জামায়াত ছাড়তে চাপে বিএনপি ঐক্য গড়তে বিকল্প চিন্তা

 

স্টাফ রিপোর্টার: চলমান জঙ্গিবাদ-সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে জাতীয় ঐক্যে জামায়াতকে বাধা মনে করছেন দেশের প্রগতিশীল রাজনৈতিক দলসহ সমাজের বিশিষ্টজনেরা। জামায়াত নিয়ে চরম অস্বস্তিতে আছে বিএনপি। দেশি-বিদেশি নানামুখী চাপে দলটির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া। ঢাকায় অবস্থান নেয়া বিদেশি কূটনৈতিক মহলও বিএনপি প্রধানের সাথে দেখা করে জামায়াত ছাড়তে একাধিকবার অনুরোধ জানিয়েছেন।

বিএনপির একটি অংশের পাশাপাশি দল সমর্থিত বুদ্ধিজীবীরাও এখন প্রকাশ্যে জামায়াত ছাড়তে বেগম জিয়াকে পরামর্শ দিচ্ছেন। দলের অবস্থান স্পষ্ট না হলেও বিএনপি চেয়ারপারসনের জামায়াতবিরোধী মনোভাব অনেকটাই স্পষ্ট। সম্প্রতি জোট ও বুদ্ধিজীবীদের বৈঠকেও আভাস মিলেছে। আগামী মঙ্গলবার লন্ডনে ব্রিটিশ সংসদ—হাউস অব কমন্সেও আওয়ামী লীগ-বিএনপির শীর্ষ পর্যায়ের বৈঠকেও সাম্প্রতিক পরিস্থিতির পাশাপাশি জামায়াত ইস্যুও প্রাধান্য পাবে। বিএনপির রক্ষণশীল অংশটিও বলছে, ভোটের মাঠে ফ্যাক্টর হলেও কৌশলগত কারণে এ মুহূর্তে জামায়াত ছাড়া উচিত। চলমান নানামুখী সমস্যা নিয়ে জাতীয় ঐক্য জরুরি। সেক্ষেত্রে জামায়াত বাধা হলে তাদের ছাড়াই সরকারের সঙ্গে বিএনপির আলোচনায় বসা উচিত। এতে বিএনপিরই লাভ হবে। এ নিয়ে জামায়াতের সাথে অভ্যন্তরীণ সমঝোতা হতে পারে। সম্প্রতি ২০-দলীয় জোটের বৈঠকে বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া জামায়াতের এক নেতাকে উদ্দেশ করে বলেন, ইচ্ছা থাকলেও অনেকে জামায়াতের কারণে বিএনপির সাথে আসতে রাজি হয় না। এ সময় খালেদা জিয়া গণফোরামের সভাপতি ড. কামাল হোসেন, কৃষক-শ্রমিক-জনতা লীগের সভাপতি আবদুল কাদের সিদ্দিকী ও জেএসডির সভাপতি আ স ম আবদুর রবের নাম উল্লেখ করেন। জামায়াতের ওই নেতা বলেন, এদের ভোটের মাঠে কোনো প্রভাব নেই। এ সময় বিএনপি প্রধান বলেন, জাতীয়ভাবে তাদের প্রভাব আছে। জানা যায়, ২০-দলীয় জোটগতভাবে না হলেও গণফোরাম, কৃষক-শ্রমিক-জনতা লীগ, বিকল্পধারা, জেএসডিসহ কয়েকটি বাম সংগঠনের সাথে যোগাযোগ রাখছে বিএনপি। তাদের নিয়ে বিকল্প চিন্তাভাবনাও করছে দলটি। পরিস্থিতি বিবেচনায় জামায়াতকে বাইরে রেখেই জাতীয় সংলাপে বসতে চায় বিএনপি। কিন্তু জামায়াত ছাড়লে বিএনপির সঙ্গে সমঝোতার ভিত্তিতে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের নিশ্চয়তাও চায় দলটি। গতকাল এক অনুষ্ঠানে আওয়ামী লীগ নেতা ও খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলাম বলেছেন, বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া যদি জামায়াত ছেড়ে এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে নেতা মেনে আসেন, তাহলে কোনো আপত্তি নেই। জাতীয় ঐক্য গড়তে বিএনপি জামায়াতকে ছাড়বে কি-না এমন প্রশ্নের জবাবে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান পাল্টা প্রশ্ন ছুড়ে দিয়ে বলেন, ‘অলটারনেটিভ করার চেষ্টা করছেন কেন? আমরা বলছি, জাতীয় ঐক্যের কথা। সেখানে আলোচনা যখন শুরু হবে, তখন এটি দেখা যাবে। রাজাকার-স্বৈরাচারদের সঙ্গে যখন সরকার গঠন হয়, এটা নিয়ে তখন আপনারা প্রশ্ন করেন না কেন?’ নজরুল ইসলাম খান বলেন, সরকারকে সহযোগিতা করার জন্য বিএনপি জাতীয় ঐক্যের আহ্বান জানিয়েছে। সরকার যদি শর্তারোপ করে সে প্রস্তাব ফিরিয়ে দিতে চায়, তা পারে। জাতীয় ঐক্য না হলে সন্ত্রাস ও উগ্রবাদ প্রতিরোধে বিএনপির পক্ষে যা করা সম্ভব, সবই করবে। বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের সাথে বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া কথা বলছেন, তার ওপরই কর্মসূচি ঘোষণার দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। তিনিই কর্মসূচি ঘোষণা করবেন। প্রবীণ সাংবাদিক, লেখক ও গবেষক সৈয়দ আবুল মকসুদ বলেন, জামায়াতের সঙ্গ বিএনপি ছাড়লেই জঙ্গিবাদের সমস্যা দূর হবে তার নিশ্চয়তা নেই। জামায়াতের সঙ্গ ছাড়ার জন্য বেগম জিয়াকে পরামর্শ দিতে হবে কেন! তিনি কি জানেন না, জামায়াত কী? খালেদা জিয়ার যা করা উচিত, তাহলো তার দলের (বিএনপি) রাজনীতি সম্পূর্ণ পুনর্গঠন করা। তার দলের (বিএনপি) রাজনীতি ভুলে ভরা। বিএনপি সমর্থিত বুদ্ধিজীবী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য এমাজউদ্দীন আহমদ বলেছেন, মুক্তিযুদ্ধকে স্বীকার করে জামায়াতে ইসলামী জাতির কাছে ক্ষমা চাইলে তাদের নিয়ে জাতীয় ঐক্য গড়ার ক্ষেত্রে আপত্তির কিছু থাকবে না। অথবা জাতির বৃহত্তর স্বার্থে জামায়াত একপাশে সরে দাঁড়াতে পারে। একটা প্রশ্ন উত্থাপন করা হয়, যতোক্ষণ ২০ দলে জামায়াত থাকবে ততক্ষণ কোনো কোনো মহল থেকে বাধা আসতে পারে। কিন্তু আমি মনে করি, জামায়াতের অধিকাংশ নেতাকর্মীর জন্ম ’৭১-এর পরে। তারা এ মাটিরই সন্তান। তারা যদি জাতির কাছে ক্ষমা চায় যে, তাদের ‘মুরব্বিদের’ ভুল হয়েছিলো, তারা যদি মুক্তিযুদ্ধকে স্বীকার করে নেয় তাহলে আপত্তির কিছু থাকে না। আবার জাতীয় স্বার্থে প্রয়োজন হলে জামায়াত চুপচাপ বসে থাকতে পারে। তারা একপাশে সরেও দাঁড়াতে পারে। বিশিষ্ট সাংবাদিক মাহফুজ উল্লাহ বলেন, জামায়াতকে ছাড়বে কি ছাড়বে না, সেটা বিএনপির সিদ্ধান্ত। কিন্তু ধরে নেই বিএনপি জামায়াত ছেড়েছে, তাহলেও তো আওয়ামী লীগ বিএনপির সঙ্গে ঐক্য করবে না। রাজনীতিতে আওয়ামী লীগের অন্যের সাথে ঐক্য করার কোনো ইতিহাস নেই। আমি এটুকু বুঝি, আওয়ামী লীগের যে চরিত্র তাতে জামায়াত ছাড়ার পরও বিএনপির সাথে ঐক্য করবে না। সুশাসনের জন্য নাগরিক সুজন সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ‘বিএনপির জামায়াত ছাড়ার অনেক যৌক্তিকতা আমি দেখি। বিএনপির অবশ্যই জামায়াত ছাড়া উচিত। কারণ জামায়াত বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব বিশ্বাস করে কি-না সেটা নিয়ে প্রশ্ন আছে। এমনকি জামায়াত মুক্তিযুদ্ধের সময়কার ভূমিকা নিয়ে আজ পর্যন্ত জাতির কাছে ক্ষমাও চায়নি। তবে বিএনপি জামায়াত ছাড়লেই যে দেশে জাতীয় ঐক্য হবে, তার কোনো সম্ভাবনা আমি দেখি না। এটা নির্ভর করবে ক্ষমতাসীন দলের সদিচ্ছার ওপর।’

