জঙ্গি দমনে পুলিশের সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন

 

 

স্টাফ রিপোর্টার: একের পর এক টার্গেট কিলিংয়ের মধ্যে ঢাকঢোল পিটিয়ে পুলিশ জঙ্গিবিরোধী সাঁড়াশি অভিযানে নামলেও তা আদৌ সফল হবে কি-না তা নিয়ে অনেকেরই সংশয় রয়েছে। বিশেষ করে গত তিনদিনের অভিযানের ফলাফল হাতে পাওয়ার পর অপরাধ পর্যবেক্ষকরা এ ব্যাপারে পুলিশের সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। এছাড়াও এ অভিযানের মূল উদ্দেশ্য নিয়েও বিভিন্ন মহলে কথা উঠেছে।
অপরাধ পর্যালোচকরা বলছেন, বরাবরের মতো পুলিশ এখনো রাজনৈতিক পক্ষপাতদুষ্ট রয়ে গেছে। কর্তব্যপরায়ণ, দক্ষ ও সৎ কর্মকর্তারা প্রশাসনের কী-পয়েন্ট থেকে ছিটকে পড়েছেন। আর ক্যাডারবাজ পুলিশ কর্মকর্তারা গুরুত্বপূর্ণ পদ দখল করে আছেন; এবং সিংহভাগই চাটুকারিতা ও প্রভাবশালীদের তোষামদের পাশাপাশি নিজের আখের গোছাতে ব্যস্ত। অন্যদিকে টার্গেট কিলিংসহ বিভিন্ন জঙ্গি তৎপরতার ঘটনাগুলো সরকার রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখছে। পক্ষপাতদুষ্ট পুলিশও সে স্রোতে গা ভাসাচ্ছে। ফলে প্রকৃত অপরাধীরা সহজেই পার পেয়ে যাচ্ছে। ফলশ্রুতিতে আইনশৃঙ্খলায় ধস নেমেছে।
অন্যদিকে পুলিশ কর্মকর্তাদের অনেকের দাবি, জঙ্গি দমনে যথেষ্ট আন্তরিকতা থাকলেও তাদের সক্ষমতার ব্যাপক ঘাটতি রয়েছে। তাই তারা জঙ্গি দমনে ব্যর্থ হচ্ছে। তাদের ভাষ্য, সাধারণ অপরাধ দমনে যোগ্য পুলিশ দিয়ে ভয়ঙ্কর জঙ্গি তৎপরতা নিয়ন্ত্রণে রাখা অসম্ভব। আন্তর্জাতিক গোষ্ঠীর সহায়তা নিয়ে দেশের অভ্যন্তরীণ জঙ্গিরা এখন যে পর্যায়ে পৌঁছেছে তা মোকাবেলার জন্য বিশেষায়িত বাহিনীর প্রয়োজন। কিন্তু পুলিশের সে রকম কোনো টিম নেই। জঙ্গি দমনের জন্য বিশেষ বাহিনী না থাকার কারণে এসব বিশেষায়িত অপরাধীদের গ্রেপ্তার করা দুষ্কর। জঙ্গিরা নতুন নতুন ছদ্মবেশ ও কৌশলে টার্গেট কিলিং চালিয়ে গেলেও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সেই মান্ধাতার আমলের কৌশলেই রয়ে গেছে। কর্মকর্তারা জানান, সরকারের কয়েকটি গোয়েন্দা সংস্থার জঙ্গি সেল থাকলেও বিশেষায়িত কোনো ইউনিট নেই। তবে গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর কার্যক্রম তথ্য প্রদানের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। ৱ্যাবের গোয়েন্দা শাখার মধ্যে জঙ্গি দমনের একটি বিশেষায়িত সেল থাকলেও সেখানে ব্যাপক জনবল সঙ্কট রয়েছে।

