চুয়াডাঙ্গায় বিভিন্ন আইন প্রয়োগকারী সংস্থার মাদকবিরোধী অভিযানে ৭ মাসে ৫১৩টি মামলাসহ ৬৩২ জন গ্রেফতার

জনমনে প্রশ্ন আত্মসমর্পণকারীরা কী ফিরে গেছে পূর্বের পেশায়? না কি তালিকার বাইরে থাকা হোতারা হয়ে উঠেছে বেপরোয়া?
নজরুল ইসলাম: মাদক ধ্বংস করে দেশ-জাতি পরিবার সমাজ এমন কি ব্যক্তিকে। মারণনেশার কবলে পড়ে যুবসমাজ হয়ে পড়ে বিপর্যস্ত। সমাজে বৃদ্ধি পায় খুন ধর্ষণ, চুরি ডাকাতি ও ছিনতাইসহ বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকা-। মাদকের কারণে মানব উন্নয়ন হয় বিঘিœত। আর মানব উন্নয়ন ছাড়া দেশ ও জাতির উন্নয়ন সম্ভব নয়। তাইতো মাদককারবারীরা দেশ ও জাতির ভয়ঙ্কর শত্রু। এদের রুখতে না পারলে যুবসমাজ যেমন হয়ে পড়ে পঙ্গু তেমন মানুষ হারায় কার্যক্ষম। সমাজে নেমে আসে অবক্ষয়। এ কথা ভেবেই চুয়াডাঙ্গা জেলাকে মাদকমুক্তকরণের জন্য চলতি বছর মার্চ মাসে মাদককারবারীদের রুখতে প্রশাসন শুরু করে মাদকবিরোধী অভিযান। জেলার মাদককারবারীদের তালিকা প্রস্তুত করে প্রশাসন। সেই সাথে প্রশাসনের পক্ষ থেকে মাদক কারবারীদের আত্মসমর্পণের আহ্বান জানানো হয়। আর মাদক নয়, সুস্থ জীবন চাই স্লোগানে উদ্বুব্ধ হয়ে মহাসমাবেশে মাদক ব্যবসা না করার অঙ্গীকার করে ৪৬৫ জন মাদককারবারী আত্মসমর্পণ করে। সে সময় চুনোপুটিরা আত্মসমর্পণ করলেও রাজনৈতীক ছত্রছায়ায় ধরা-ছোঁয়ার বাইরে থেকে যায় মূলহোতারা। ফলে আবারও মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে মাদককারবারীরা। ৭ মাসের ব্যবধানে জেলায় মাদক মামলা হয়েছে ৫১৩টি, গ্রেফতার হয়েছে ৬৩২ জন। আইনপ্রয়োগকারী সংস্থা উদ্ধার করেছে মাদকসহ বিভিন্ন মালামাল। জনমনে প্রশ্ন জেগেছে আত্মসমর্পণকারীরা কি নিজেকে রক্ষা করতে আত্মসমর্পণ করেছিলো? নাকি আত্মসমর্পণের খাতায় নাম লিখিয়ে প্রশাসনকে ধোঁকা দিয়েছে?
