গাংনীর বামন্দীতে জঙ্গি আস্তানা সন্দেহে পুলিশের শ^াসরুদ্ধকর অভিযান : আটক তিনজনের জঙ্গি সম্পৃক্ততা পায়নি পুলিশ

গাংনী প্রতিনিধি: মেহেরপুর গাংনী উপজেলার বামন্দীতে জঙ্গি আস্তানা সন্দেহে একটি বাড়িতে শ^াসরুদ্ধকর অভিযান চালিয়েছে পুলিশ। গতকাল শনিবার সকাল থেকে সৌদি প্রবাসী মিশকাত আলীর দোতলা বাড়িটি ঘিরে রাখার পর দুপুর ১২টার দিকে অভিযান শেষ হয়। ভাড়াটিয়া দুই নারী ও বাড়ি মালিকের ছেলেকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য থানা হেফাজতে নেয়া হয়। তবে তাদের জঙ্গি সম্পৃক্ততার তথ্য পায়নি পুলিশ।
সকাল সাড়ে ১০টা থেকে বামন্দীর আখ সেন্টারপাড়ার সৌদি আরব প্রবাসী মিশকাত আলীর দোতলা বাড়িটি ঘিরে রাখে মেহেরপুর জেলা পুলিশের একাধিক দল। পুলিশের দুই শতাধিক সদস্য সাজোয়া হয়ে বাড়ির আশেপাশে অবস্থান নেয়। তাদের হাতে ছিলো ভারী অস্ত্রসস্ত্র। মেহেরপুর পুলিশ সুপার আনিছুর রহমান, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আব্দুল্লাহ আল মাহমুদ ও গাংনী থানার ওসি আনোয়ার হোসেনসহ পুলিশ কর্মকর্তার ঘটনাস্থলে গিয়ে অভিযানের সিদ্ধান্ত নেন। বাড়িটি ঘিরে রাখার পর থেকে বামন্দী ছিনেমা হল সংলগ্ন সড়ক দিয়ে পথচারী চলাচল বন্ধ করে দেয়া হয়। আশেপাশের লোকজনকে নিরাপদে থাকতে বলা হয়। তবে জঙ্গি আস্তানার খবর পেয়ে হাজারো উৎসুক মানুষের ভিড় পড়ে। তাদের সামলাতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন পুলিশের বেশ কয়েকজন সদস্য। উৎসুক মানুষদের ছিনেমা হলের সামনের প্রধান সড়কে আটকে দেয় পুলিশ। ঘটনাস্থলের আশেপাশের অলিগলি, বাড়ির ছাদসহ সুবিধাজনক স্থানে অবস্থান নেয় সাজোয়া পুলিশ সদস্যবৃন্দ।
জঙ্গি আস্তানার খবর দেশের বিভিন্ন বেসরকারি টেলিভিশন লাইভ সম্প্রচার করে। এতে এলাকাবাসীর পাশাপাশি সারাদেশের মানুষের দৃষ্টি পড়ে বামন্দীর দিকে। পুলিশ সুপারের নির্দেশনার আলোকে প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নিয়ে অভিযান শুরু হয়। তবে অভিযান শুরুর কয়েক মিনিট আগে ভেতরের বাসিন্দাদের বেরিয়ে আসতে হ্যান্ড মাইকে আহ্বান জানায় পুলিশ। কিন্তু তেমন সাড়া না মেলায় ওই বাড়িতে অভিযান শুরু হয়। শ^াসরুদ্ধকর অভিযানে আটক দুই নারীকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য পুলিশ হেফাজতে নেয়া হয়। তবে কোনো অস্ত্র কিংবা বিস্ফোরক দ্রব্য পাওয়া যায়নি। এর আগে গতকাল ভোরে বাড়ি মালিকের ছেলে হাসিবুল হাসানকে জিজ্ঞাসাদের জন্য আটক করেছিলো পুলিশ।