অন্যদিকে জঙ্গি দমনের সক্ষমতার দিক থেকে থানা-পুলিশ আরো বেশি পিছিয়ে। অথচ থানার মাধ্যমে পুলিশের নেটওয়ার্ক দেশের সর্বত্র বিস্তৃত। পুলিশের পক্ষেই সম্ভব প্রত্যন্ত এলাকার প্রান্তিক মানুষের কাছে পর্যন্ত পৌঁছানো। অথচ জঙ্গি দমনে তাদের কোনো ভূমিকা নেই। এ যাবৎ জঙ্গি গ্রেপ্তার, দমন এবং এ-সংক্রান্ত মামলা সবচেয়ে বেশি তদন্ত করেছে ৱ্যাব ও ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগ (ডিবি)। ৱ্যাবের দায়িত্বশীল একজন কর্মকর্তা বলেন, সপ্তাহ কিংবা মাসব্যাপী সাঁড়াশি অভিযান চালিয়ে জঙ্গি দমন অসম্ভব। কেননা, ধর্মীয় অন্ধচেতনায় জঙ্গিরা এ সন্ত্রাসবাদের পথে পা দিয়েছে। তাই জঙ্গি দমন করতে হলে তাদের মগজ থেকে সন্ত্রাসবাদের ভুত তাড়াতে হবে। এই অবস্থায় জঙ্গিদের শিরা-উপশিরায় ঢুকতে হবে। তাদের উদ্বুদ্ধকরণ, নিয়োগ, অর্থায়নের সব পথ বন্ধ করতে হবে। এর জন্য বিশেষায়িত ইউনিট প্রয়োজন। যারা এগুলো নিয়ে কাজ করবেন তাদের অবশ্যই সেসব বিষয় নিয়ে পড়াশোনা ও প্রশিক্ষণের সুযোগ দিতে হবে। দিতে হবে বাড়তি প্রণোদনাও। ঢাকা মহানগর পুলিশের এডিসি পদমর্যদার একজন কর্মকর্তা জানান, প্রতি বছর পুলিশের ২০-২৫ জন কর্মকর্তা বিদেশে পড়তে যান। যাদের অর্ধেকেরই পড়ার বিষয় থাকে কাউন্টার টেররিজম বা এ-সংশ্লিষ্ট বিষয়। সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ বিষয়ে অনেকেই পিএইচডি নিয়েছেন। তবে দেশে ফিরে তারা সে কাজে নিযুক্ত হচ্ছেন না। মাঠপর্যায়ে কাজে লাগছে না তাদের জ্ঞান। কারণ তাদের সে জ্ঞান কাজে লাগানোর প্ল্যাটফর্ম নেই। ওই কর্মকর্তা বলেন, জঙ্গিদের কাজ অনেক জটিল হয়েছে। জঙ্গিবাদের সঙ্গে এখন অনেকগুলো বিষয় জড়িয়ে পড়েছে। সবচেয়ে বড় বিষয় হচ্ছে এখন জঙ্গিদের তত্ত্ব ও বার্তা প্রচার, নতুন সদস্য নিয়োগ, অর্থায়ন ও প্রশিক্ষণ হচ্ছে ইন্টারনেটের মাধ্যমে। এর জন্য অন্তর্জালে বিশেষ দৃষ্টি নিয়ে এগুলো নজরদারির এখন কেউ নেই। এ ছাড়া জঙ্গিদের মন ও মনন বোঝা এবং সে অনুযায়ী আগাম তৎপরতা চালাতে হবে। পাশাপাশি গ্রেফতারকৃত জঙ্গিদের জিজ্ঞাসাবাদ, পাল্টা উদ্বুদ্ধকরণ ও পুনর্বাসন করতে হবে, নজরদারিতে