খালেদা জিয়ার প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আহ্বান : সারাদেশে লেলিয়ে দেয়া সন্ত্রাসী বাহিনীকে সামলান

স্টাফ রিপোর্টার: প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়ার নির্দেশে ও মদদে তার লেলিয়ে দেয়া সন্ত্রাসী বাহিনী নির্বাচন-পূর্ব ও পরবর্তী সময়ে সারাদেশে আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মী, মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের সদস্যবৃন্দ ও সাধারণ নিরীহ মানুষ হত্যা, নির্যাতনসহ বিভিন্ন সহিংস হামলার ঘটনা ঘটিয়েছে। কারো হাত, কারো পায়ের রগ কেটে ফেলা হয়েছে। বুকে কুপিয়ে জখম করা হয়েছে। বর্বর এ তাণ্ডব থেকে নারীরাও রেহাই পায়নি। তাদের এ নির্মম, ভয়ানক নৃশংসতা একাত্তরের বর্বরতাকেও হার মানিয়েছে। একাত্তরের গণহত্যার কায়দায় তারা মানুষ হত্যা ও নির্যাতন চালাচ্ছে। সারাদেশে লেলিয়ে দেয়া সন্ত্রাসী বাহিনী সামলানোর জন্য তিনি খালেদা জিয়ার প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেন, উনার সন্ত্রাসী বাহিনীকে উনারই সামলাতে হবে। অন্যথায় তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে।

গতকাল বুধবার সকালে রাজধানীর জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানে নির্বাচনের আগে ও পরবর্তী সহিংসতায় আহতদের পরিদর্শন শেষে সাংবাদিকদের তিনি এ কথা বলেন। সম্প্রতি দেশের বিভিন্ন স্থানে জামায়াত-শিবিরের হামলার শিকার ৯ জন এ হাসপাতালে চিকিত্সাধীন। প্রধানমন্ত্রীকে কাছে পেয়ে গুরুতর আহত এ ৯ রোগী কান্নায় ভেঙে পড়েন, জানান তাদের আকুতি ও অভিযোগ, তুলে ধরেন নিজেদের আবেদনও। প্রধানমন্ত্রীর কাছে তাদের এ পরিণতির জন্য দায়ীদের বিচার দাবি করেন ভুক্তভোগীরা। এ সময় প্রধানমন্ত্রী দোষীদের অবশ্যই গ্রেফতার করে বিচারের কাঠগড়ায় তোলা হবে বলে আশ্বস্ত করে বলেন, বিএনপি-জামায়াত-শিবির যে এতো বর্বরতা চালিয়েছে তা চোখে না দেখলে বিশ্বাস হবে না। নিষ্ঠুর বর্বরতার শিকারদের আর্তনাদ দেখে প্রধানমন্ত্রীও চোখের পানি ধরে রাখতে পারেননি। প্রধানমন্ত্রী আহতদের খোঁজ-খবর নেন এবং তাদের সুচিকিত্সা নিশ্চিত করতে সংশ্লিষ্টদের নির্দেশ দেন।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, খালেদা জিয়া সন্ত্রাসীদের পক্ষ নিয়ে যতোই মায়া কান্না করুক কোনো লাভ হবে না। অবশ্যই সহিংসতাকারীদের ও তাদের হুকুমদাতাদের গ্রেফতার করে বিচারের আওতায় আনা হবে। বিচারের হাত থেকে কেউই রেহাই পাবে না। তিনি বলেন, কারো জীবনযাত্রায় বাধা দেয়ার অধিকার কারো নেই। সকলেরই শান্তিপূর্ণভাবে জীবনযাপন করার অধিকার আছে। সে অধিকার রক্ষায় যা যা পদক্ষেপ নেয়ার আমরা নেবো। প্রধানমন্ত্রী চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ উপজেলার মোবারকপুর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) সদস্য ও আওয়ামী লীগের কর্মী নূরজাহান বেগম সম্পর্কে বলতে গিয়ে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন। তিনি বলেন, সন্ত্রাসীরা তার হাত-পায়ের রগ ও স্তন কেটে দিয়েছে। আমি জানি না, তারা কোনো মায়ের সন্তান কি-না? তারা কোনো মায়ের কোলে বড় হয়েছে কি-না? কোনো মায়ের সন্তান হলে তারা কিভাবে মায়ের জাতির ওপর এভাবে হামলা করতে পারে! তবে এজন্য খালেদা জিয়াকেও দায়ী হতে হবে। চাঁপাইনবাবগঞ্জের এক বিএনপি নেতার নির্দেশেই এ হামলা হয়েছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, তাদের কি আমরা ছেড়ে দেব? সবার বিচার করা হবে। তিনি বলেন, জামায়াত-শিবিরের সহিংস কর্মকাণ্ডের শিকার হয়ে যারা ঘর-বাড়ি ছেড়ে পালিয়েছিলো তাদের নিরাপদে ফিরে আসার পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিএনপি-জামায়াতের আন্দোলন কেবল মানুষ খুন করা। নিরীহ মানুষ হত্যা করা বিএনপি নেত্রীর খুবই পছন্দ। উনি অনুসরণ করেন রাজাকার আর যুদ্ধাপরাধীদের। তারাই তার লোক। ১৯৭১ সালে যেভাবে গণহত্যা হয়েছে, ঠিক একই কায়দায় তারা এসব হামলা চালাচ্ছে। গাড়িতে আগুন, হত্যা, রগকাটা এখন তাদের সাধারণ ব্যাপার হয়ে গেছে। প্রশাসন নিষ্ক্রিয় কি-না সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, প্রশাসন নিষ্ক্রিয় নয়। তারা আচমকা এসব হামলা করছে। কোনো ঘটনা ঘটলেই আমরা দ্রুত ব্যবস্থা নিচ্ছি। বিভিন্ন সময়ে যারা আহত হয়েছে, তাদের পুনর্বাসন করা হয়েছে এবং হবে। তিনি বলেন, হামলার শিকার ব্যক্তিরা যাতে নিরাপদে বাড়ি ফিরতে পারেন, সে ব্যবস্থা নেয়া হবে। এমপি, দলীয় নেতা-কর্মী ও প্রশাসন তাদের সাথে থাকবে। ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত বিএনপির ২৯ হাজার নেতা-কর্মী গ্রেফতার হয়েছে মর্মে বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়ার দেয়া বক্তব্যের সমালোচনা করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, উনার নেতা-কর্মীরা কী ঘটনা ঘটাচ্ছে তা কী উনি দেখতে পাচ্ছেন? উনি যে তালিকা পড়লেন, যাদের চিহ্নিত করলেন তারা সবাই তো সন্ত্রাসী। উনার দলের লোক যদি সন্ত্রাসী হয় তার বিরুদ্ধে আমরা অবশ্যই ব্যবস্থা নেব। তিনি বলেন, সন্ত্রাসীদের নির্দোষ বানানোর চেষ্টা করে উনি ভুল করছেন। তিনি সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের পৃষ্ঠপোষকতা করছেন।