মাদক হচ্ছে একটি ভেষজ দ্রব্য যা গ্রহণে মানুষের স্বাভাবিক শারীরিক ও মানসিক অবস্থার ওপর প্রভাব পড়ে। যা আসক্তি সৃষ্টি করে। মাদকদ্রব্যে সেবনে তন্দ্রাচ্ছন্নতা, মেজাজ পরিবর্তন, মানসিক, আচ্ছন্নতা রক্তচাপের পরিবর্তন ঘটায়। মাদকদ্রব্য গ্রহণ করলে মানুষের শারীরিক ও মানসিক অবস্থার উল্লেখযোগ্য নেতিবাচক পরিবর্তন ঘটে। দিন দিন মাদক গ্রহণের ফলে এর প্রতি আসক্তি বাড়ে। মানুষ নেশার জন্য যা ব্যবহার করে তাই মাদকদ্রব্য। মাদকসেবীদের নিকট পরিচিত নাম ফেনসিডিল, হেরোইন, গাঁজা, মদ, ইয়াবা। এছাড়াও বিভিন্ন প্রকার অ্যানার্জি ড্রিংক কোমলপানীয়। মাদকসেবনের পরপরই ব্যক্তির মস্তিষ্কে ডোপামিন নামক নিওরোট্রান্সমিটার বৃদ্ধি পায়। দীর্ঘদিন ধরে মাদকসেবন করলে একজন মানুষ তার সকল কার্যক্ষম হারিয়ে ফেলে। প্রকৃতপক্ষে দেখা যায় মাদকাসক্ত ব্যক্তি আসলে একটা সময়ে আর আনন্দের জন্য নেশা করে না। এটা তার অভ্যাসে পরিণত হয়ে গেছে। ফলে মাদকই হয়ে পড়ে মাদকাসক্ত ব্যক্তির একমাত্র চিন্তা-চেতনা। এক সময় ক্ষতিকর প্রভাবে ডেকে আনে তার মৃত্যু।
অপরদিকে একজন মানুষ যখন অন্ধকার জগতে পা বাড়ায় তখন সে প্রথম সিঁড়ির যে ধাপটিতে পা রাখে তা হলো মাদক সেবন। মাদক সেবন তাকে টেনে নিয়ে উৎসাহিত করে পরবর্তী ধাপগুলো পেরিয়ে যেতে। ভৌগোলিক অবস্থানের ভিত্তিতে বাংলাদেশের মাদকব্যবসা ও প্রাপ্তির সহজলভ্যতা বেশি এবং বর্তমান অবস্থানের প্রেক্ষিতে তরুণ সমাজ এদিকে ঝুঁকেছেও বেশি। ঠিক যেমনটি প্রত্যাশা মাদক ব্যবসায়ীদের। আর মাদককেনার অর্থ জোগাড় করতে গিয়েই কিশোর-তরুণরা ব্যাপকভাবে নানা অপরাধের সাথে জড়িয়ে পড়ছে। এ সুযোগে মাদকব্যবসায়ী, সংঘবদ্ধ অপরাধীচক্র খুন, অপহরণ ও চাঁদাবাজিসহ নানা কাজে তাদের ব্যবহার করতে থাকে। মাদকের এই নেশার জালে একবার জড়িয়ে পড়লে কেউ আর সহজে বেরিয়ে আসতে পারে না। ফলে মাদকসেবীরা দিনে দিনে আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠে। আর এ কারবারের সাথে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সমাজের বিত্তশালী ব্যক্তি থেকে শুরু করে নারী ও শিশু-কিশোররাও জড়িত। এটা সহজেই অনুমান করা যায় যে, মাদকাসক্তির কারণে যুবসমাজের নিজেদের জীবন শুধু বিপন্ন হয় না, এতে গোটা পরিবার এবং সমাজ ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
বিষয়টি উপলব্ধি করে তৎকালীন চুয়াডাঙ্গা পুলিশ সুপার বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক, জনপ্রতিনিধিদের সাথে নিয়ে সামাজিক আন্দলন গড়ে তোলেন। পাশাপাশি মাদককারবারীদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনতে নানা উদ্যোগ গ্রহণ করে। চলতি বছর ৬ মার্চ চুয়াডাঙ্গা সরকারি কলেজ মাঠে পুলিশের আহ্বানে সাড়া দিয়ে জেলা কমিউনিটি পুলিশিং সমন্বয়ে অনুষ্ঠিত মহাসমাবেশে জেলার ৪৬৫ জন মাদকের সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা আত্মসমর্পণ করে। মহাসমাবেশে প্রধান অতিথি ছিলেন খুলনা রেঞ্জের ডিআইজি এসএম মনিরুজ্জামান। আত্মসমপর্ণকারীদের পুনর্বাসনের প্রতিশ্রুতিও দেয়া হয়েছিলো। একটি সূত্র বলেছে, সে দিন যারা আত্মসমর্পণ করেছিলো তারা মূলত ছিলেন সেবনকারী ও জন হাজিরার মাদকবহণকারীরা। মূলহোতারা বিভিন্ন রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় থেকে নিজেদেরকে কিছুদিন আড়াল করে রাখে। বর্তমানে সে সব হোতারা মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে।