স্থানীয় ও পুলিশসূত্রে জানা গেছে, বামন্দীর পশ্চিমপাড়ার সৌদি প্রবাসী মিশকাত আলী কয়েক মাস আগে বাড়িটি নির্মাণ শেষ করেন। ৬ মাস ধরে ভাড়াটিয়া উঠেছেন। নিচতলায় ৩ চাকরীজীবী পরিবার বসবাস করেন। দোতলায় স্বামীসহ বসবাস করতেন দুই নারী।
নিচতলার বাসিন্দারা জানান, ১৫-১৬ দিন আগে তারা ভাড়ায় আসেন। দুই নারীর সাথে দুই শিশু সন্তান ছিলেন। তাদের স্বামীরা কখন আসতেন বা বাইরে যেতেন বুঝতে পারতেন না নিচতলার বাসিন্দারা। দিনের বেশিরভাগ সময় ঘরের ভেতর থেকে দরজা বন্ধ করা থাকতো। নিচতলায় টিউবউয়েলের পানি নিতেন না। ছাদের ট্রাঙ্কের পানি ব্যবহার করতেন। কাপড়-চোপড় নাড়ার জন্যও তারা ছাদে যেতেন না। বোরকা পরে অতিশয় পর্দ্দার সাথে তারা বাইরে বের হতেন। তাদের চলাফেরা ও বসবাস সন্দেহজনক ছিলো।
অভিযান শেষে মেহেরপুর পুলিশ সুপার সাংবাদিকদের বলেন, তারা ওই বাড়ির নিচতলা ও আশেপাশের বাসিন্দাদের সাথে মেলামেশা করতেন না। খুব একটা বাড়ি থেকে বেরও হতেন না। তাদের চলাফেরা সন্দেহজনক। গোপন সংবাদের ভিত্তিতে অভিযান চালানো হয়। তাদের সাথে জঙ্গি সম্পৃক্ততা রয়েছে কি-না তা খতিয়ে দেখতে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।
এদিকে দিনভর বিভিন্নভাবে তাদের বিরুদ্ধে তদন্ত করে পুলিশ। পুলিশের তদন্তে জঙ্গি সম্পৃক্ততার কোনো তথ্য না পাওয়ায় গতরাত সাড়ে ১০টার দিকে তাদেরকে পরিবারের হেফাজতে ছেড়ে দেয়া হয়। চলাফেরা ও সামাজিকতার বিষয়ে সতর্ক থাকাসহ অন্যান্য বিষয়েও তাল মিলিয়ে চলবেন বলে মুচলেকা দিয়েছেন তারা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ভবানীপুর গ্রামের বাসিন্দা ও বামন্দী বাজারের গার্মেন্টস ব্যবসায়ী আব্বাস উদ্দীন। তার শ^শুর কুষ্টিয়ার দৌলতপুর উপজেলার কিশোরীনগরের বরকত আলী সৌদি প্রবাসী। সম্প্রতি বরকত আলী ছুটিতে দেশে ফিরে আসেন। তবে ভাইদের সাথে তার বিরোধ থাকায় বামন্দী বাসা ভাড়া নিয়ে বসবাস শুরু করেন। বরকত আলী ও তার স্ত্রী এবং এক শিশু কন্যাকে নিয়ে কয়েকদিন আগে ওই বাসায় উঠেছিলেন। মায়ের বাসায় বেড়াতে গিয়েছিলেন আব্বাস আলীর স্ত্রী। কিন্তু মা-মেয়ে দুজনেই অতিশয় পর্দ্দাশীল ছিলেন। আব্বাস আলীও কিছুটা নীরব প্রকৃতির। প্রয়োজন ছাড়া কারো সাথে কথা বলতেন না। তেমন কারো সাথে মেলামেশাও ছিলো না।
