চির অন্তরালে চলে গেলেন মহানায়েকা

অবসান হল বাংলা চলচ্চিত্রের স্বর্ণযুগের এক অধ্যায়ে

 

মাথাভাঙ্গা মনিটর: দীর্ঘ লড়াইয়ের অবসান। টানা ২৬ দিন হাসপাতালে তার জীবন রক্ষায় চলে সর্বাত্মক চেষ্টা। চিকিৎসকদের সকল প্রচেষ্টাকে হার মানিয়ে গতকাল শুক্রবার সকাল স্থানীয় সময় সকাল সাড়ে ৮টার দিকে হৃদরোগ আক্রান্ত হয়ে জীবনাবসান হলো মহানায়িকা সুচিত্রা সেনের। আর সেই সাথেই অবসান হলো বাংলা চলচ্চিত্রের স্বর্ণযুগের এক অধ্যায়ের। শেষকৃত্য সম্পন্ন হয় ভারতীয় সময় বিকেল সাড়ে ৫টায়।

গত ২৩ ডিসেম্বর ফুসফুসে সংক্রমণ নিয়ে মধ্য কোলকাতার এক বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি হন তিনি। টানা প্রায় এক মাস তার শারীরিক অবস্থা নানা উত্থান-পতনের মধ্যদিয়ে চলছিলো। ফুঁসফুঁসে সংক্রমণের পাশাপাশি তার হৃদস্পন্দন বেড়ে যাওয়ায় ২৯ ডিসেম্বর রাতে তাকে আইটিইউ-তে স্থানান্তরিত করা হয়। টানাপোড়েন চলছিলো বৃহস্পতিবার রাত থেকেই। প্রবল শ্বাসকষ্টে কাতরাচ্ছিলেন মহানায়িকা। কাজ দেয়নি নন ইনভেসিভ ভেন্টিলেটরও। চিকিৎসা নিতে তার প্রবল অনীহা যেকোনো একটা বড় বিপদ ডেকে আনছে তার আঁচ পাচ্ছিলেন চিকিৎসকেরা। কিন্তু সুচিত্রা সেন চিকিৎসা প্রত্যাখ্যানের ব্যাপারে নিজের জেদে এতোটাই অনড় ছিলেন যে চিকিৎসকদের ভূমিকা কার্যত ছিলো অসহায় দর্শকের। এ দিন সকাল ৭টায় পালস রেট নেমে যায় আচমকাই। ৮টায় হৃদস্পন্দন বন্ধ হয়ে যায়। ডাক্তারি পরিভাষায় যাকে বলে ম্যাসিভ কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট। শুরু হয় হৃদপিন্ডের ম্যাসাজ। কিন্তু সব চেষ্টা ব্যর্থ হয়ে যায় সকাল ৮টা ২৫ মিনিটে। মহানায়িকার মৃত্যু সংবাদ পাওয়ার পরেই হাসপাতালে ছুটে যান মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এরই মধ্যে প্রশাসনিক তত্পরতা তুঙ্গে ওঠে। বেলা ১০টা ২০ নাগাদ মুখ্যমন্ত্রী নিজেই হাসপাতালের বাইরে অপেক্ষমান সাংবাদিকদের কাছে সুচিত্রার প্রয়াণ সংবাদ ঘোষণা করেন। সুচিত্রা-কন্যা মুনমুন হাতজোড় করে সংবাদমাধ্যমকে প্রণাম জানান। বলেন, মায়ের হয়ে আপনাদের প্রণাম। ঠিক হয়, যতো দ্রুত সম্ভব তার দেহ বালিগঞ্জের বাড়ি হয়ে কেওড়াতলা শ্মশানে শেষকৃত্যের জন্য নিয়ে যাওয়া হবে। পোড়ানো হবে চন্দন কাঠে।

