জাতিসংঘে যাচ্ছে না বিএনপি : সংসদ থেকে পদত্যাগের চিন্তা

 

স্টাফ রিপোর্টার: একে একে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে আলোচনার সব দরজা। ঢাকাস্থ কূটনীতিকদের তৎপরতা, যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা বিশ্বের তাগিদ এবং জাতিসংঘের উদ্যোগও ব্যর্থ হতে চলেছে। কোনো কিছুতেই যেন মন গলছে না বড় দুটি দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির। বিশেষ করে নির্বাচনকালীন সরকার প্রধান কে হবেন- এ প্রশ্নের নিষ্পত্তি করতেই সময় পার হয়ে যাচ্ছে। কারণ সরকারি দল এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না।

পর্যবেক্ষকদের মতে, এখন বাকি আছে কেবল যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার উদ্যোগ। বাকি সবই ভেস্তে গেছে। নির্বাচন কমিশনও বলছে, সমঝোতার কোনো উদ্যোগ তারা নেবে না। কারণ এটা তাদের কাজ নয়।
বাংলাদেশে বড় দুটি দলের মধ্যে সৃষ্ট সঙ্কট সমাধানে কয়েক বছর যাবতই নানামুখি উদ্যোগ চলছে। এসব উদ্যোগের অংশ হিসেবে গত বছর মে মাসে বাংলাদেশ সফর করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন। এছাড়া তারানকোর নেতৃত্বে জাতিসংঘের প্রতিনিধি দল বাংলাদেশ সফর করেন দু বার। মুসলিম বিশ্বের ৮টি দেশে ঢাকাস্থ রাষ্ট্রদূতরা তৎপর হয়ে খালেদা জিয়ার সাথে বৈঠক করতে পারলেও শেখ হাসিনার দেখা পাননি। এছাড়া দীর্ঘ সময় ধরেই যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ বাংলাদেশস্থ বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূতদের তৎপরতা চলছে। রাজনৈতিক প্রশ্নে যাকে কখনোই মাঠে দেখা যায়নি সেই চীনা রাষ্ট্রদূতও এ বিষয়ে উদ্যোগের কথা জানিয়েছেন। এগুলোর বাইরে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ভারতের ‘প্রেসার গ্রুপ’ বলে পরিচিত বিভিন্ন সংগঠনের উদ্যোগে অনুষ্ঠিত সভা-সেমিনারে বাংলাদেশে পরিস্থিতির ব্যাপারে উদ্বেগ জানিয়ে সমঝোতার ব্যাপারে তাগিদ দেয়া হয়েছে। এসব সেমিনারে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি নেতারা অংশ নিয়েছেন। উদ্বেগ জানানো হয়েছে উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা ও দাতা দেশগুলোর পক্ষ থেকেও। এমনকি ব্যবসায়ী সংগঠনগুলোর উদ্যোগও বাদ যায়নি। সর্বশেষ ইইউ প্রতিনিধি দল এখন ঢাকা সফরে রয়েছেন। এর আগে দু নেত্রীকে চিঠি দিয়েছেন জাতিসংঘ মহাসচিব বান কি মুন এবং যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরি। এসব উদ্যোগের বাইরে সুশীল সমাজে গ্রহণযোগ্য দেশের বিশিষ্ট কয়েকজন ব্যক্তি দু বছর ধরে সরকার ও বিরোধী দলকে আলোচনায় বসে সমস্যা সমাধানের আহ্বান জানিয়েছেন।

রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক ড. ইমতিয়াজ আহমেদের মতে, আন্তর্জাতিক চাপ বাড়তে বাড়তে এখন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দফতর এমনকি জাতিসংঘ পর্যন্ত গিয়েছে। এতোকিছুর পরও সমাধান না হওয়ার লক্ষণ ভালো নয়। তার মতে, এভাবে একে একে সব উদ্যোগ বন্ধ করার ফলাফলও শুভ নয়। তার মতে, আলোচনার পথ এভাবে বন্ধ হতে থাকলে এক পর্যায়ে অনিবার্য হয়ে পড়বে সংঘাত-সংঘর্ষ। আর তা হলে কী হয় তা বড় দুটি দলের নেতাদেরই জানা আছে।
ক্ষমতাসীন দলের নেতারা মনে করেন, সমঝোতার অর্থই হলো নির্বাচনকালীন সরকার প্রধান হিসেবে শেখ হাসিনা থাকতে পারছেন না। ফলে অন্য অনেক ইস্যুর সমাধান সম্ভব মনে করলেও ওই ইস্যুতে আটকে যাচ্ছে সব আলোচনা। আর এভাবেই বড় দুটি দলের মধ্যকার এতোদিনকার অনানুষ্ঠানিক আলোচনাও থেমে গেছে। আশা ছেড়ে দিয়েছেন সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরাও। বলা হচ্ছে, শেষ পর্যন্ত একদলীয় একটি নির্বাচনের পথেই হাঁটছে আওয়ামী লীগ। যদিও দলটির অভ্যন্তরে বড় একটি অংশ আলোচনার জন্য এখনও শেষ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। প্রধানমন্ত্রী রাজি হলে কিছু একটা করার ব্যাপারে এখনও আশাবাদী ওই অংশ। দু-একদিনের মধ্যে এ ব্যাপারে ইতিবাচক প্রতিফলন দেখার আশা করছেন তারা। তবে উদ্যোক্তাদের সফলতা নিয়ে সংশয় রয়েছে। এক্ষেত্রে দুটি দলের মধ্যে আস্থার সঙ্কটই প্রধান প্রতিবন্ধকতা। সরকারি দল সত্যিকার আলোচনা চায় কি-না তা নিয়ে ঘোরতর সন্দেহ সৃষ্টি হয়েছে বিরোধী দলে। প্রথমত, প্রধানমন্ত্রী তার অবস্থান পরিবর্তন করবেন কি-না তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। তাছাড়া এর আগে প্রধানমন্ত্রীসহ সরকারের দায়িত্বশীল নেতারা সংলাপের ব্যাপারে একাধিকবার ইঙ্গিত দিয়েও তা কার্যকর করতে পারেননি। পাশাপাশি অনানুষ্ঠানিক আলোচনা করেও সমঝোতার কাছে যেতে পারেননি। বিশেষ করে নির্বাচনকালীন সরকার প্রধান কে হবেন এই প্রশ্নেই এগোয়নি ওইসব আলোচনা। ফলে বিরোধীদল বিএনপি এখন বিশ্বাস করতেই রাজি নয় যে, সংলাপ বা সমঝোতার মাধ্যমে কিছু বেরিয়ে আসবে। ফলে তারা তাদের মতো করে আন্দোলনের পরিকল্পনা গ্রহণ করছে।