রাখতে হবে। কারা, কেন জঙ্গিবাদে জড়াচ্ছে সে বিষয়ে গবেষণা করতে হবে। সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে হবে। জঙ্গি নিয়ে দীর্ঘদিন কাজ করা ৱ্যাবের একজন কর্মকর্তা বলেন, স্বল্প সময়ে ইন্টারনেটের মাধ্যমে এলাকাভিত্তিক ছোট ছোট জঙ্গি টিম গড়ে উঠছে। আর তারাই ছক এঁকে এক একটি অঘটন ঘটিয়ে ফেলছে। এরপর বিভিন্ন জঙ্গি নামে নিজেদের বার্তা প্রকাশ করছে। যাদের সঙ্গে মূল সংগঠনের সার্বক্ষণিক কোনোই যোগাযোগ নেই। যে কারণে জঙ্গি গোষ্ঠীর কেন্দ্রে হানা দিয়ে তাদের সম্পর্কে কোনো তথ্যই মিলছে না। পুলিশের একজন সাবেক শীর্ষ কর্মকর্তা বলেন, জঙ্গির ব্যাপারে আগে থেকে মনোযোগ দেয়া হয়নি। আবার কেউ কেউ এসব কাজকে উৎসাহিত করেছে। সে কারণে আজকের এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। তাই জঙ্গি দমন করতে হলে এখন রাজনৈতিক ঐকমত্য জরুরি। এদিকে ঢাকঢোল পিটিয়ে গত শুক্রবার থেকে সপ্তাহব্যাপী জঙ্গিবিরোধী যে অভিযান শুরু করা হয়েছে তার কৌশল ও সফলতা নিয়ে অপরাধ পর্যবেক্ষকরা অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন। তাদের ভাষ্য, দেশব্যাপী পুলিশের নিয়মিত অভিযানের সঙ্গে এ বিশেষ অভিযানের উল্লেখযোগ্য কোনো পার্থক্য নেই। সাধারণ সময়ে এক হাজার দুইশ থেকে দেড় হাজার চোর, ডাকাত, ছিনতাইকারীসহ বিভিন্ন ওয়ারেন্টভুক্ত আসামি গ্রেফতার করা হলেও সাঁড়াশি অভিযানের প্রথম দিনে তা বেড়ে প্রায় দুই হাজারে দাঁড়িয়েছে। আর দ্বিতীয় দিনে তা আরো একধাপ বেড়ে তিন হাজারের কোটা ছাড়িয়েছে। তৃতীয় দিনে যা নেমে আবার দুই হাজারে নেমে এসেছে। এদের মধ্যে সন্দেহভাজন জঙ্গির সংখ্যা মাত্র ৮৫ জন। বিশেষ অভিযানে যে অতিরিক্ত গ্রেপ্তার হয়েছে এর সিংহভাগই সরকার বিরুদ্ধে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী কিংবা নিরীহ লোকজন। যা নিয়ে এরই মধ্যে দেশজুড়ে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। উদ্বিগ্ন অনেকেই পবিত্র রমজান মাসের ধর্মকর্ম ছেড়ে আত্মগোপন করতে বাধ্য হয়েছেন। যা সাধারণ মানুষের মধ্যে ভয়ঙ্কর ক্ষোভ সৃষ্টি করতে পারে বলে মন্তব্য করেন অপরাধ বিশ্লেষকরা।