ইতোমধ্যে বেলুড় মঠ থেকে হাসপাতালে এসে পৌঁছান তিন সন্ন্যাসী স্বামী বিমলাত্মানন্দ (তাপস মহারাজ), স্বামী সুদেবানন্দ (মাখন মহারাজ), স্বামী গুরুদশানন্দ (উজ্বল মহারাজ)। মৃতদেহের গলায় শ্রীরামকৃষ্ণের প্রসাদী মালা পরিয়ে দেয়া হয়। মৃতদেহে পরানোর জন্য মুনমুনের হাতে তুলে দেয়া হয় সারদাদেবীর প্রসাদী শাড়ি। এসে পৌঁছায় শববাহী গাড়িও। ততোক্ষণে সুচিত্রাকে পরানো হয়ে গিয়েছে শেষযাত্রার পোশাক। শাদা বেনারসি। তার ওপরে জড়ানো সোনালি গরদের চাদর। ঘোমটা দেয়া। কপাল থেকে চিবুক পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে ঘোমটার ভেতর থেকে। যেন শান্তিতে ঘুমিয়ে আছেন। কফিনে বন্ধ মহানায়িকার মরদেহ ফুল দিয়ে সাজানো ওই গাড়িতে তোলা হয় বেলা সাড়ে ১২টায়।

পুলিশ পাইলট দিয়ে শববাহী গাড়ি বের হয় হাসপাতাল থেকে। এ গাড়ির পেছনেই ছিলো মুনমুন, রিয়া ও রাইমার গাড়ি। তার ঠিক পেছনেই মুখ্যমন্ত্রীর গাড়ি। মরদেহ নিয়ে গাড়ির কনভয় যায় বালিগঞ্জের বাড়িতে। সেখানে মিনিট পাঁচেক মরদেহ রেখে সোজা কেওড়াতলা।
আগেই মহানায়িকাকে গান স্যালুট দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলো রাজ্য সরকার। দুপুর ১টা ৪০ মিনিট নাগাদ শ্মশানে তাকে গান স্যালুট দেয়া হয়। দুপুর ১টা ৫০ নাগাদ শুরু হয় শেষকৃত্য। সেখানে ছিলেন মুখ্যমন্ত্রী, রাজ্যের বিভিন্ন মন্ত্রী, পুলিশ-প্রশাসনের বিভিন্ন কর্তাব্যক্তি। শ্মশান চত্বর এবং আশপাশে নজিরবিহীন নিরাপত্তা ব্যবস্থা ছিলো। সুচিত্রার আপামর ভক্ত ভিড় করেছিলেন শ্মশানের বাইরে। এমনকি, চেতলা ব্রিজের ওপরেও তিলধারণের জায়গা ছিলো না। তাকে শেষ শ্রদ্ধা জানানোর জন্য রবীন্দ্র সদন চত্বরেও ছবি রাখা হয়েছিলো। সুচিত্রার মৃত্যু সংবাদ ছড়িয়ে পড়তেই যে ভিড় শুরু হয়েছিলো হাসপাতালের বাইরে, সেই ভিড়ই কার্যত জনসমুদ্রে পরিণত হয় শ্মশানে।

