ক্লিনিক ব্যবসায়ী নজরুলকে তাড়িয়ে ধরে গুলি ও কুপিয়ে খুন ॥ প্রতিবাদে ভাঙচুর-আগুন

 

 

আলমডাঙ্গার তিয়রবিলার দোলাখালী মাঠে প্রকাশ্য দিবালোকে দুর্বৃত্তদের নৃশংসতা

 

আলমডাঙ্গা ব্যুরো/সরোজগঞ্জ সংবাদদাতা: চুয়াডাঙ্গায় ক্লিনিক ব্যবসায়ী নজরুল ইসলামকে গুলি ও গলা কেটে খুন করা হয়েছে। তাকে দিনদুপুরে তাড়িয়ে ধরে খুন করে সন্ত্রাসীরা। গতকাল সোমবার বেলা ২টার দিকে আলমডাঙ্গার পল্লি তিয়রবিলা গ্রামে এ খুনের ঘটনা ঘটে। বছর বিশেক আগে তার পিতা সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান লুৎফর রহমানকেও সন্ত্রাসীরা কুপিয়ে খুন করেছিলো। এ হত্যাকাণ্ডের জের ধরে বিক্ষুব্ধরা প্রতিপক্ষ ১২ জনের বাড়ি ও ৩ জনের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে ভাঙচুর ও অগ্নি সংযোগ করেছে। পুলিশের প্রচেষ্টায় রাতে গ্রামের পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এলেও গ্রামজুড়ে বিরাজ করছিলো আতঙ্ক ও উত্তেজনা।

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, তিয়রবিলা গ্রামের নজরুল ইসলাম (৪০) মোটরসাইকেল যোগে হরিণাকুণ্ডু থেকে নিজ গ্রামে ফিরছিলেন। হরিণাকুণ্ডু-তিয়রবিলা সড়কের দোলাখালী মাঠে চলন্ত মোটরসাইকেলে গুলি করে সন্ত্রাসীরা। নজরুল ইসলাম মোটরসাইকেল থেকে পড়ে গেলে টেনেহেঁচড়ে পার্শ্ববর্তী একটি পাট ক্ষেতে নিয়ে তাকে গলা কেটে খুন করা হয়। তিয়রবিলা গ্রামের কৃষক ডালিম জানান, নজরুলকে এলোপাতাড়ি কোপানো হয়েছে। এছাড়া তার কানের কাছে গুলি করার চিহ্ন রয়েছে। তিয়রবিলা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শহিদুল ইসলাম জানান, নজরুল ইসলাম ক্লিনিক ব্যবসায়ী। চুয়াডাঙ্গার সরোজগঞ্জ বাজার ও ঝিনাইদহের হরিণাকুণ্ডু বাজারে তার ক্লিনিক রয়েছে। তিনি আরও জানান, নিহত নজরুল ইসলামের পিতা তিয়রবিলা গ্রামের লুৎফর রহমান ছিলেন খাসকররা ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান। তাকেও ১৯৯৮ সালে স্থানীয় ভাটুই নদীর ধারে প্রকাশ্যে দিবালো কুপিয়ে খুন করেছিলো সন্ত্রাসীরা।

এলাকাবাসী ও পুলিশসূত্রে জানা গেছে, তিয়রবিলা গ্রামের সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান মৃত লুৎফর রহমানের বড় ছেলে নজরুল ইসলাম ক্লিনিক ব্যবসায়ী। পার্শ্ববর্তী ঝিনাইদহের হরিণাকুণ্ডু উপজেলা শহরে আনোয়ারা ক্লিনিক নামে তার নিজের ক্লিনিকের ব্যবসা রয়েছে। গতকাল সোমবার দুপুর ২টার দিকে ক্লিনিক থেকে তিনি মোটরসাইকেলযোগে নিজ গ্রামের লোকমান হোসেনের ছেলের বিয়ে খেতে যাচ্ছিলেন। পথিমধ্যে হরিণাকুণ্ডু-আলমডাঙ্গা ২ উপজেলার সীমান্তবর্তী দোলাখালী মাঠে পৌঁছুলে পূর্ব থেকে ওত পেতে থাকা দুর্বৃত্তরা তাকে লক্ষ্য করে গুলি ছোড়ে। নজরুল মোটরসাইকলে থেকে পড়ে যান। এ সময় তিনি দুর্বৃত্তদের হাত থেকে রক্ষা পেতে দৌঁড়ে প্রাণ বাঁচানোর চেষ্টা করেন। কিন্তু সন্ত্রাসীরা তাকে ধাওয়া করে একটি পাটক্ষেতে নিয়ে এলোপাতাড়ি কুপিয়ে ও গলা কেটে খুন করে। প্রত্যক্ষদর্শী কয়েকজন জানান, নিহত নজরুলের মাথায় দুটি গুলির চিহ্ন রয়েছে।