গাংনী থানাসূত্রে জানা গেছে, জঙ্গি আস্তানা সন্দেহের খবর পেয়ে গত ৩ দিন ধরে পুলিশ বিভিন্নভাবে পর্যবেক্ষণ করছিলো। বামন্দী বাজারের ব্যবসায়ী আব্বাস আলী ওই বাসা ভাড়া নিয়ে তার শ^শুর-শাশুড়িকে বসবাসের সুযোগ দিলেও স্থানীয়রা তা কেউ জানতেন না। পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে বাড়ি মালিকের ছেলেও ভাড়াটিয়াদের সম্পর্কে নির্দিষ্ট তথ্য দিতে পারেননি। কাকে ভাড়া দিয়েছেন এবং ভাড়াটিয়াদের প্রয়োজনীয় তথ্য না থাকায় পুলিশের সন্দেহ আরও বেড়ে যায়। দেশের কয়েকটি স্থানে জঙ্গিবিরোধী অভিযানের আগে পুলিশের যে বিষয়গুলো সন্দেহ ছিলো তার সবই ছিলো বামন্দীর ওই বাড়িটি ঘিরে। ভেতরের বাসিন্দাদের পরিচয় স্থানীয়দের না জানা এবং তাদের চলাফেরায় প্রতিবেশীদের ব্যাপক কৌতুহল ও সন্দেহ সৃষ্টি হয়। যার ফলে জঙ্গি আস্তানা বলেই ধরে নেয় আশেপাশের লোকজন।
এদিকে মা-মেয়েকে থানা হেফাজতে নেয়ার পর আব্বাস ও তার শ^শুর বরকত আলী পুলিশের আহ্বানে সাড়া দিয়ে থানায় হাজির হন। তাদেরকে পৃথকভাবে জিজ্ঞাসাব করা হয়।
আব্বাস আলী বলেন, শ^শুরের বাড়ির ঝামেলার কারণে আমাদের কাছাকাছি বাসা ভাড়া করে দিই। কিন্তু আশেপাশের লোকজনের কাউকে বলা হয়নি। আমার ও শ^শুরের পরিবারের নারীরা পর্দ্দাশীল। তবে আশেপাশের লোকজনের সাথে কথা বলতেন না কেন সে প্রশ্নের সদুত্তোর দিতে পারেননি তিনি।
আব্বাসের শ^শুর বরকত আলী বলেন, সৌদি আরবে থাকার সময় আমার স্ত্রী তার পিতার বাড়িতে থাকতেন। আমার ভাইদের সাথে আমার ভালো সম্পর্ক ছিলো না। তাই তিন মাসের ছুটিতে আসলেও বাড়িতে উঠতে পারিনি। বড় মেয়ের বাড়ি যেহেতু ভবানীপুরে তাই তাদের কাছাকাছি বাসা ভাড়া নেই। ছুটি শেষে সৌদি আরবে যাওয়া পর্যন্ত এখানে বসবাস করবো। আমি সৌদি ফিরে গেলে স্ত্রী ও ছোট মেয়ে আমার শ^শুর বাড়িতে চলে যাবেন।
গাংনী থানা ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আনোয়ার হোসেন বলেন, দুই নারী ও বাড়ি মালিকের ছেলেকে পুলিশ হেফাজতে নেয়ার পর থেকেই তদন্তে নামে পুলিশ। স্থানীয়ভাবে খোঁজ নিয়ে তাদের বিষয়ে কোনো অভিযোগ পাওয়া যায়নি। তবে আব্বাস আলী কারো সাথে তেমন মেলামেশা করতেন না বিধায় তার বিষয়ে এলাকাবাসীর যথেষ্ট সন্দেহ তৈরি হয়। তবে তার শ^শুর বরকত আলীর এলাকায় খোঁজ নিয়ে তাদের দেয়া বয়ানের সাথে মিল পাওয়া গেছে। তাদের বিরুদ্ধেও কোনো অভিযোগ নেই। প্রয়োজনীয় তদন্ত করা হয়েছে। তবে তাদের বিরুদ্ধ জঙ্গি সম্পৃক্ততার কোন তথ্য পাওয়া যায়নি। তাই পরিবারের সদস্যদের জিম্মায় মুক্তি দেয়া হয়েছে।