি প্রশাসন। এসব ঘটনায় পাঁচ শতাধিক কেন্দ্রের ভোট গ্রহণ স্থগিত রয়েছে বলে নির্বাচন কমিশন (ইসি) জানিয়েছে। ঠাকুরগাঁও, রংপুর, গাইবান্ধা ও যশোরে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক কেন্দ্রের ভোট স্থগিত করা হয়েছে। স্থগিত কেন্দ্রের সংখ্যা আরো বেশি ছিলো। কিন্তু নির্বাচন কমিশনের নির্দেশে দুপুরের পর কিছু কেন্দ্রে ভোট গ্রহণ শুরু হয়। তবে স্থগিত কেন্দ্রগুলোর দু-একটি ছাড়া কোথাও পুনরায় ভোট গ্রহণের প্রয়োজন পড়বে না। ফলে সার্বিক ফলাফলের ওপরে এর কোনো প্রভাব পড়ছে না। স্থগিত কেন্দ্রগুলোর মোট ভোটের চেয়ে এগিয়ে থাকা প্রার্থীর ভোটের ব্যবধান অনেক বেশি। অনিয়মের অভিযোগে বেশকিছু স্বতন্ত্র প্রার্থী নির্বাচনের দিন ভোট বর্জন ঘোষণা দিয়েছেন।

