চুয়াডাঙ্গা মেহেরপুরে তীব্র শীতে জনজীবন স্থবির

স্টাফ রিপোর্টার: চলতি শীত মরসুমে চুয়াডাঙ্গায় গতবছরের রেকর্ড ভেঙে তাপমাত্রা ৬ দশমিক ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াসে নেমে এসেছে। শীতের প্রকোপে জীবননগরে একজনের মৃত্যু হয়েছে। চুয়াডাঙ্গা ও মেহেরপুরে শিশুদের মধ্যে শীতজনিত রোগের প্রকোপ আশঙ্কাজনক হারে বেড়েছে। এরই মাঝে দুস্থদের মাঝে শীতবস্ত্র বিতরণেরও তোড়জোড় শুরু হয়েছে। গতকাল দুটি ব্যাংকের চুয়াডাঙ্গা শাখা শীতবস্ত্র বিতরণ করে। এ শীতবস্ত্র দুস্থদের হাতে তুলে দেন চুয়াডাঙ্গা-১ আসনের সংসদ সদস্য বীর মুক্তিযোদ্ধা সোলায়মান হক জোয়ার্দ্দার ছেলুন। শীতবস্ত্র হাতে পেয়ে শীতার্ত দুস্থদের মুখে ফুটে ওঠে স্বস্তির হাসি। তীব্র শীতে এলাকায় শীতবস্ত্র বিতরণে দানশীলদের আরো আন্তরিক হওয়ার অনুরোধ জানিয়েছে সচেতনমহল।

চুয়াডাঙ্গার ওপর দিয়ে বয়ে চলা টানা শৈত্যপ্রবাহে মানুষ যবুথবু হয়ে পড়েছে। গত এক সপ্তা ধরে জেলার তাপমাত্রা ৬ থেকে ১০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে ওঠানামা করছে। আর গত ১০ দিনে তীব্রশীতে ৭ শিশুর মৃত্যু হয়েছে।

এদিকে, শৈত্যপ্রবাহের প্রভাবে বেড়েছে শিশুদের শীতজনিত শ্বাসকষ্ট ও ডায়রিয়ার প্রাদুর্ভাব। চলতি মরসুমে শীতের পারদ সবচেয়ে নিচে নেমে আসে গতকাল বুধবার। এদিন দেশের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা চুয়াডাঙ্গায় রেকর্ড করা হয়েছে ৬ দশমিক ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস। আর সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে ২৩ দশমিক ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস। চুয়াডাঙ্গা আবহাওয়া অফিস জানিয়েছে, আগামী কয়েকদিন তীব্র এ শৈত্যপ্রবাহ অব্যাহত থাকতে পারে। গতবছর মধ্য জানুয়ারিতে চুয়াডাঙ্গার সর্বনিম্ন তাপমাত্রা নেমে এসেছিলো ৩ দশমিক ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস।  

গতকাল দেশের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ঈশ্বরদীতে ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস রেকর্ড করা হয়। আর চুয়াডাঙ্গায় সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ছিলো ৬ দশমিক ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস। আবহাওয়ার পূর্বাভাসে আবহাওয়া অধিদফতর জানিয়েছে, উপমহাদেশীয় উচ্চচাপ বলয়ের বর্ধিতাংশ পশ্চিমবঙ্গ এবং তৎসংলগ্ন বাংলাদেশের পশ্চিমাংশ পর্যন্ত বিস্তৃত। স্বাভাবিক লঘুচাপ দক্ষিণ বঙ্গোপসাগর পর্যন্ত বিস্তৃত। আকাশ অস্থায়ীভাবে আংশিক মেঘলাসহ সারাদেশের আবহাওয়া শুষ্ক থাকতে পারে। মধ্যরাত থেকে সকাল পর্যন্ত রংপুর, রাজশাহী, ঢাকা ও সিলেট বিভাগে মাঝারি থেকে ঘন কুয়াশা এবং দেশের অন্যত্র হালকা থেকে মাঝারি ধরনের কুয়াশা পড়তে পারে। রাজশাহী, পাবনা, টাঙ্গাইল ও কুষ্টিয়া অঞ্চলসমূহের ওপর দিয়ে মাঝারি ধরনের শৈত্যপ্রবাহ এবং রংপুর বিভাগসহ ময়মনসিংহ, ফরিদপুর, মাদারীপুর, সিলেট, বরিশাল ও যশোর অঞ্চলসমূহের ওপর দিয়ে মৃদু শৈত্যপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে এবং তা অব্যাহত থাকতে পারে এবং বিস্তার লাভ করতে পারে। সারাদেশে রাতের এবং দিনের তাপমাত্রা প্রায় অপরিবর্তিত থাকতে পারে।

