চুয়াডাঙ্গায় প্রকাশ্যে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে খুন : ক্ষতবিক্ষত এক কিশোর মৃত্যুশয্যায়

 

স্টাফ রিপোর্টার: চুয়াডাঙ্গা জেলা শহরের মাস্টারপাড়ায় প্রকাশ্যে দিবালোকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে এক যুবককে খুন করা হয়েছে। প্রতিপক্ষ একদল যুবক তাকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে ঘাড়েসহ শরীরের বিভিন্ন স্থানে কোপ মারে। একই স্থানে ধারালো অস্ত্রের উপুর্যপরি কোপে ক্ষতবিক্ষত হয়ে মৃত্যুর সাথে লড়ছে অপর এক কিশোর। ঘটনাটি ঘটেছে গতকাল শনিবার বেলা পৌনে ১টার দিকে চুয়াডাঙ্গা জেলা শহরের শিশু স্বর্গের অদূরবর্তী মাস্টারপাড়া সড়কে।

ধারালো অস্ত্রের কোপে নিহত হানিফ রহমান ভুলু (২৩) চুয়াডাঙ্গা জেলা শহরের জিনতলা মল্লিকপাড়ার (সরদারপাড়া) খবির সরদারের ছেলে। সে চুয়াডাঙ্গা বড়বাজারের নিচেরবাজারের অহিদুল কসাইয়ের নিকট কাজ করতো। সম্প্রতি শুরু করেছিলো মাছের ব্যবসা। পৌর ছাত্রলীগ নেতা মাফির সাথে থাকতো সে। সেই সুবাদে তাকে অনেকেই ছাত্রলীগ কর্মী বলেই চিনতো। ধারালো অস্ত্রের উপুর্যপরি কোপে ক্ষতবিক্ষত আকাশ (১৭) মাস্টারপাড়ার বাবলু রহমানের ছেলে। তাকে জরুরি ভিত্তিতে ২ ব্যাগ রক্ত দিয়ে আশঙ্কাজনক অবস্থায় ঢাকায় নেয়া হয়েছে।

জানা গেছে, হানিফ রহমান ভুলু গতকাল শনিবার দুপুর পৌনে ১টার দিকে বড়বাজারের নিচেরবাজার থেকে বাড়ি ফিরছিলো। পায়ে হেঁটে বাড়ি ফেরার পথে শিশু স্বর্গের নিকটস্থ মাস্টারপাড়া সড়কে তার ওপর হামলা চালানো হয়। ঘাড়েসহ শরীরের বিভিন্ন স্থানে কোপ মারে। ধারালো অস্ত্রের কোপ ঠেকাতে গিয়ে হাতেও লাগে কোপ। রক্তাক্ত মৃতপ্রায় অবস্থায় পড়ে থাকে রাস্তার ওপর। এ সময় একই দিকে পায়ে হেঁটে যাচ্ছিলো আকাশ। তাকেও ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে ক্ষতবিক্ষত করা হয়। প্রথমে তাকে ও পরে ভুলুকে হাসপাতালে নেয়া হয়। ভুলুর অবস্থা গুরুতর হওয়ায় তাকেই প্রথমে নেয়া হয় চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালের অপারেশন থিয়েটারে। প্রয়োজনীয় চিকিৎসা দেয়ার কিছুক্ষণের মাথায় মারা যায় ভুলু। অপারেশন থিয়েটারে কর্তব্যরত চিকিৎসক ডা. ওয়ালিউর রহমান নয়ন তাকে মৃত বলে ঘোষণা করেন।  মৃতদেহ রেখে অপারেশন থিয়েটারে নেয়া হয় আকাশকে। তার শরীরে রক্ত দেয়া হয়। ধারালো অস্ত্রের কোপে ক্ষতবিক্ষত স্থানে অসংখ্য সেলাই দেয়ার পাশাপাশি উন্নত চিকিৎসার জন্য কর্তব্যরত চিকিৎসক ঢাকায় নেয়ার পরামর্শ দেন। ফলে বিকেলেই তাকে অ্যাম্বুলেন্সযোগে ঢাকার উদ্দেশে নেয়া হয়। গতরাতে শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত আশঙ্কাজনক অবস্থায় চিকিৎসাধীন ছিলো সে। আকাশকে ঢাকায় নেয়ার আগে তার নিকট থেকে ঘটনার বর্ণনা শোনে পুলিশ। তার জবানবন্দি পুলিশ রেকর্ড করলেও তদন্তের স্বার্থে তা গোপন রেখেছে। তবে আকাশ সাংবাদিকদের সামনে তাৎক্ষণিকভাবে বলে, আমি হেঁটে বাড়ির দিকে যাচ্ছিলাম। দেখি ৩জন দৌড়ে আসছে। আমাকে সামনে পেলো। একজন ‘ধর, ওকেও মার’ বলতেই ধারালো অস্ত্র দিয়ে ওরা কয়েকজন কোপাতে শুরু করলো। ওদের একজনের বাড়ি রেলপাড়ায়। অন্যদের দেখলে চিনবো। অপরদিকে বেলা ২টার দিকে চুয়াডাঙ্গা টাউন ফুটবল মাঠের বিপরীতের হোটেল শয়ন বিলাসে তল্লাশি শুরু করে পুলিশ। তিনজনকে আটক করে। উদ্ধার করে ধারালো অস্ত্র। এ খবর ছড়িয়ে পড়লে হামলাকারীরা ধরা পড়েছে বলে গুঞ্জন ছড়ায় শহরে। পুলিশ অবশ্য বলেছে, খুনের সাথে জড়িত আছে কি-না তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। (এ বিষয়ে বিস্তারিত পৃথক প্রতিবেদনে)