সূত্র জানায়, জাতিসংঘ মহাসচিব বান কি মুনের প্রস্তাব অনুযায়ী সরকারি দল তাদের প্রতিনিধি দলকে নিউইয়র্কে পাঠাতে রাজি না হওয়ায় সমঝোতা উদ্যোগ সবচেয় বেশি হোঁচট খেয়েছে। একাধিকবার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হওয়ায় ‘আলোচনা হচ্ছে না’ বলে সংস্থাটির রাজনৈতিকবিষয়ক সহকারী মহাসচিব অস্কার ফার্নান্দেজ তারানকো মঙ্গলবার রাতে বিএনপিকে আনুষ্ঠানিকভাবে জানিয়ে দিয়েছেন। ফলে বিএনপিও এখন আর নিউইয়র্কে প্রতিনিধি দল পাঠাতে আগ্রহী নয়। উপরন্তু সংসদ থেকে পদত্যাগ করার বিষয় নিয়ে দলটির উচ্চ পর্যায়ে চিন্তা-ভাবনা চলছে। বিএনপির সংসদ সদস্যদের পদত্যাগপত্র আগেই জমা দেয়া আছে দলীয় চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার হাতে। অলআউট আন্দোলনের প্রস্তুতি নেয়া হলে সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করা হতে পারে।

এদিকে সংলাপের তাগিদ দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরির দেয়া চিঠির জবাব দেবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়া। সংলাপে বসতে আপত্তি নেই বলে জানাবেন খালেদা জিয়া। তবে ওই চিঠির ফলাফলও প্রায় শূন্য বলে ধরে নিচ্ছেন ঢাকার কূটনৈতিক মহল। সরকারের দায়িত্বশীল নেতারা বলছেন, আন্তর্জাতিক মহলের কাছে সরকার নতিস্বীকার করবে না। তবে উভয় দলের শীর্ষ নেত্রীকে কেরির পক্ষ থেকে আবার ফলোআপ চিঠি দেয়া হবে।

প্রবীণ রাজনীতিক দফতরবিহীন মন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের মতে, বাংলাদেশে বর্তমানে যে সঙ্কট তা সব সময়ই সাধারণত ক্ষমতা ছাড়ার আগে হয়। বিশেষ করে লতিফুর রহমানের সময় এক ঘণ্টায় ১৩ সচিবের বদলির মধ্য দিয়ে এ ধরনের সঙ্কটের শুরু। পাশাপাশি বড় দলগুলোর মধ্যে পারস্পরিক আস্থা না থাকা এই সঙ্কটকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। তবে আমি এখনও আশা ছাড়তে রাজি নই। সমাধানের পথ বেরিয়ে আসবে।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদের মতে, সরকার জনরোষের আতঙ্কে ভুগছে। তাই সমঝোতার পথ একে একে বন্ধ করে দিচ্ছে। কিন্তু বিএনপি আজ পর্যন্ত বলেনি যে, তারা সমঝোতা চায় না। সুতরাং সংলাপের দরজা আবার সরকারকেই খুলতে হবে। তারা যদি তা না পারে তাহলে দেশের অস্থিতিশীল পরিস্থিতির জন্য তারাই দায়ী থাকবে। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, সংলাপের কোনো সম্ভাবনা আমরা দেখছি না। সর্বশেষ ভরসাস্থল জাতিসংঘকেও সরকার তোয়াক্কা করছে না। তিনি বলেন, সরকার সুড়ঙ্গের সব পথ বন্ধ করে দিচ্ছে। আলোর কোনো পথ খোলা রাখছে না। সম্ভবত তারা দেশকে বিপর্যয়ের দিকে ঠেলে দিতে চায়।