জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় ভেঙে সাতটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সুপারিশ

স্টাফ রিপোর্টার: জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় ভেঙে দেয়ার সুপারিশ করেছে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি)। এর পরিবর্তে ৭ বিভাগীয় শহরে ৭টি স্বায়ত্তশাসিত পূর্ণাঙ্গ ও অনুমোদনকারী বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করতে বলেছে দেশের উচ্চশিক্ষার অ্যাপেক্সবডিখ্যাত সরকারি এ সংস্থাটি। গত বৃহস্পতিবার রাষ্ট্রপতির কাছে দেয়া এক প্রতিবেদনে এ ব্যাপারে বিস্তারিত রূপরেখাও পেশ করা হয়। দশম সংসদের আসন্ন অধিবেশনে ওই প্রতিবেদন উত্থাপনের কথা রয়েছে। ইউজিসির এ প্রস্তাবনা মূলত ২০০৯ সালের ২৫ মার্চ এ সরকারের নেয়া আরেক উদ্যোগের অনুরূপ। তখন শিক্ষা মন্ত্রণালয় ইউজিসির তৎকালীন চেয়ারম্যান অধ্যাপক নজরুল ইসলামের নেতৃত্বে ১১ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করে দেয়, যাদের ৫টি কাজ করার কথা ছিলো। সেগুলো হচ্ছে- স্নাতক ও তদূর্ধ্ব পর্যায়ের কলেজের অধিভুক্তি ও আনুষঙ্গিক ক্ষমতা অর্পণের নিমিত্ত বিশ্ববিদ্যালয় নির্বাচন (কলেজভিত্তিক) এবং এ লক্ষ্যে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়সহ নির্বাচিত বিশ্ববিদ্যালয়ের বিদ্যমান আইনে কী ধরনের সংযোজন ও সংশোধন সম্পর্কে সুপারিশ, সুপারিশকৃত বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিক্ষেত্র নির্বাচন ও আওতাধীন কলেজের তালিকা তৈরি, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে যেসব কলেজ রাখা হবে তার তালিকা তৈরি, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়কে গবেষণা ও উচ্চতর শিক্ষার কেন্দ্র হিসেবে একটি সাধারণ বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরের নিমিত্তে করণীয় নির্ধারণ ইত্যাদি। কিন্তু তখন ওই কমিটিরই ভিন্নমুখি সুপারিশের কারণে সরকার বিশ্ববিদ্যালয়টি বিভক্ত করতে পারেনি। কমিটি তখন প্রায় পাঁচ মাসব্যাপি বিভিন্ন পর্যায়ে মতামত গ্রহণ ও সামগ্রিক পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে বিশ্ববিদ্যালয় না ভেঙে ৬ বিভাগে ৬টি আঞ্চলিক কেন্দ্র স্থাপন (তখন বিভাগ ছিলো ৬টি, বর্তমানে ৭টি), দেশের পুরনো ১৯টি জেলার ঐতিহ্যবাহী কলেজগুলোকে বিশ্ববিদ্যালয়ে উন্নীত করা, বাস্তব প্রয়োজনে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম পরিবর্তন করে ন্যাশনাল অ্যাফিলিয়েটিং ইউনিভার্সিটি বা জাতীয় অনুমোদনকারী বিশ্ববিদ্যালয় রাখা, এ বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো অনার্স-মাস্টার্স ক্লাস চালু না করা, বরং বিদ্যমান এমফিল-পিএইচডি প্রোগ্রামও বাতিল, বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব ইন্সটিটিউটগুলো গাজীপুর ক্যাম্পাস থেকে পরিচালনাসহ মোট ছয়টি সুপারিশ করা হয়।
এ ব্যাপারে ওই কমিটির চেয়ারম্যান অধ্যাপক নজরুল ইসলাম জানান, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের গাজীপুর ক্যাম্পাসে সেন্টার অব অ্যাক্সসিলেন্স বা গবেষণার উচ্চতম প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তোলার মতো পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা নেই। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে বর্তমান অবস্থায় এ ধরনের মানসম্পন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা সম্ভব নয়। এজন্য সুপারিশমালায়, আলাদাভাবে বিষয়টি বিবেচনার কথা বলা হয়েছে। তিনি আরও জানিয়েছিলেন, যে সুপারিশ চূড়ান্ত করা হয়েছে তা ৯৭ সালের শামসুল হক কমিশন এবং ১৯৭৩ সালের ড. কুদরত-ই-খুদা কমিশনের আলোকে প্রণীত।
উল্লেখ্য, ১৯৯২ সালে অ্যাফিলিয়েটিং শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসেবে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হয়। এর আগে এসব কলেজ ঢাকাসহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে পরিচালিত হতো।