এদিকে তিনদিনে গ্রেফতারকৃতের মধ্যে প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজারই ওয়ারেন্টভুক্ত ও বিভিন্ন মামলার পলাতক আসামি। অথচ স্রেফ পুলিশের গাফিলতির কারণে সারাদেশে এ ধরনের প্রায় এক লাখ আসামি পলাতক রয়েছে। যাদের গ্রেপ্তারে গত ৫ বছরে বিশেষ কোনো অভিযান রিচালিত হয়নি। অপরাধ বিশ্লেষকদের ভাষ্য, টার্গেট কিলিংয়ের ঘটনাগুলোকে পুঁজি করে সরকার বিশেষ অভিযানের নামে বিরোধী দলগুলোকে দমনের মিশনে নেমেছে। তাই এ অভিযানের সফলতা আশা করা নিরর্থক। এসব ঘটনা রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে না দেখে প্রকৃত দোষিদের শাস্তি নিশ্চিত করার আহ্বান জানান আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকরা। এছাড়া এসব টার্গেট কিলিংয়ের সঠিক তদন্তের প্রয়োজনে উন্নত দেশগুলোর কাছ থেকে প্রযুক্তিগত সহায়তা নেয়ারও সুপারিশ করেন তারা।

এ ব্যাপারে সাবেক রাষ্ট্রদূত মোহাম্মদ জমির বলেন, সামপ্রতিক হত্যাকাণ্ড গুলো যারা ঘটাচ্ছে কেন তাদের সরকার চিহ্নিত করতে পারছে না সেটাই প্রশ্ন। শুধু বললেই হবে না, আমরা দেখছি, আমরা শনাক্ত করছি এবং ডিএনএ টেস্ট করছি। জনগণের মনে আস্থা ফিরিয়ে আনার জন্য আমাদের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর উচিত তাদের শনাক্ত করে জনসম্মুখে আনা। জনগণের আস্থা ফেরানোর ব্যাপারে রাজনীতিকরণ করলে চলবে না। তিনি আরো বলেন, বহির্বিশ্ব যখন দেখবে আমরা জঙ্গিদের ধরতে পারছি এবং শাস্তি দিতে পারছি তখন আমাদের দক্ষতা বাড়বে। এছাড়া সাইবার ইনফরমেশন ডিজিটাল যেটি বিস্তৃত আকারে বিরাজ করছে সেটির ব্যাপারে আমরা এখনো ততটা যোগ্য নই। তাই আমেরিকা, কোরিয়া যদি আমাদের টেকনিক্যালভাবে সাহায্য করতে চায় তাহলে আমাদের উচিত তাদের সাহায্য গ্রহণ করা।

আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক অধ্যাপক দেলোয়ার হোসেন বলেন, এটিকে রাজনৈতিক বক্তব্য এবং বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলে পার পাওয়ার কোনো সুযোগ নেই এবং এটি একটি হুমকি সেটি অস্বীকার করারও সুযোগ নেই। জঙ্গি হামলা এখন থেকে যদি দমন না করা হয় তাহলে সমাজ ও রাষ্ট্রের ওপর চেপে বসবে। দেলোয়ার হোসেন বলেন, এ ঘটনার সাথে আঞ্চলিক এবং আন্তর্জাতিক রাজনীতি যুক্ত। অভ্যন্তরীণ সমাধান হলো মূল সমাধান। সেখানে যদি আমরা জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে এবং এর উৎস খুঁজে বের করতে পারি তাহলে বহির্বিশ্বের হস্তক্ষেপ করার কোনো সুযোগ থাকে না। একই সময় দেশের ভেতরে একের পর এক হত্যাকাণ্ডের দায় স্বীকার সরকার আর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এড়াতে পারে না বলে মনে করেন এ বিশ্লেষক। এদিকে বিভিন্ন সময়ে গ্রেফতারকৃত জঙ্গিরা সম্প্রতি ৱ্যাব ও পুলিশের হেফাজতে ক্রসফায়ারে নিহত হওয়ার ঘটনায় আইনজ্ঞরা উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, এতে প্রকান্তরে সমাজ হিংস্র ও বর্বর হয়ে ওঠার পথ প্রশস্ত হচ্ছে। তাদের ভাষ্য, ক্রসফায়ারের অর্থ হলো আইন ও বিচারব্যবস্থার ওপর সরকারেরই নিজের আস্থা না থাকা। ক্রসফায়ারের মাধ্যমে সরকার যদি আইন নিজের হাতে তুলে নেয় তার অর্থ দাঁড়াবে যে কোনো সাধারণ মানুষও বিচার নিজের হাতে তুলে নেবে। ভয়াবহ সহিংসতা সাধারণ মানুষের জীবনের সঙ্গী হয়ে দাঁড়াবে। যা কোনো সভ্য সমাজের রূপরেখা নয়। এটি অগণতান্ত্রিক, অসভ্য ও বর্বর সমাজের চিত্র বলে মন্তব্য করেন আইনজ্ঞরা।