জেলা পুলিশ সুপার কার্যালয়সূত্রে জানা গেছে, চলতি বছর ১ মার্চ থেকে ৩০ সেপ্টম্বর পর্যন্ত বিভন্ন আইন প্রয়োগকারী সংস্থার মাধ্যমে মাদক মামলা হয়েছে ৫১৩টি, আর মাদক মামলায় গ্রেফতার হয়েছে ৬৩২ জন, ফেনসিডিল উদ্ধার হয়েছে ৬ হাজার ৭শ বোতল, ইয়াবা ট্যাবলেট উদ্ধার হয়েছে ২ হাজার ৩০৯ পিস, গাঁজা ৪৬ কেজি ১৯১ গ্রাম, গাঁজার পুরি উদ্ধার হয়েছে ৬৯৭টি, গাঁজা গাছ ১টি, প্যাথেডিন ইনজেকশন ৭৩০ পিস, হেরোইন ৫১০ গ্রাম, হেরোইনের পুরি ২৬৭টি, চুলাই মদ ১০৫ লিটার, বাংলা মদ ১৪৬ লিটার, ভারতীয় মদের বোতল ৬৭টি, ভারতীয় বেঙ্গল টাইগার ৯৮টি, এলকোহল ৩৮ লিটার, মাদকবহনকারীদের ব্যবহৃত মোটরসাইকেল ১৯টি, বাইসাইকেল ১১টি, মেশিন ১টি, মোবাইল ৯টি, সিমকার্ড ৯টি, তাড়ি ১৩৩ লিটার, কেরুজ মদ ১.৪ মি.লি ভারতীয় গরু ৩টি, ইলিশ মাছ ১৪০ কেজি ও সোনা ৪৮১ ভরী ৩ আনা। প্রতিদিনই জেলার কোথাও না কোথাও বিভিন্ন আইন প্রয়োগকারী সংস্থার হাতে ধরা পড়ছে মাদকের চালান। সর্বশেষ গতপরশু বুধবার চুয়াডাঙ্গা ৬ বিজিবি বিভিন্ন জায়গায় মাদকবিরোধী অভিযান চালিয়ে বিপুল পরিমাণ মাদক দ্রব্যসহ ৯ জনকে আটক করেছে। তবে বরাবরের মতোই ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যাচ্ছে হোতারা। যদিও পুলিশ, বিজিবি, র‌্যাব, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্র অধিদফতরের পক্ষ থেকে মাদকবিরোধী অভিযান অব্যাহত রয়েছে। মাদকের ব্যাপারে করছে না কোনো আপস। প্রশ্ন উঠেছে- এতো কিছুর পরও এতো মাদক আসছে কোথা থেকে? আর কারাই বা এ সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ করছে? মাদককারবারীরা কি খুবই শক্তিশালী? এদিকে জেলার সাথে ৫২ কি.মি. ভারতের সীমান্ত রয়েছে। মাদকগুলো ধরা পড়ে দেশের অভ্যান্তরে। তাহলে এসব মাদক দেশের অভ্যান্তরে আসছে কিভাবে?
ভুক্তোভোগী মহল মনে করছেন, সম্প্রতি ইয়াবা আসক্তির যে প্রবণতা দেখা দিয়েছে তা সমগ্র জাতির জন্য এক ভয়াবহ পরিণতির ইঙ্গিতবাহী। ইয়াবা কেবল আমাদের তরুণ প্রজন্মের প্রাণশক্তি ও মেধাকে ধ্বংস করছে না, ইয়াবার কারণে সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে অপসংস্কৃতি ও অপরাধের বিস্তার ঘটছে। দিন দিন ইয়াবা আসক্তদের সংখ্যা অস্বাভাবিক বেড়েই চলেছে। তাই মাদকাসক্তির বিরুদ্ধে সামাজিক সচেতনতা গড়ে তোলা, মাদকদ্রব্যের অনুপ্রবেশ সম্পূর্ণ বন্ধ করা, মাদকব্যবসার সাথে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িতদের গ্রেফতার ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা অতিব জরুরি হয়ে পড়েছে। পাশাপাশি সচেতনতার কোনো বিকল্প নেই, আমাদের এই সচেতনতা এবং সহযোগিতায় যুবসমাজকে যুব শক্তিতে পরিণত করতে হবে। যদিও বর্তমান পুলিশ, বিজিবি, র‌্যাব, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ সংস্থা মাদকের ব্যাপারে সোচ্চার রয়েছে।
এ ব্যাপারে চুয়াডাঙ্গা পুলিশ সুপার মাহবুবুর রহমান পিপিএম বলেন, মাদককারবারীরা দেশ ও জাতির শত্রু। আমি জেলাতে নতুন এসেছি তাই সব বিষয়ে এখনও জানা সম্ভব হয়নি। তারপরও বিষয়টি খোঁজখবর নিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।