জবে কাতর চুয়াডাঙ্গায় আজগুবি ঘটনার রটনায় দিশেহারা পুলিশ

মাখালডাঙ্গায় ৩ কিশোর ও দামুড়হুদার কার্পাসডাঙ্গায় মানসিক প্রতিবন্ধীকে মারপিট ॥ বুড়োপাড়ায় এক মায়ের চিৎকার
স্টাফ রিপোর্টার: গুজবে কাতর চুয়াডাঙ্গায় একের পর এক আজগুবি ঘটনার রটনায় একের পর এক পিটুনির শিকার হচ্ছেন মানসিক প্রতিবন্ধীসহ বহিরাগত কিশোর যুবক। গতকালও চুয়াডাঙ্গার পৃথক কয়েকটি স্থানে হুজুগে মেতে কয়েকজনকে মারপিট করা হয়েছে বলে খবর পাওয়া গেছে। জেলা সদরের মাখালডাঙ্গায় বহিরাগত এক স্কুলছাত্রসহ তার দু বন্ধুকে মেরে আহত করেছেন গুজবে কান দিয়ে হুজুগে মেতে ওঠা উৎসুক জনতা। দামুড়হুদার কার্পাসডাঙ্গা সীমন্ত এলাকায় এক মানসিক প্রতিবন্ধীকে মারধর করা হয়েছে। এর আগে আন্দুলবাড়িয়া ও চুয়াডাঙ্গার গাইদঘাটেও দুজনকে মারধর করে হুজুগে মাতাল বাতিকগ্রস্তরা। পরে অবশ্য তাদের ভুল ভাঙে।
পুলিশের তরফে বলা হয়েছে, গুজবে কান দিয়ে এভাবে কাউকে মারধর করলে এখন থেকে গ্রামবাসীর বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে। অপরদিকে আলমডাঙ্গার বুড়োপাড়া গ্রামে বাড়ির উঠোনে মায়ের কোল থেকে এক শিশুকে অপহরণের অপচেষ্টা চালানো হয়েছে বলে দাবি করা হয়েছে। অপহরককে ধরেও ছেড়ে দেয়া হয়েছে বলে জানালেও প্রকৃত ঘটনা রহস্যাবৃত বলে মন্তব্য করেছে পুলিশসহ স্থানীয় সচেতন যুবসমাজ।
জানা গেছে, রাজবাড়ির ভবানীপুর গ্রামের আবু আহসান আনুর ছেলে সাব্বির পারভেজ ৮ম শ্রেণির ছাত্র। ওর নানা বাড়ি জেলা শহরের হকপাড়ায়। সাব্বির পারভেজ তার দু বন্ধু সোহরাব ও আসলামকে সাথে নিয়ে ট্রেনযোগে চুয়াডাঙ্গা নানাবাড়ি বেড়াতে আসে। হকপাড়ার নানাবাড়ি থেকে নানার ভায়রাভাই মাখালডাঙ্গার আইনালের বাড়ি বেড়াতে যায়। গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে মাখালডাঙ্গার চা দোকানে বসে এরা আড্ডা দিতে শুরু করে। এরই মাঝে গ্রামের কয়েকজন গুজবে কান দিয়ে হুজুগে মেতে ওদের উল্টোপাল্টা প্রশ্ন করে। বিষয়টি বুঝতে না পেরে বহিরাগত ৩ যুবকও উচ্চস্বরে জবাব দেয়। এরপরই কয়েকজন শুরু করে মারপিট। খবর পেয়ে চুয়াডাঙ্গা সদর থানার এএসআই জমসেদ সঙ্গীয় ফোর্স নিয়ে ঘটনাস্থল থেকে তিন কিশোরকে উদ্ধার করেন।
পুলিশ বলেছে, সভ্য যুগেও যেভাবে মানুষ গুজবে কান দিয়ে যাচ্ছেতাই করছে, তা দেখে তো মনেই হয় না মানুষের মধ্যে মানবতার ন্যূনতম কিছু আছে। স্কুলছাত্র। অতোটুকু ছেলেকে যেভাবে মারধর করা হয়েছে তা দেখে বলা যাবে না গুজবে কান দেয়া মানুষগুলোর বিবেক আছে।
এদিকে আমাদের মুন্সিগঞ্জ প্রতিনিধি জানিয়েছেন, আলমডাঙ্গার আইলহাস ইউনিয়নের বুড়োপাড়া গ্রামে সন্ধ্যারাতে এক মায়ের কোল থেকে ৬ মাসের শিশু কেড়ে, নিয়ে অপহরণের অভিযোগ পাওয়া গেছে। গতকাল সন্ধ্যায় বুড়োপাড়া গ্রামের দুই সন্তানের জননী তার কন্যাকে নিয়ে ঘরের বারান্দায় বসে বড় মেয়ের পড়া দেখিয়ে দিচ্ছিলেন। হঠাৎ অন্ধকারে একজন লোক এসে কোল থেকে শিশু কন্যাকে কেড়ে নেয়ার চেষ্টা করে। এ সময় চিৎকার দিলে লোকজন ছুটে এসে অপহরণকারী বাড়ির পেছনের জঙ্গলে পালিয়ে যায়। এই ঘটনায় গ্রামবাসী প্রতিরোধ গড়ে তোলে। লাঠিসোঁটা নিয়ে গ্রামের মাঠ ও গ্রামের রাস্তা ঘিরে রাখে উত্তেজিত জনতা। মোবাইলফোনের মাধ্যমে ঘটনাটি আশপাশ গ্রামে পৌঁছে যায়। বাগুন্দা গ্রামবাসী দুজনকে মোটরসাইকেলসহ আটক করে বুড়োপাড়ায় নিয়ে গণধোলাই দিয়ে ছেড়ে দেয়। এ ব্যাপারে গতকাল চুয়াডাঙ্গা জেলা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত পুলিশ সুপার ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন।
গ্রামসূত্রে জানা গেছে, গতকাল বৃহস্পতিবার মাগরিবের আজানের পর ইফতার ও নামাজ পড়া নিয়ে ব্যস্ত। আলমডাঙ্গার বুড়োপাড়ার মাজেদুলের স্ত্রী নাজমা খাতুন ঘরের বারান্দায় বসে ৬ মাসের শিশুকন্যা মুসকানকে কোলে নিয়ে বড় মেয়েকে লেখাপড়া করাচ্ছিলেন। হঠাৎ একজন লোক এসে নাজমার কোল থেকে শিশু কন্যাকে কেড়ে নেয়ায় চেষ্টা করে। তার চিৎকারে প্রতিবেশীরা ছুটে আসার আগেই অপহরণকারী পালিয়ে যায়। গ্রামবাসী প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। তারা লাঠিসোঁটা নিয়ে গ্রামের মাঠ ও রাস্তা ঘিরে রাখে। মোবাইলফোনের মাধ্যমে ঘটনাটি এলাকার ছড়িয়ে পড়লে বাগুন্দা গ্রামের জনতা দুজনকে অপহরণকারী সন্দেহে একটি মোটরসাইকেলসহ আটক করে বুড়োপাড়া গ্রামাবাসীর হাতে তুলে দেয়। গ্রামবাসী তাদের হালকা ধোলাই দিয়ে ছেড়ে দেয়।
এ ব্যপারে মোকামতলা গ্রামের মৃত তারা চাঁদের ছেলে আবু শামা ফকির দাবি করেন, অপহরণকারী সন্দেহে যাদের আটক করা হয়েছিলো তাদের বাড়ি রাইলক্ষ্মীপুর গ্রামের পিন্টু মোল্লার ছেলে উজ্জ্বল ও একজনের নাম জানে না। আটক দুজনের মধ্যে উজ্জ্বল তার কুটুমের ছেলে। আবু শামার বাড়ি থেকে বাড়ি ফেরার পথে বাগুন্দা গ্রামের লোকজনের হাতে অপহরণকারী সন্দেহে আটক হয়।
গ্রামবাসী আরও জানায়, এই দুজন বিকেল থেকে গ্রামে সন্দেহজনকভাবে ঘোরাঘুরি করছিলো। এদেরকে পুলিশের হাতে তুলে না দিয়ে ছেড়ে দেয়ায় বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয় গ্রামবাসীর মধ্যে।
গতকাল রাতেই সংবাদ পেয়ে চুয়াডাঙ্গার ভারপ্রাপ্ত পুলিশ সুপার আব্দুল মোমেন, আলমডাঙ্গা থানা পুলিশের অফিসার ইনচার্জ আকরাম হোসেন, ঘোলদাড়ি ফাঁড়ি পুলিশের ইনচার্জ এসআই মিজান, সরোজগঞ্জ ফাঁড়ি পুলিশের ইনচার্জ এসআই শফিক, শম্ভুনগর পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ এএসআই মজিদ ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে চুয়াডাঙ্গার ভারপ্রাপ্ত পুলিশ সুপার আব্দুল মোমেন মাথাভাঙ্গাকে বলেন, চুয়াডাঙ্গা জেলাব্যাপী একটি চক্র গুজব ছড়িয়ে দিয়েছে। যার কোনো প্রমাণ মিলছে না। এই ঘটনা গুজব কি-না খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
ভ্রাম্যমাণ সংবাদদাতা জানিয়েছেন, দামুড়হুদা উপজেলার কার্পাসডাঙ্গা সীমান্ত এলাকায় অপরিচিত এক যুবকের ঘোরাফেরা করতে থাকা অবস্থায় জঙ্গি সন্দেহে জনতার হাতে আটক হয়। জনতা পরবর্তীতে কার্পাসডাঙ্গা পুলিশ ফাঁড়িতে খবর দিলে এসআই সুব্রত বিশ্বাসের নির্দেশে এএসআই মাসুদ সঙ্গীয় ফোর্স নিয়ে পুলিশ ফাঁড়িতে নিয়ে আসেন ওই যুবককে। বর্তমানে সে কার্পাসডাঙ্গা পুলিশ ফাঁড়ি কাস্টডিতে আটক আছে। এদিকে দু সপ্তাহ ধরে অত্র এলাকায় জনগণ ছেলে ধরা নামে অপহরণ আতঙ্কে ভুগছে। গতকাল বৃহস্পতিবার রাত সাড়ে ৯টার দিকে কার্পাসডাঙ্গা ইউনিয়নের সীমান্তবর্তী পীরপুরকুল্লা গ্রামে ঘোরাফেরা করছিলো তার চলাফেরা সন্দেহেজনক হলে স্থানীয় জনতা তাকে আটক
করে। সে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন কথা বলছে। সে নিজের নাম সেলিম গ্রাম গোবরগাড়া, থানা নুরুন্দী, জেলা জামালপুর বলতে পারলেও নিজের পিতার নাম বলতে পারেনি। এসআই সুব্রত বিশ্বাস বলেন, তার কথা শুনে মনে হয়েছে সে একজন মানসিক রোগী। তাকে আগামীকাল সকালে (আজ) দামুড়হুদা মডেল থানায় সোপর্দ করা হবে।
জীবননগর ব্যুরো জানিয়েছে, জীবননগর উপজেলার বিভিন্ন গ্রামে গুজবের আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। গত শনিবার রাতে মসজিদের মাইকে উথলী গ্রামে ২০-২২ জনের অপরিচিত মানুষ ঢুকেছে এমন প্রচার করার পর নির্ঘুম রাত কাটে একতারপুর, সেনেরহুদা ও উথলী গ্রামবাসীর। এরপর হাসাদাহসহ উপজেলার বিভিন্ন গ্রাম ও জীবননগর পৌর এলাকায় এ গুজবের ডালপালা মেলতে শুরু করেছে। গতকাল বৃস্পতিবার জীবননগর পৌর শহরে গুজবে আতঙ্কিত না হওয়ার জন্য মাইকিং করা হয়েছে। সত্যি সত্যিই কি গ্রামে মানুষ ঢুকে নারী ও বাচ্চাদের অপহরণ কিংবা ডাকাতি করা হচ্ছে, না কি কেউ গুজব ছড়িয়ে ফয়দা লুটার চেষ্টা করছে তা নিয়ে চলছে আলোচনা।
গত মাসের প্রথম দিকে খয়েরহুদা সড়কে, সন্তোষপুর সড়কে ও একতাপুরসহ কয়েকটি গ্রামের বাড়িতে ছিনতাই ও ডাকাতির ঘটনা ঘটলেও অন্য কোনো গ্রামে ডাকাতির কিংবা অপহরণের কোনো ঘটনা ঘটেনি। পবিত্র রমজান মাসে গ্রামবাসী শান্তিতে থাকলেও জেলার অন্যান্য স্থানের মতো জীবননগর উপজেলাতেও এ গুজবের ডালপালা বিস্তার করতে শুরু করেছে। গতকাল জীবননগর পৌরসভার পক্ষ থেকে এ গুজবের বিষয়ে সতর্ক করতে শহরে দিনভর মাইকিং করা হয়েছে। বলা হয়েছে, এমন গুজব দেখা দিলে কিংবা অপরিচিত কোন ব্যক্তিকে দেখলে সাথে সাথে পুলিশে খবর দিতে হবে। এ ব্যাপারে পুলিশ সর্বদা প্রস্তুত রয়েছে।
গত কয়েকদিন ধরে চুয়াডাঙ্গায় একের পর এক গুজবের কারণে অপ্রীতিকর ঘটনা নিয়ে অনেকেই মন্তব্য করতে গিয়ে বলেছেন, চুয়ডাঙ্গা এখন চিলের পিছে ছুটছে। চিলে কান নিয়েছে শুনে কানে হাত না দিয়ে চিলের পিছু ছোটা মানেই বোকার স্বর্গে বাস করা। আতঙ্কগ্রস্ত চুয়াডাঙ্গাবাসী তবে কি সত্যিই এখন বোকার স্বর্গে? সচেতন হবে কবে?