চুয়াডাঙ্গা মাস্টারপাড়ার রাস্তায় প্রকাশ্যে কুপিয়ে একজনকে খুন করার খবর জেলা শহরে ছড়িয়ে পড়লে ক্রমশ শহরের অধিকাংশ রাস্তায় জনসংখ্যা হ্রাস পেতে থাকে। অনেক দোকানিও তাদের প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে বাড়ি ফিরতে থাকে। টিভি চ্যানেলের বদৌলতে খবর দেশবাসী জানার পর দূরে থাকা চুয়াডাঙ্গার মানুষ মোবাইফোনে বিস্তারিত জানার চেষ্টা করে। এদিকে সন্ধ্যায় কবরী রোডস্থ জেলা আওয়ামী লীগের দলীয় কার্যালয়ে সাংবাদিকদের আহ্বান করা হয়। এ সময় হানিফ রহমান ভুলুর বড় ভাই মিলন হোসেন কালু বলেন, আমার ভাই রাজনীতির সাথে জড়িত ছিলো না। ওদের সাথে আগে মেলামেশা করলেও করতে পারে। কিছুদিন যাবত সবাইকে এড়িয়ে চলছিলো। আর এ কারণেই খুন হতে হল ভুলুকে। সেখানে জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি জাতীয় সংসদের হুইপ সোলায়মান হক জোয়ার্দ্দার ছেলুন এমপিসহ দলীয় নেতাকর্মীরা উপস্থিত ছিলেন। তাৎক্ষণিক আয়োজিত এ সংবাদ সম্মেলনে লাড্ডুর ছেলে সারাফত ওরফে সাদা, সালামের ছেলে শাওন ও সজল, মোশারফের ছেলে  সজিব, মেহেরুনের ছেলে মিলন, কাছের আলীর ছেলে মিজান ও নুরুর ছেলে রবিনকে দায়ী করা হয়। এদের নাম লিখে তালিকাও সরবরাহ করা হয় সংবাদ সম্মেলনে। সকল প্রকার রাজনীতি বাইরে রেখে ভাই হত্যার সাথে জড়িত প্রকৃত অপরাধীদের বিচার দাবি করেন তিনি।

এদিকে গতরাত সাড়ে ৯টার দিকে চুয়াডাঙ্গা পৌর মেয়র ওবায়দুর রহমান চৌধুরী জিপু চুয়াডাঙ্গা জিনতলা-মল্লিকপাড়ার শোকার্ত বাড়িতে যান। নিহত হানিফ রহমান ভুলুর মাসহ পরিবারের সদস্যদের সাথে কথা বলেন। তিনি বলেন, খুনি যেই হোক তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হওয়া দরকার।

এদিকে ঘটনার পরপরই চুয়াডাঙ্গার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার বেলায়েত হোসেন, সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (তদন্ত) এএইচএম কামরুজ্জামান খান, ডিবি ওসি ইউনুস আলী সঙ্গীয় ফোর্স নিয়ে হাসপাতালসহ ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন। অতিরিক্ত পুলিশ সুপার বলেন, খুনের কারণ এখন পর্যন্ত নিশ্চিত করে আমরা জানতে পারিনি। তবে ক্ষমতাসীন দলের দুটি গ্রুপের বিরোধের কারণে এক গ্রুপের ছেলেরা অপর গ্রুপের ছেলেকে কুপিয়ে খুন করেছে। হত্যা মামলা না হলেও ধারালো অস্ত্রের কোপে রক্তাক্ত জখম আকাশের মা বিধি খাতুন বাদী হয়ে মামলা দায়ে করেছেন। শয়ন বিলাস থেকে যে ৩ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে তাদের বিষয়ে খোঁজ খবর নেয়ার পাশাপাশি প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদ চলছে। খুনি ধরতে পুলিশি অভিযান অব্যাহত রাখা হয়েছে।

গতরাতে শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত হানিফ রহমান ভুলুর মৃতদেহ চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালের লাশ রাখা ঘরেই রাখা ছিলো। গতকাল দুপুরে খুনের ঘটনা ঘটলেও বিকেল পর্যন্ত কেন ময়নাতদন্ত সম্পন্ন করা যায়নি তা অবশ্য নিশ্চিত করে জানা সম্ভব হয়নি। আজ রোববার ময়নাতদন্ত শেষে দাফন কাজ সম্পন্ন করা হতে পারে। সন্তান হারিয়ে ভুলুর মা শয্যাশায়ী হয়ে পড়েছেন। শোকার্ত মাকে চিকিৎসাধীন রাখা হয়েছে। হানিফ রহমান ভুলুর মা বলেছেন, খুনি যারাই হোক তাদের বিচার চাই।  অবশ্য গতকাল শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত এ পরিবারের পক্ষে কেউ বাদী হয়ে থানায় মামলা করেননি বলে জানিয়েছে পুলিশ। নিহত হানিফ রহমান ভুল দু ভাইয়ের মধ্যে ছিলো ছোট।