এদিকে সারাদেশের অল্পকিছু আসন ছাড়া অধিকাংশ কেন্দ্রে ভোটারদের উপস্থিতি প্রায় ছিলো না। কোথাও ভোটারদের লাইন ধরে ভোট দিতে দেখা যায়নি। রাত সাড়ে ৯টায় সারাদেশে কী পরিমাণ ভোট পড়েছে তা কমিশন জানাতে পারেনি। শতকরা ২০ থেকে ২৫ ভাগ ভোটার উপস্থিতি ছিলো বলে জানা গেছে। সর্বশেষ ২০০৮ সালের নবম সংসদ নির্বাচনে ৮৬ দশমিক ৩৪ শতাংশ ভোট পড়েছিলো। তবে এবার আতঙ্কজনক পরিস্থিতির কারণে অধিকাংশ ভোটার ভোট কেন্দ্রে যাননি। নির্বাচন নিয়ে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ বলছে, গণতন্ত্র ও সংবিধান রক্ষায় এ নির্বাচন। আর বিএনপি বলছে, কলঙ্কের নির্বাচন। দু পক্ষের পাল্টাপাল্টি অবস্থানের মধ্যেই গতকাল রবিবার সকাল ৮টা থেকে বিকাল ৪টা পর্যন্ত বিরতিহীনভাবে ৫৯ জেলায় ভোট গ্রহণ চলে। ৫টি জেলার সব আসনে প্রার্থীরা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়ায় সেখানে ভোট হয়নি। নির্বাচন শেষ করতে তিন স্তরে সশস্ত্র বাহিনীসহ নিরাপত্তা বাহিনীর পৌনে চার লাখ সদস্য মোতায়েন করে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। এ নির্বাচনে সশস্ত্র বাহিনী, বিজিবি, কোস্টগার্ড, ৱ্যাব, পুলিশ ও আর্মড পুলিশ মোবাইল ও স্ট্রাইকিং ফোর্স হিসেবে নিয়োজিত ছিলো। এতো নিরাপত্তার পরেও ভোট কেন্দ্রে আসেননি ভোটাররা। উদ্বেগ-উত্কণ্ঠার কারণে ভোট কেন্দ্র ছিলো ফাঁকা। অর্ধশতাধিক ভোট কেন্দ্রে একটি ভোটও পড়েনি। ভোটার শূন্য অনেক কেন্দ্রে ক্ষমতাসীনদের প্রভাব বিস্তারের গুরুতর অভিযোগ এসেছে। এর মধ্যে পাবনার একটি আসনে ক্ষমতাসীন দলের এক প্রার্থীর পক্ষে একজন ভোটারই ৪৭৫ ভোট প্রদান করেন বলে অভিযোগ রয়েছে। দেশের কয়েকটি স্থানে বিলম্বে ভোট গ্রহণ হয়েছে। গাইবান্ধা-৩ আসনে দুপুর ১২টা পর্যন্ত ৪৮টি কেন্দ্রে ব্যালট পেপারসহ নির্বাচনী সামগ্রী পৌঁছুতে পারেনি প্রশাসন। প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী রকিবউদ্দীন আহমেদ ভোটার উপস্থিতি কম হওয়ার পক্ষে যুক্তি দেখিয়ে বলেন, শৈত্যপ্রবাহ ও কিছু রাজনৈতিক দল নির্বাচন বর্জন করায় ভোটাররা কেন্দ্রে কম এসেছেন। নির্বাচনে মোট ভোটার সংখ্যা ছিলো চার কোটি ৩৯ লাখ ৩৮ হাজার ৯৩৮ জন। ভোট কেন্দ্র ছিলো ১৮ হাজার ২০৯টি ও ভোটকক্ষ ৯১ হাজার ২১৩টি। ১৪৭ আসনে ১২টি রাজনৈতিক দলের ৩৯০ জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন। আওয়ামী লীগের ১২০ জন, জাতীয় পার্টির (জাপা) ৬৬ জন, জাতীয় পার্টি-জেপির ২৭ জন, গণতন্ত্রী পার্টির ১ জন, বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির ৬ জন, বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির ১৬ জন, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদের ২১ জন, বাংলাদেশ তরিকত ফেডারেশনের ৩ জন, গণফ্রন্টের ১ জন, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের ২ জন, বাংলাদেশ ইসলামী ফ্রন্টের ১ জন, বিএনএফের ২২ জন ও স্বতন্ত্র প্রার্থী ১০৪ জন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। কমিশনের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, এ নির্বাচনে এক হাজার ১০৭ জন প্রার্থী ছিলেন। এর মধ্যে যাচাই-বাছাইয়ে প্রার্থিতা বাতিল হয় ২৩০ জনের। প্রার্থিতা প্রত্যাহার করে নেন ৩৩৪ জন। আর বৈধ প্রার্থী ছিলো ৫৪৩ জন। এ থেকে জাতীয় সংসদের ৩শ’টি আসনের মধ্যে ১৫৩টি আসনের বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের প্রার্থীরা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বিজয়ী হন। এর মধ্যে আওয়ামী লীগ ১২৭, জাপা-২০, জাসদ ৩, ওয়ার্কার্স পার্টি ২ ও জাতীয় পার্টি-জেপির ১ জন। নির্বাচন উপলক্ষে সারাদেশের ভোট কেন্দ্রগুলোতে তিন স্তরে সশস্ত্র বাহিনীসহ নিরাপত্তা বাহিনীর পৌনে চার লাখ সদস্য মোতায়েন ছিলো। নির্বাচনে সেনা, নৌ ও বিমান বাহিনীর ৫০ হাজার, ১৬ হাজার ১৮১ জন বিজিবি, ৱ্যাব ৮ হাজার, পুলিশ ৮০ হাজার, আনসার ২ লাখ ২০ হাজার ও উপকূলীয় এলাকায় কোস্টগার্ডের দু শতাধিক সদস্য মোতায়েন ছিলো। ভোট কেন্দ্রের আইনশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্বে ছিলো পুলিশ, আনসার ও গ্রাম পুলিশ। মহানগর এলাকার বাইরের সাধারণ ভোট কেন্দ্রে একজন পুলিশসহ ১৪ জন এবং ঝুঁকিপূর্ণ কেন্দ্রে দুজন পুলিশসহ ১৪ জন দায়িত্ব পালন করেন। মহানগর এলাকার প্রতি কেন্দ্রে তিন পুলিশসহ ১৬ জন এবং ঝুঁকিপূর্ণ কেন্দ্রে পাঁচ পুলিশসহ ১৮ জন সদস্য দায়িত্ব পালন করেন। পার্বত্য এলাকা, দ্বীপাঞ্চল ও হাওড় এলাকায় সাধারণ ও গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রে যথাক্রমে ৩ ও ৪ জন অস্ত্রসহ পুলিশ এবং পর্যাপ্ত আনসার নিয়োজিত ছিলো। স্থানীয়ভাবে ইলেকশন ওয়ার্কিং গ্রুপের ২২টি সংস্থার ১০ হাজার ২০৫ জন, এবং অন্যান্য ৮টি সংগঠনের ৩ হাজার ১৩৬ জন পর্যবেক্ষক নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করেছে। বিদেশিদের মধ্যে ভারত ও ভুটান এ নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করে। দু দেশের চারজন পর্যবেক্ষক ইসির কর্মকর্তাদের সহায়তায় ঢাকার ৫টি ভোট কেন্দ্র পরিদর্শন করেছেন। রাজধানীর গাবতলী ও মিরপুরের ৫টি ভোট কেন্দ্র তারা পর্যবেক্ষণ করেন। পর্যবেক্ষকরা হলেন-ভারতের ত্রিপুরার চিফ ইলেকটোরাল অফিসার আশুতোষ জিন্দাল ও ইলেকশন কমিশন অব ইন্ডিয়ার একজন ডিরেক্টর বি বি গার্গ। আর ভুটানের নির্বাচন কমিশনের ভোটার রেজিস্ট্রেশন এবং সীমানা পুনর্নির্ধারণ বিভাগের পরিচালক সোনামত বগাইয়াল ও পাবলিক ইলেকশন ফান্ড ডিভিশনের ম্যানেজার তাশি দর্জি। এছাড়াও প্রায় ৩০ জন বিদেশি সাংবাদিকও নির্বাচনী সংবাদ সংগ্রহ করেন।

এদিকে নির্বাচনী তথ্য প্রকাশ করা নিয়ে নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধে লুকোচুরির অভিযোগ উঠেছে। এর আগের নির্বাচনগুলোতে দিনে ৪/৫ বার সংবাদ সম্মেলন এবং ঘন্টায় ঘন্টায় কত শতাংশ ভোট কাস্ট হয়েছে তা জানানো হতো। দুপুর পর্যন্ত স্থগিতকৃত ভোট কেন্দ্রের তথ্য জানালেও সিইসির অনুরোধের কারণে তা বন্ধ করে দেয়া হয়। বলা হচ্ছে ভোট শেষে জানতে পারবেন।

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *