জাতীয় সংসদের স্পিকারের নেতৃত্বে কি সর্বদলীয় সরকার গঠন হচ্ছে

নতুন ফর্মলা নিয়ে আওয়ামী লীগ বিএনপি এবং কূটনীতিকদের মধ্যে আলোচনা চলছে

স্টাফ রিপোর্টার: জাতীয় সংসদের স্পিকারের নেতৃত্বে কি সর্বদলীয় সরকার  গঠন হচ্ছে?  কয়েকদিন ধরে এরকমই গুঞ্জন উঠেছে। রাজনৈতিক একাধীকসূত্র বলেছে, এমনই একটি ফর্মুলা নিয়ে আওয়ামী লীগ, বিএনপি এবং কূটনীতিকদের মধ্যে আলোচনা চলছে। এক্ষেত্রে মহাজোট থেকে ৫ জন এবং ১৮ দলীয় জোট থেকে ৪ জন ও টেকনোক্র্যাট কোটায় দল নিরপেক্ষ একজনকে মন্ত্রিসভায় রেখে নির্বাচনী সরকার গঠনের ব্যাপারে সমঝোতার চেষ্টা হচ্ছে। টেকনোক্র্যাট কোটায় নিয়োগপ্রাপ্ত ব্যক্তির হাতে স্বরাষ্ট্র এবং সংস্থাপন মন্ত্রণালয় ছেড়ে দেয়ার প্রস্তাব রয়েছে। গত দুদিন ধরে এক কূটনীতিকের বাসায় এ ফর্মুলা নিয়ে কূটনীতিকরা আলোচনা করেছেন। তারা মনে করেন, এ ফর্মুলায়ই সংবিধান অক্ষুন্ন রেখে সর্বদলীয় এবং নির্দলীয় আমেজ দিয়ে সরকার গঠন করা সম্ভব হবে।

এদিকে নির্বাচনকালীন সরকারের আয়ুষ্কাল কমে যাচ্ছে। আগামী ২৭ নভেম্বরের আগে নির্বাচনকালীন সরকার গঠিত হচ্ছে না। ফলে ৯০ দিনের নির্বাচনকালীন সরকারের আয়ু এক মাস কমে যাচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২৫ নভেম্বর ওমরাহ পালন শেষে দেশে ফেরার পরই নির্বাচনকালীন সরকারের বিষয়টি চূড়ান্ত হবে। ইতোমধ্যে মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রীরা পদত্যাগ করা শুরু করে দিয়েছেন। সংসদে প্রতিনিধিত্ব নেই এমন দুটি দলের নেতাদের নির্বাচনকালীন সরকারে অন্তর্ভুক্ত করার চিন্তাভাবনা হচ্ছে। এদিকে নির্বাচনকালীন সরকার গঠনের পরই দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফশিল ঘোষণা করবে নির্বাচন কমিশন।

২০০৯ সালের ২৫ জানুয়ারি নবম জাতীয় সংসদের প্রথম অধিবেশন বসেছিলো। সংবিধানের ১৭২ (৩) অনুচ্ছেদে উল্লেখ রয়েছে, রাষ্ট্রপতি পূর্বে ভাঙ্গিয়া না দিয়া থাকিলে প্রথম বৈঠকের তারিখ হইতে পাঁচ বত্সর অতিবাহিত হইলে সংসদ ভাঙ্গিয়া যাইবে। সেই হিসেবে আগামী ২৪ জানুয়ারি বর্তমান সংসদের মেয়াদ শেষ হচ্ছে। সংবিধানের ১২৩ (৩) অনুচ্ছেদের (ক) উপ-অনুচ্ছেদে উল্লেখ রয়েছে, সংসদের সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হইবে মেয়াদ অবসানের কারণে সংসদ ভাঙ্গিয়া যাইবার ক্ষেত্রে ভাঙ্গিয়া যাইবার পূর্ববর্তী নব্বই দিনের মধ্যে। সেই হিসাবে ৯০ দিনের গণনা শুরু হয়েছে গত ২৬ অক্টোবর রাত ১২টা ১ মিনিট থেকে। সংবিধানে সংসদ বহাল থাকলে সংসদের মেয়াদ শেষের পূর্বের ৯০ দিন সময়কে এবং সংসদ বিলুপ্ত বা ভেঙে গেলে পরবর্তী ৯০ দিন সময়কে নির্বাচনকালীন সময় বলে অভিহিত করা হয়েছে। কিন্তু এই আলোকে কোনো আইন ও বিধিমালা তৈরি না হওয়ায় নির্বাচনকালীন সরকারের কার্যক্রম সম্পর্কে স্বচ্ছ কোনো ধারণা পাওয়া যাচ্ছে না। এমনকি নির্বাচনকালীন সরকার কবে গঠিত হবে সেই সম্পর্কেও সুস্পষ্ট কোনো বক্তব্য পাওয়া যাচ্ছে না।