গতকাল সকাল ১০টা ২৭ মিনিটে হাসপাতালে পৌঁছেই প্রধানমন্ত্রী কানসাটের আওয়ামী লীগ নেত্রী ও শিবগঞ্জের মোবারকপুর ইউনিয়ন পরিষদের নারী সদস্য নূরজাহান বেগমকে দেখতে যান। প্রধানমন্ত্রীকে কাছে পেয়েই নূরজাহান বেগম বলেন, আমার কি অপরাধ? জামায়াত-শিবির ক্যাডারদের বর্বরতার শিকারের বর্ণনা দিতে গিয়ে নূরজাহান বলেন, কানসাটে গোলাম রাব্বানীর বাসায় বৈঠক শেষে নিজ বাসায় ফেরার পথে যাত্রীবাহী বাস থেকে নামিয়ে ১৪/১৫ জন শিবির ক্যাডার তার ওপর পৈশাচিক হামলা চালায়। নূরজাহান বলেন, দলের কাছে কোনো সাহায্য-সহযোগিতা চাই না। আওয়ামী লীগের কর্মী হিসেবে আমার কোনো চাওয়া নেই। শুধু একটাই চাওয়া, যেন ন্যায়বিচার পাই। এ সময় প্রধানমন্ত্রী ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বলেন, এভাবে একজন ভদ্র মহিলাকে তারা মারলো!