বর্তমান পরিস্থিতি : দেশে বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে ২২ লাখ ৩ হাজার ৬৫৩ জন শিক্ষার্থী লেখাপড়া করে। এর মধ্যে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে বর্তমানে লেখাপড়া করছে প্রায় ১৪ লাখ শিক্ষার্থী, যা মোট শিক্ষার্থীর প্রায় ৬০ ভাগ। জানা গেছে, ২০০৯ সালের কমিটির সুপারিশের আলোকে দেশের সর্বাধিক শিক্ষার্থীবহুল বিশ্ববিদ্যালয়টির ৭টি বিভাগীয় শহরে আঞ্চলিক কেন্দ্র চালু করার কথা থাকলেও মাত্র কয়েকটি কেন্দ্রে কার্যক্রম চালু রয়েছে, যদিও ওইসব কেন্দ্র অনেকটাই ভুতুড়ে বাড়িতে পরিণত হওয়ার অভিযোগ রয়েছে। সংশ্লিষ্টরা জানান, বিভিন্ন পরীক্ষার খাতা বণ্টন আর পরীক্ষা শেষে খাতা সংগ্রহ ছাড়া আর তেমোন কোনো কার্যক্রম নেই কেন্দ্রগুলোর। ফলে বছরে কয়েক কোটি টাকা গচ্চা যাচ্ছে। এদিকে এ পরিস্থিতিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত কলেজগুলোর ওপর কোনো ধরনেরই নিয়ন্ত্রণ নেই বললেই চলে। সুপারিশ পেশ আর তা বাস্তবায়নের পর ৪ বছর পার হলেও বিশ্ববিদ্যালয়টি যেসব গ্রাজুয়েট সৃষ্টি করছে তার বেশির ভাগের মানই আশানুরূপ নয়। রাষ্ট্রপতিকে দেয়া প্রতিবেদনে এ ব্যাপারে বলা হয়, ইউজিসি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত কলেজগুলোয় উচ্চশিক্ষা কার্যক্রমের সার্বিক অবস্থা উদ্বেগজনক বলে মনে করে।

ইউজিসির রূপরেখা: প্রতিবেদনে দেশের কলেজগুলোতে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পর্যায়ে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনায় পাঁচ দফা সুপারিশ করা হয়েছে। এগুলো হচ্ছে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়কে একটি পরিপূর্ণ স্বায়ত্তশাসিত স্নাতকোত্তর শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে রূপান্তর করে সেখানে কেবল এমএস ও পিএইচডি পর্যায়ে শিক্ষা কার্যক্রম চালুর কথা বলা হয়েছে। এছাড়া ঢাকা বিভাগের স্নাতক পর্যায়ে শিক্ষা প্রদানকারী কলেজগুলো জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত থাকবে। অন্য ছয়টি বিভাগীয় শহরে একটি করে স্বায়ত্তশাসিত স্নাতকোত্তর বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করে ওই বিভাগের স্নাতক পর্যায়ে শিক্ষা প্রদানকারী কলেজগুলো অধিভুক্ত করা। যেসব কলেজে উচ্চ মাধ্যমিক এবং স্নাতক উভয় পর্যায়ে শিক্ষা কার্যক্রম রয়েছে, সেগুলোকে পৃথক দুটি কলেজে রূপান্তরিত করতে বলা হয়েছে। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় এবং বিভাগীয় নতুন বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়া কেবল কয়েকটি নির্বাচিত কলেজে মাস্টার্স পর্যায়ে শিক্ষা কার্যক্রম সীমিত রাখা; মাস্টার্স পর্যায়ে ভর্তির ক্ষেত্রে বিভিন্ন কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করা স্নাতকদের জন্য উক্ত রাখা প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার মাধ্যমে শিক্ষার্থী বাছাই করার পদ্ধতি প্রবর্তন করার সুপারিশ করা হয়েছে। অধিভুক্ত কলেজগুলোর শিক্ষক নিয়োগের দায়িত্ব বিভাগীয় বা জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়কে প্রদান করে এসব শিক্ষকের চাকরির বিধিমালা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের অনুরূপ করার কথা বলা হয়েছে। এ সুপারিশের নেপথ্য কারণ উল্লেখ করতে গিয়ে ইউজিসি বলেছে, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিগ্রিপ্রাপ্ত স্নাতকদের গুণগত মান মোটেই আশানুরূপ নয়। অধিভুক্ত কলেজগুলোর উচ্চশিক্ষা কার্যক্রমের সার্বিক অবস্থা উদ্বেগজনক। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে অবস্থিত দু হাজারেরও বেশি কলেজ সম্পর্কে খোঁজখবর রাখা জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষে একটি দুরূহ কাজ। বিশ্ববিদ্যালয়ের সেশনজট বর্তমানে গুরুতর পর্যায়ে পৌঁছেছে। সেশনজট নিরসনে বিশ্ববিদ্যালয় কার্যকর কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি। এ অবস্থা থেকে উত্তরণে দেশের সাতটি বিভাগীয় শহরে আঞ্চলিক কেন্দ স্থাপন করে স্ব-স্ব বিভাগের কলেজগুলোর শিক্ষা-সংক্রান্ত কার্যক্রম তদারকির দায়িত্ব ওই সব কেন্দে র ওপর অর্পণ করার উদ্যোগকে কমিশন স্বাগত জানিয়েছে। তবে শিক্ষার মান উন্নয়নের জন্য কলেজগুলোর একাডেমিক মনিটরিং প্রয়োজন বলে