এ প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য কাজী জাফরউল্লাহ বলেন, প্রধানমন্ত্রী পবিত্র হজ্ব পালনের জন্য সৌদি আরবে যাচ্ছেন। আগামী ২৫ নভেম্বর তিনি দেশে ফিরবেন। প্রধানমন্ত্রী দেশে ফেরার পরই নির্বাচনকালীন সরকার গঠিত হবে। ধারণা করা হচ্ছে, ২৭ নভেম্বরের আগে এ সরকার গঠিত হচ্ছে না। এদিকে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে পদত্যাগ করার প্রস্তুতি শুরু করে দিয়েছেন মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রীরা। বুধবার মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী ক্যাপ্টেন (অব.) এবিএম তাজুল ইসলাম পদত্যাগপত্র জমা দিয়েছেন। রোববার যোগাযোগমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, বন ও পরিবেশ মন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদসহ বেশ কয়েকজন মন্ত্রী পদত্যাগপত্র জমা দেবেন। গতকাল বৃহস্পতিবার নগর ভবনে এক অনুষ্ঠানে যোগাযোগমন্ত্রী বলেন, এ চুক্তি অনুষ্ঠানই হয়তো আমার শেষ চুক্তি অনুষ্ঠান, এরপর হয়ত আর কোনো চুক্তি অনুষ্ঠানে নাও আসতে পারি। আগামী রোববারের মধ্যে পদত্যাগপত্র প্রধানমন্ত্রীর কাছে জমা দেব। পদত্যাগপত্র জমা দেয়ার পর মন্ত্রিসভার সদস্যরা সচিবালয়ে অফিস করবেন কি-না জানতে চাইলে ওবায়দুল কাদের বলেন, রাষ্ট্রপতি তা গ্রহণ না করা পর্যন্ত কাজ চালাতে কোনো বাধা নেই। মন্ত্রীরা তাদের পদত্যাগপত্র জমা দেবেন, সর্বদলীয় সরকারের যে মন্ত্রিবর্গ থাকবেন, তাদের বাদে ওই পদত্যাগপত্র রাষ্ট্রপতির কাছে চলে যাবে। রাষ্ট্রপতির সম্মতি পর্যন্ত মন্ত্রীরা সচিবালয়ে অফিস করবেন, এটাই স্বাভাবিক। যদিও সাংবিধানিক পদাধিকারীদের নিয়োগ কার্যকর হয় যেদিন তিনি শপথ গ্রহণ করবেন সেইদিন থেকে এবং পদের অবসান হয় প্রধানমন্ত্রী যেদিন তাকে বরখাস্ত করবেন অথবা তিনি যেদিন প্রধানমন্ত্রীর কাছে পদত্যাগ করবেন।

এক্ষেত্রে পদত্যাগপত্র ঝুলিয়ে রাখার কোনো সুযোগ নেই। যদিও দফতরবিহীন মন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত এমপির পদত্যাগপত্র দাখিলের পরেও দীর্ঘদিন ধরে তার পদত্যাগপত্র ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। এ বিষয়ে বিভিন্ন রায়ে উচ্চ আদালতের অনেকগুলো নির্দেশনা রয়েছে। কিন্তু মন্ত্রীদের পদত্যাগপত্র গ্রহণের ক্ষেত্রে উচ্চ আদালতের সেই নির্দেশনা মান্য হচ্ছে না।

সরকারি দলের নীতিনির্ধারকদের সূত্রে জানা গেছে, বিশ সদস্যের নির্বাচনকালীন সর্বদলীয় সরকার গঠন করা হবে। এদের মধ্য থেকে টেকনোক্র্যাট কোটায় দুজন অনির্বাচিত ব্যক্তি মন্ত্রিসভার সদস্য হতে পারবেন। নির্বাচনকালীন সরকারকে সর্বদলীয় সরকারে রূপ দেয়ার জন্য সংসদে প্রতিনিধিত্ব নেই এমন দুটি দলের দুজন সিনিয়র নেতাকে অন্তর্ভুক্ত করা হচ্ছে। বিএনপির নেতৃত্বাধীন ১৮ দলীয় জোট সর্বদলীয় সরকারে যোগ না দিলে কেবল এ ধরনের পরিকল্পনা কার্যকর হবে। কিন্তু নেপথ্যে জাতীয় সংসদের স্পিকারের নেতৃত্বে একটি সর্বদলীয় সরকার গঠনের লক্ষ্যে আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও দাতা দেশসূমহের কর্মকর্তাদের মধ্যে আলোচনা চলছে। গত মঙ্গলবার এবং বুধবার রাতে এক কূটনীতিকের বাসায় এই ফর্মুলা নিয়ে কূটনীতিকরা দীর্ঘ আলোচনা করেছেন। এ নিয়ে তারা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম ও বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ দু দলের সিনিয়র কয়েকজন নেতার সঙ্গে কথা বলেছেন। আওয়ামী লীগের নেতারা শেখ হাসিনাকে প্রধানমন্ত্রীর পদে অক্ষুন্ন রেখে যেকোন সমঝোতায় রাজি। অন্যদিকে বিএনপি নেতারা স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন, শেখ হাসিনাকে বহাল রেখে কোনো সমঝোতা তারা মানবেন না। বিদেশি কূটনীতিকরা মনে করেন, স্পিকারের নেতৃত্বে সর্বদলীয় সরকার গঠন করা হলে সংবিধান অক্ষুন্ন রেখেই সর্বদলীয় সরকার গঠন করা সম্ভব। এক্ষেত্রে টেকনোক্র্যাট কোটায় দল নিরপেক্ষ একজনকে নেয়া হলে ওই সরকারে নির্দলীয় আমেজও থাকবে। পাশাপাশি ব্যবসায়ী নেতৃবৃন্দ দু দলের মহাসচিব পর্যায়ে সংলাপের প্রস্তাব দিয়েছেন। গতকাল প্রধানমন্ত্রীর সাথে সাক্ষাত করে তারা এ প্রস্তাব দেন।