এ বছর শীতের শুরুতেই শীতজনিত রোগের প্রাদুর্ভাব লক্ষ্য করা যাচ্ছে। অনেক শিশুর নিউমোনিয়াসহ শ্বাসকষ্ট ও রোটা ভাইরাসজনিত ডায়রিয়া রোগ দেখা দিয়েছে। প্রতিদিনই ১৫০-২০০ রোগী চুয়াডাঙ্গা হাসপাতালের বর্হিবিভাগে চিকিৎসা নিচ্ছে। ১৫টি আসনের বিপরীতে রোগী ভর্তি থাকছে ৪০-৫০জন। 

এদিকে শীত বস্ত্রের অভাবে ছিন্নমূল মানুষেরা চরম বিপাকে পড়েছেন। প্রচণ্ড ঠাণ্ডায় মানুষ সকাল ১০টার আগে ঘর থেকে বের হচ্ছেন না । আবার সন্ধ্যার পর ঘরে ফিরছেন। ফুটপাতের দোকানে গরম কাপড় কেনার জন্য দরিদ্র মানুষেরা ভিড় করছেন। খেটে খাওয়া মানুষেরা কাজ কাম করতে পারছে না।

চুয়াডাঙ্গায় শাহজালাল ইসলামী ব্যাংক লিমিটেডের উদ্যোগে শীতার্তদের মাঝে শীতবস্ত্র বিতরণ করা হয়েছে। এ উপলক্ষে গতকাল বুধবার বিকেল ৪টায় চুয়াডাঙ্গা বড়বাজার মালিক টাউয়ারে ব্যাংকের নিজস্ব কার্যালয়ে ৪৫০ পিস শীতবস্ত্র বিতরণ করা হয়।

প্রধান অতিথি ছিলেন চুয়াডাঙ্গা-১ আসনের সংসদ সদস্য সোলায়মান হক জোয়ার্দ্দার ছেলুন। উপস্থিত ছিলেন ব্যাংক ব্যবস্থাপক সাইফুল ইসলাম, চেম্বার সভাপতি ইয়াকুব হোসেন মালিক, সাবেক সভাপতি হাবিবুর রহমান লাভলু, মোটরমালিক গ্রুপের সভাপতি মো. সালাউদ্দিন, জেলা বাসমালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক হাজি আবুল কালাম, ব্যবসায়ী শামসুল ইসলাম এবং ব্যাংকের কর্মকর্তাবৃন্দ।

অপরদিকে, শীতবস্ত্র বিতরণ করেছে জনতা ব্যাংক। সামজিক দায়বদ্ধতার অংশ হিসেবে জনতা ব্যাংক লিমিটেড জেলার ২০০ জন হতদরিদ্রের মাঝে শীতবস্ত্র বিতরণ করে। বুধবার বেলা ১১টায় চুয়াডাঙ্গা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির আয়োজনে এ শীতবস্ত্র বিতরণ করা হয়। প্রধান অতিথি ছিলেন চুয়াডাঙ্গা-১ আসনের সংসদ সদস্য সোলায়মান হক জোয়ার্দ্দার ছেলুন। বিশেষ অতিথি ছিলেন চুয়াডাঙ্গা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি ইয়াকুব হোসেন মালিক। সভাপতিত্ব করেন জনতা ব্যাংক চুয়াডাঙ্গ জোনের এজিএম বীরেন্দ্র চন্দ্র তফাদার। উপস্থিত ছিলেন- চুয়াডাঙ্গা জেলা ছাত্রলীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি রুবাইয়েত বিন আজাদ সুস্তির, চুয়াডাঙ্গা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সিনিয়র সহসভাপতি শাহারিন হক মালিক, সহসভাপতি মঞ্জুরুল আলম মালিক লার্জ, পরিচালক নাসির আহাদ জোয়ার্দ্দার, সেলিম আহমেদ, আরিফ হোসেন জোয়ার্দ্দার সোনা, সালাউদ্দিন মো. মর্তুজা, একেএম সালাউদ্দিন মিঠু, নীল রতন সাহা ও এএনএম আরিফ।

অনুষ্ঠানের শুরুতে বীর মুক্তিযোদ্ধা সোলায়মান হক জোয়ার্দ্দার ছেলুন চুয়াডাঙ্গা-১ আসনে দ্বিতীয় বারের মতো সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ায় চুয়াডাঙ্গা চেম্বারের পক্ষ থেকে ফুলের তোড়া উপহার দিয়ে শুভেচ্ছা জানানো হয়।