লন্ডনে আওয়ামী লীগ-বিএনপির বৈঠকেও জামায়াত ইস্যু: মঙ্গলবার উগ্রবাদ-সন্ত্রাসবাদসহ বাংলাদেশের চলমান ইস্যু নিয়ে ব্রিটিশ সংসদে (হাউস অব কমন্স) আওয়ামী লীগ বিএনপির শীর্ষ নেতারা বৈঠকে বসছেন। ‘ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড রুল অব ল ইন বাংলাদেশ’ বিষয়ক সেমিনারে অংশ নেবেন বাংলাদেশের প্রধান দুই দলের প্রভাবশালী নেতারা। তবে গণতন্ত্র ও মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে এ সেমিনার হলেও সেখানে জামায়াত ইস্যুটি চলে আসবে। আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে জামায়াতের কর্মকাণ্ড নিয়ে নানা অভিযোগ তুলে ধরা হবে। সেই ধরনের প্রমাণাদি দলের পক্ষ থেকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। বিএনপিও তা খণ্ডাতে নিজেদের পক্ষ থেকে নানা যুক্তি তুলে ধরার প্রস্তুতি নিয়েই লন্ডন গেছেন বলে জানা গেছে।  ঢাকা ছাড়ার আগে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, এই সেমিনারটি প্রতিবছরই হয়। গেল বছর পরিবর্তিত পরিস্থিতির কারণে আমরা যেতে পারিনি। এর আগেও যথারীতি গিয়েছি। এবারও অংশ নেওয়ার ইচ্ছা আছে। দেশের গণতন্ত্র ও মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা হবে। চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়েও কথা হবে।’