অন্তরালেই ছিলেন তিনি দীর্ঘদিন। এবার তিনে গেলেন চিরঅন্তরালে। তার মহাপ্রয়াণে দেশ-বিদেশে চলচ্চিত্রজগতে নেমে এসেছে শোকের ছায়া অনেকেই জানিয়েছেন শোক। মৃত্যুকালে রেখে গেলেন কন্যা মুনমুন সেন এবং দু নাতনি রাইমা ও রিয়া সেন। কেওড়াতলা মহাশ্মশানে কাঠের চুল্লিতে প্রায় তিন ঘণ্টা ধরে শেষকৃত্য চলে সুচিত্রা সেনের। হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে মরদেহ প্রথমে বালিগঞ্জের বাড়িতে, পরে কেওয়াতলা মহাশ্মশানে। সেখানে মুখ্যমন্ত্রী মমতার ব্যবস্থাপনায় ১২টার মধ্যে কেওড়াতলায় দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জনের সমাধির পাশেই কাঠের অস্থায়ী চুল্লি তৈরি করা হয়েছিলো। বেলা পৌনে ২টায় মুখাগ্নি করেন মেয়ে মুনমুন। ছিলেন দু নাতনি রিয়া ও রাইমা। পাশে ছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। শেষকৃত্য শুরুর ঘণ্টাখানেক পরে আসেন মিঠুন চক্রবর্তী। সন্ধ্যা ৬টায় শেষকৃত্য সম্পন্ন হয়। এরপরই মমতা ঘোষণা করেন, কোলকাতার বালিগঞ্জ স্কোয়ার নাম বদলে হচ্ছে, সুচিত্রা সেন স্কোয়ার আর বালিগঞ্জ ফাঁড়ির নাম বদলে হচ্ছে সুচিত্রা সেন সরণি। সাত পাকে বাঁধা ছবির জন্য ১৯৬৩ সালে মস্কোর চলচ্চিত্র উৎসবে সেরা অভিনেত্রীর শিরোপা অর্জন করেন সুচিত্রা। ওই বছরই হিন্দি ছবির জগতে ফিল্মফেয়ার পুরস্কার সেরা অভিনেত্রীর তালিকায় মনোনীত হন তিনি। আঁধির জন্যও একই পুরস্কারে মনোনীত হয়েছিলেন তিনি। হিন্দি দেবদাস ছবিতে পার্বতীর ভূমিকায় অভিনয় করে তিনি জাতীয় পুরস্কার পেয়েছেন। ২০০৫ সালে দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কার নিতে অস্বীকার করেন তিনি। তবে অভিনয় জীবনে অসামান্য অবদানের জন্য ২০১২ সালে পশ্চিমবঙ্গ সরকার তাকে বঙ্গবিভূষণ সম্মানে সম্মানিত করেছিলো। ১৯৭২ সালে ভারত সরকার তাকে পদ্মশ্রী খেতাবে সম্মানিত করে।

১৯৩১ সালের ৬ এপ্রিল বাংলাদেশের পাবনায় জন্মগ্রহণ করেন। তার শৈশবও কাটে। তার বাড়িটি থাকলেও তা দীর্ঘদিন ধরে বেদখলে।

জীবনের শেষ ৩৫টি বছর সচিত্রা কাটিয়েছেন অন্তরালে। অগ্নি পরীক্ষা, হারানো সুর, সপ্তপদী, পথে হলো দেরী, শাপমোচন বা শিল্পী চলচ্চিত্রে সুচিত্রার যে রূপ দর্শক দেখেছে, তাতে আর পড়বে না বলিরেখা, জরার ছাপ। বাংলা সিনেমার ক্ল্যাসিক জুটি উত্তম-সুচিত্রা ছবির মতোই দর্শক হৃদয়ে থাকবে চির অমলিন। এ বাংলার মেয়ে সুচিত্রার পারিবারিক নাম রমা দাশগুপ্ত। বাবা করুণাময় দাশগুপ্ত ছিলেন স্থানীয় স্কুলের প্রধান শিক্ষক। মায়ের নাম ইন্দিরা দেবী। পাবনাতেই তার শিক্ষাজীবন শুরু হয়।

১৯৪৭ সালে ঢাকার  অভিজাত পরিবারের সদস্য শিল্পপতি আদিনাথ সেনের পুত্র দিবানাথ সেনের সাথে তার বিয়ে হয়। ১৯৫২ সালে তিনি কোলকাতার চলচ্চিত্র অঙ্গণে প্রবেশ করেন। শেষ কোথায় চলচ্চিত্রের মাধ্যমে রূপালি পর্দায় তার যাত্রা শুরু হলেও ছবিটি মুক্তি পায়নি।

১৯৫৩ সালে উত্তম কুমারের বিপরীতে অভিনীত সাড়ে চুয়াত্তর তার প্রথম মুক্তিপ্রাপ্ত ছবি। ছবিটি ব্যবসা সফল হয়। তবে সেটি ছিল কমেডিনির্ভর ছবি এবং এর মূল আকর্ষণ ছিলেন ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়। ১৯৫৪ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত অগ্নিপরীক্ষা ছবিকে তার ক্যারিয়ারের টার্নিং পয়েন্ট বলা হয়। এ ছবিতেই উত্তম- সুচিত্রা বাংলা সিনেমার  ক্ল্যাসিক রোমান্টিক জুটিতে পরিণত হন।