জীবননগর ব্যুরো জানিয়েছে, জীবননগরে প্রচণ্ড শীতে এক বৃদ্ধার মৃত্যু হয়েছে। উপজেলার বেনীপুর গ্রামের হাওয়াতন নেছা (৮০) গত মঙ্গলবার বিকেলে প্রচণ্ড শীতে অসুস্থ হয়ে পড়লে হাসপাতালে নেয়ার পথে তার মৃত্যু হয়। এদিকে গত এক সপ্তা ধরে হিমেল হাওয়া আর ঘনকুয়াশায় জীবনযাত্রা স্থবির হয়ে পড়েছে। কনকনে শীতে সন্ধ্যা ৭টার সময় বাজার-ঘাট প্রায় জনশূন্য হয়ে পড়ছে। শীতার্ত মানুষেরা কেউ কেউ গাছের ঝরাপাতা কুড়িয়ে ও খড়কুটে  জ্বালিয়ে শীত নিবারণের চেষ্টা করছে। প্রচণ্ড শীতে বৃদ্ধ ও শিশুদের মধ্যে সর্দিজ্বর, আমাশা, নিউমোনিয়া ও ডায়রিয়ার প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছে। উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ও বিভিন্ন ক্লিনিকগুলোতে শীতজনীত রোগে অসুস্থ হয়ে অনেক রোগী ভর্তি হচ্ছে। এছাড়া বিভিন্ন হাট-বাজারের পুরাতন কাপড়ের দোকানগুলোতে শীতবস্ত্র কেনার জন্য ছিন্নমূল মানুষের উপচেপড়া ভিড় লক্ষ্য করা যাচ্ছে।

মেহেরপুর অফিস জানিয়েছে, ঠাণ্ডাজনিত রোগে আক্রান্ত অনেক শিশু মেহেরপুর জেনারেল হাসপাতাল ভর্তি হয়েছে। প্রতিদিন প্রায় ৬০ থেকে ৭০ জন শিশু হাসপাতালে ভর্তি থাকছে। স্থান সংকুলান না হওয়ায় মেঝেতে বিছানা পেতে শিশুর আত্মীয়স্বজনরা চিকিৎসা নিচ্ছে। এক্ষেত্রে বিনা পয়সায় ব্যবস্থাপত্র পেলেও পরিমাণমতো ওষুধ পাচ্ছেন না বলে অভিযোগ তুলেছেন রোগীর স্বজনরা।

সরেজমিনে হাসপাতালে শিশু ওয়ার্ডে দেখা যায়, শিশু ওয়ার্ডে অনেক শিশু রোগী ভর্তি রয়েছে। রোগীর চাপে মেঝেতে শিশুদের নিয়ে মায়েরা বিছানা পেতে অবস্থান নিয়েছেন। জুনায়েদ (২ মাস), রিফাত (৯ মাস) ও ঋতু (১ মাস) প্রমুখ নামের অর্ধশতাধিক শিশু রয়েছে শিশু ওয়ার্ডে। নিউমোনিয়া, ব্রনকাইটিসসহ ঠাণ্ডাজনিত বিভিন্ন রোগে ভুগছে তারা। প্রতিদিনই নতুন নতুন শিশু আসছে আর কয়েকদিন থাকার পর ফিরে যাচ্ছে। কথা হয় গাংনীর তিরাইল থেকে আসা জুনায়েদ নামের শিশুর মা বেনুয়ারার সাথে। তিনি জানান, আমার ছেলের নিউমোনিয়া হয়েছে। মেহেরপুর হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে এসেছি। কিন্তু বাইরে থেকে ওষুধ নিতে হচ্ছে। মেহেরপুর শহরের মল্লিকপাড়ার রিফাত নামের শিশুর মা মালেকা বলেন, অতিরিক্ত ঠাণ্ডায় আমার ছেলের নিউমোনিয়া হয়েছে। চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্র পাচ্ছি। কিন্তু হাসপাতালের ওষুধ তেমন পাচ্ছি না। বাইরে থেকে কিনতে হচ্ছে। খোকসা গ্রামের শিশু ঋতুর মা আরবিয়া খাতুন অনুরূপ কথা বলেন।

হাসপাতালের কর্তব্যরত শিশুবিষয়ক চিকিৎসক ওবাইদুল ইসলাম পালাশ জানান, মূলত এসব ঠাণ্ডাজনিত রোগ। প্রতিবছর এ শীতের সময় শিশুদের এ ধরনের ঠাণ্ডাজনিত রোগ হয়ে থাকে। এতে ভয়ের কোনো কারণ নেই। অতিরিক্ত শীতের কারণে বাচ্চাদের ঠাণ্ডা লাগাতেই নিউমোনিয়া, ব্রনকাইটিসসহ বিভিন্ন ঠাণ্ডাজনিত রোগ হচ্ছে। এ থেকে পরিত্রাণ পেতে হলে ঠাণ্ড না লাগে তার জন্য শিশুকে সব সময় গরম কাপড় পরিয়ে রাখতে হবে এবং মায়েদের সচেতন হতে হবে।