এরপর প্রধানমন্ত্রী গাজীপুরের শ্রীপুরের নূরজাহান বেগমকে দেখতে যান। মুক্তিযোদ্ধার স্ত্রী নূরজাহান ও তার তিন মেয়ের ওপর ১৬ জানুয়ারি দুপুরে জামায়াত-শিবির কর্মীরা হামলা চালায়। ষাটোর্ধ্ব নূরজাহান বেগমের মাথার পেছনে চাপাতি দিয়ে আঘাত করা হয় এবং ভেঙে দেয়া হয় ডান হাঁটু। নূরজাহানের সন্তান শামসুন নাহার শাহীন ১৬ জানুয়ারি শিবিরের বর্বরতার চিত্র তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রীকে বলেন, ওরা জামায়াত-শিবিরের। ওরা বিএনপি করে। ওরা আমার দু পায়ের রগ ও ডান হাত ভেঙে দিয়েছে। আমি এর বিচার চাই। কানন জাহান রবিন বলেন, ১৬ জানুয়ারি দুপুর ১টার দিকে দেলোয়ার, আরফান ও মনার নেতৃত্বে ১০/১২ বিএনপি-জামায়াতের নেতা-কর্মী আমাদের বাড়িতে আক্রমণ করে। আমাদের পরিবার এ নিয়ে তিন বার জামায়াত-শিবিরের হামলার শিকার হয়েছে। দোষীদের বিচারের পাশাপাশি আর যাতে কোনো হামলা না হয় সেজন্য সরকারের কাছে নিশ্চয়তার দাবি জানিয়ে তিনি বলেন, মুক্তিযোদ্ধার সন্তান হওয়াটা কী অপরাধ?

মোজাম্মেল হক হামলার ঘটনার বিবরণ তুলে ধরে বলেন, ২৯ ডিসেম্বর কানসাট সংলগ্ন নতুন ব্রিজের সামনে পৌঁছালে প্রায় ১শ জামায়াত-শিবির ক্যাডার আমাদের ওপর সশস্ত্র হামলা করে। শেরপুর জেলার টোড়াগর ১ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগ সভাপতি বিল্লাল হোসেন বলেন, ৫ জানুয়ারি নির্বাচনের দিন সকাল ৬টার দিকে মোটরসাইকেল নিয়ে শেরপুরের পোড়াগর ১ নম্বর ওয়ার্ড ভোটকেন্দ্রে রওনা দিই। ভোটকেন্দ্রের কাছাকাছি পৌঁছালে হঠাত করে সশস্ত্র ১৫ জন জামায়াত-শিবির ক্যাডার আমার ওপর হামলা করে। কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়ে তারা এলোপাতাড়ি কোপাতে থাকে। একপর্যায়ে চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে তারা আমার দু পা ও হাতের রগ কেটে ফেলে।

শিবির ক্যাডারদের বর্বর হামলার বর্ণনা দিতে গিয়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের দফতর সম্পাদক জালাল আহমেদ বলেন, গত ১১ ডিসেম্বর বিকেলে সিলেটের বাসা থেকে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়ার পথে নাইওরপুল পয়েন্টে শিবির ক্যাডাররা বাহন সিএনজি দাঁড় করিয়ে একজন আমার শার্টের কলার চেপে ধরে, আরেকজন হাতুড়ি দিয়ে মাথার ওপর কয়েকটি আঘাত করে। পরে সিএনজি থেকে নামিয়ে চাপাতি দিয়ে উপর্যুপরি আঘাত করে। একপর্যায়ে দৌঁড়ে পালানোরও চেষ্টা করি। কিন্তু পেছন থেকে আমাকে ওরা ধরে ফেলে। তারপর চারজনে ধরে আমাকে মাটিতে শুইয়ে দিয়ে দুই হাত ও পায়ের রগ কেটে ফেলে।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক শরিফুল ইসলাম সাদ্দাম তার ওপর হামলার বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেন, গত ৮ অক্টোবর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গেটসংলগ্ন বিনোদপুর বাজার এলাকায় শিবিরের বর্বর হামলার শিকার হন তিনিসহ আরো দুজন। হঠাত করে ২০/২৫ জন শিবির ক্যাডার মুখোশ পরে তাদের ওপর হামলা করে। একজন পালিয়ে যায়। আরেকজনের দু পায়ে গুলি করে। আমার বাম হাত ও ডান পায়ের রগ কেটে দেয় তারা।

প্রধানমন্ত্রীর পরিদর্শনকালে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম, স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, আওয়ামী লীগের যুগ্মসাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর কবির নানক প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।