মনে করে ইউজিসি। এক্ষেত্রে শিক্ষক এবং গবেষণা-সংক্রান্ত জনবল নিয়োগ করে কেন্দ গুলোকে পর্যায়ক্রমে স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়ে উন্নীত করা যেতে পারে। আরও বলেছে, বেশির ভাগ কলেজে একাদশ শ্রেণী থেকে মাস্টার্স পর্যায় পর্যন্ত শিক্ষা কার্যক্রম চালু রয়েছে। এতে শিক্ষা কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় কেবল স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পর্যায়ে কারিকুলাম প্রণয়ন এবং পরীক্ষার ব্যবস্থা করে। এছাড়া বেসরকারি কলেজগুলোর গভর্নিং বডিতেও শিক্ষক নিয়োগের জন্য নির্বাচনী কমিটিতে প্রতিনিধি নিয়োগ করে। সরকারি ও বেসরকারি কলেজের শিক্ষা কার্যক্রম তদারকি করার দায়িত্ব থাকলেও এটি করা সম্ভব হচ্ছে না। শিক্ষক নিয়োগ, এক কলেজ থেকে অন্য কলেজে পোস্টিং অর্থাৎ বদলি সংক্রান্ত কর্মকাণ্ডে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো ভূমিকা নেই। এর ফলে শিক্ষার মান নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হচ্ছে না।

সংশ্লিষ্টদের বক্তব্য: জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. সৈয়দ রাশিদুল হাসান বলেন, একটা বিশ্ববিদ্যালয়কে দিয়ে দু হাজারের অধিক অধিভুক্ত কলেজ পরিচালনা সম্ভব নয়। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় ভেঙে সাতটি বিভাগে স্বতন্ত্র অ্যাফিলিয়েটিং বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সুপারিশ সময়োপযোগী। তিনি বলেন, উচ্চ মাধ্যমিক কলেজে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শ্রেণী একত্রে চললে সেখানে মানসম্মত উচ্চশিক্ষা নিশ্চিত সম্ভব নয়। অধিভুক্ত কলেজগুলোর মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের অর্ধশিক্ষিত করে রাখা হচ্ছে। শিক্ষকদের নিয়োগের ক্ষেত্রে উন্নতর নীতি গ্রহণ প্রয়োজন উল্লেখ করে তিনি বলেন, স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শিক্ষা প্রদানে শিক্ষক নিয়োগে পরিবর্তন আনতে হবে। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় নতুন কোনো মডেল নয়, অক্সফোর্ড ও ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় এভাবেই চলছে। তিনি বলেন, কয়েকটি নির্বাচিত কলেজে মাস্টার্স পর্যায়ে শিক্ষা কার্যক্রম সীমিত রাখা প্রয়োজন। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো স্বায়ত্তশাসন নেই। এটা পুরো মাত্রায় সরকার নিয়ন্ত্রিত বিশ্ববিদ্যালয়; যেখানে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ভূমিকাই অনেক বেশি। এ ব্যাপারে বর্তমান ভিসি অধ্যাপক ড. হারুন-অর-রশিদ বলেন, উচ্চশিক্ষার সার্বিক মানোন্নয়নে সরকারের কোনো নীতি বা সুপারিশের সাথে তাদের কোনো দ্বিমত নেই। তবে বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়টি যেভাবে চলছে, তাতে মধ্যবর্তী সময়ের জন্য আরও কিভাবে সর্বাধিক সেবামুখী হিসেবে গড়ে তোলা যায়, সে আলোচনার দাবি রাখে। তিনি বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়টির সেশনজট নিরসনে উদ্যোগ বা কার্যকর ব্যবস্থা দৃশ্যমান নয় এমন বক্তব্য সঠিক নয়। কেননা, সাড়ে ৩ মাসের মধ্যে ফলাফল দেয়ার লক্ষ্যে একক পরীক্ষক ব্যবস্থা প্রবর্তনসহ নানা পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। আর এজন্য ইতিমধ্যে অনেক পরীক্ষার ফলাফল আগে দেয়ায় সেশনজট কমছে।
ইউজিসি চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. একে আজাদ চৌধুরী বলেন, বিশ্বায়নের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় এ মুহুর্তে আমাদের সামনে একমাত্র লক্ষ্য হলো মানসম্মত উচ্চশিক্ষা। ২০১২ সালের রিপোর্টে ৬০ ভাগ উচ্চশিক্ষা জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ন্ত্রণের কথা বলা হলেও বর্তমানে তা প্রায় ৭০ ভাগ। তাই জাতীয় স্বার্থে ও মানসম্মত উচ্চশিক্ষার লক্ষ্যে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে ভাবনার সময় এসেছে। তিনি বলেন, ইতোমধ্যে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যাপারে প্রকল্প নেয়ার কাজ শেষপর্যায়ে। আশা করা যাচ্ছে, আরও নানামুখী পদক্ষেপ নেয়া সম্ভব হবে।