এরপর একের পর এক হিট সিনেমায় অভিনয় করে দর্শকদের মহানায়িকায় পরিণত হন সুচিত্রা সেন। হারানো সুর, শাপমোচন, বিপাশা, ইন্দ্রাণী, শিল্পী, সাগরিকা, পথে হলো দেরী, রাজলক্ষ্মী ও শ্রীকান্ত, কমললতা, গৃহদাহ, প্রিয় বান্ধবী, দত্তা, পথের দাবী, সবার উপরে, সপ্তপদী, দীপ জ্বেলে যাই, উত্তর ফাল্গুনী, সাতপাকে বাঁধাসহ অসংখ্য ব্যবসাসফল ও শিল্পসম্মত ছবিতে অভিনয় করে বাংলা ছবির প্রধান নায়িকায় পরিণত হন তিনি।

সিনেমায় তার ব্যক্তিত্ব এবং সৌন্দর্য দুটিই দর্শককে মোহাবিষ্ট করে রাখে। তিনি সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, অশোক কুমার, বসন্ত চৌধুরী, দীলিপ কুমারসহ অনেক বিখ্যাত নায়কের বিপরীতে অভিনয় করেছেন। কিন্তু উত্তম কুমারের বিপরীতে তার জুটি সবচেয়ে বেশি দর্শকনন্দিত হয়। এবং উত্তম-সুচিত্রা জুটি চিরকালের সেরা রোমান্টিক জুটিতে পরিণত হয়।

সাতপাকে বাঁধা চলচ্চিত্রের জন্য ১৯৬৩ সালে মস্কো চলচ্চিত্র উৎসবে সেরা অভিনেত্রীর সম্মাননা অর্জন করেন। তিনি হিন্দি চলচ্চিত্রেও সাফল্য পেয়েছিলেন। কিন্তু বাংলা ছবির জগত ত্যাগ করেননি। এজন্য তার অভিনীত হিন্দি ছবির সংখ্যা খুবই কম। ১৯৫৫ সালে পরিচালক বিমল রায়ের হিন্দি ছবি দেবদাসে পার্বতীর ভূমিকায় অভিনয়ের জন্য সেরা অভিনেত্রীর জাতীয় পুরস্কার লাভ করেন।

১৯৭২ সালে তিনি পদ্মশ্রী খেতাবে ভূষিত হন। ১৯৭৪ সালে তার অভিনীত হিন্দি ছবি আঁধি ব্যাপকভাবে প্রশংসিত হয়। এ সিনেমায় অভিনয়ের জন্য তিনি ফিল্মফেয়ার পুরস্কারে সেরা অভিনেত্রীর মনোনয়ন পান। আর তার বিপরীতে অভিনয়ের জন্য সঞ্জীব কুমার সেরা অভিনেতার পুরস্কার জয় করেন। ২০১২ সালে ভারতের পশ্চিম বঙ্গ সরকার রাজ্যের সর্বোচ্চ সম্মাননা বঙ্গ বিভূষণে ভূষিত করে সুচিত্রা সেনকে।

দিবানাথ সেনের সাথে তার বিবাহিত জীবন সুখের হয়নি। তাদের একমাত্র সন্তান মুনমুন সেন এবং নাতনি রিয়া ও রাইমা সেনও চলচ্চিত্রাভিনেত্রী। ১৯৭৮ সাল থেকে সুচিত্রা সেন চলচ্চিত্রজগতকে বিদায় জানিয়ে নির্জনে বসবাস শুরু করেন। এবং রামকৃষ্ণ মিশনের সেবায় আত্মনিয়োগ করেন। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি ব্যক্তিগত জীবনের গোপনীয়তা বজায় রাখেন। তিনি কখনও কোনো জনসমাগমে অংশ নেননি। জনসম্মুখে আসতে হবে বলে ২০০৫ সালে ভারতের রাষ্ট্রীয় সম্মাননা দাদা সাহেব ফালকে পুরস্কার প্রত্যাখ্যান করেন।

মৃত্যুর অন্ধকার জগতে চিরতরে প্রস্থান করলেও মহানায়িকা সুচিত্রা সেন দর্শকদের মনে চিরসবুজ, চিরতরুণ, রোমান্টিক নায়িকারূপে বেঁচে থাকবেন চিরকাল।