এদিকে, এ নৃসংশ হত্যাকাণ্ডের সংবাদ শুনে তিয়রবিলা ফাঁড়ি পুলিশ ঘটনাস্থলে ছুটে যায়। সংবাদ পেয়ে আলমডাঙ্গা থানার অফিসার ইনচার্জ শেখ আতিয়ার রহমান, ওসি (তদন্ত) মেহেদী রাসেল ও সেকেন্ড অফিসার মোস্তাফিজুর রহমান সঙ্গীয় ফোর্সসহ ঘটনাস্থলে ছুটে যান।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক এলাকাবাসী ও ঘটনাস্থলে উপস্থিত লোকজন জানিয়েছেন, এ হত্যাকাণ্ডের পর নিহতের আত্মীয়-পরিজনসহ বিক্ষুব্ধরা ক্ষোভে-আক্রোশে ফেটে পড়েন। তারা গ্রামজুড়ে তাণ্ডব শুরু করেন। প্রতিশোধ নিতে বেপরোয়া হয়ে ওঠেন তারা। দেশীয় অস্ত্র নিয়ে গ্রামে নেমে পড়েন। প্রতিপক্ষের বাড়িতে বাড়িতে ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে অগ্নি সংযোগ শুরু করেন।

আলমডাঙ্গা থানার সেকেন্ড অফিসার এসআই মোস্তাফিজুর রহমান জানিয়েছেন,  গ্রামের ১২ জনের বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে সবকিছু ভস্মীভূত করে।  প্রতিপক্ষ  মৃত বেলু চৌধুরীর ছেলে লাটিম মাস্টার, লাটিমের চাচাতো ভাই আব্দুল মান্নান চৌধুরী, আবুল হোসেন চৌধুরীর ছেলে আজিজুর রহমান চৌধুরী, আলী হোসেন, আব্দুল্লাহ, সাইনুদ্দীনের ছেলে মোমিন, কনেজ ও তার ছেলে  সেলিম, সাগর ও জামাল এবং পার্শ্ববর্তী হাকিমপুর গ্রামের আনোয়ার ডাক্তারের বাড়ি ভাঙচুর ও অগ্নি সংযোগ করে ভস্মীভূত করা হয়েছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক প্রত্যক্ষদর্শী জানিয়েছেন, আব্দুল মান্নান চৌধুরীর দোতলা বাড়ির শুধু ইটগুলো সাজানো রয়েছে। ঘরের সমস্ত আসবাবপত্র, তৈজষপত্র, কাপড়-চোপড়সহ সমস্ত মালামাল পুড়ে ভস্মীভূত হয়েছে। পুড়ে গেছে ঘরের সমস্ত জানালা-দরজা। মোমিনের বাড়ির সমস্ত ঘর আসবাবপত্রসহ পুড়ে ছাই হয়েছে গেছে। সেলিমের ঘর, গোয়ালঘর ও বিচুলির পালাসহ সবকিছু ভস্মীভূত হয়েছে। বিভিন্ন ব্যক্তির ৬টি মোটরসাইকেল ভাঙচুর করা হয়েছে। এ সকল পরিবার এখন রাস্তায় খোলা আকাশের নিচে মানবেতরভাবে অবস্থান করছেন। এ সকল পরিবারের মহিলাদের অনেককেই শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করা হয়েছে বলে অভিযোগ করা হয়েছে। নির্যাতিত পরিবারের অনেক মহিলা অসুস্থ বলে গ্রামবাসীরা জানিয়েছেন। এ সকল পরিবার এখন পুরুষশূন্য। তিয়রবিলা বাজারে অবস্থিত ৩টি দোকানও ভস্মীভূত হয়েছে। আব্দুল মান্নান চৌধুরীর পাটের গোডাউন, আজিজুর রহমান চৌধুরীর কাপড়ের দোকান ও ইয়ারুল আলীর মুদি দোকান পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে।

আলমডাঙ্গা ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের স্টেশন মাস্টার মোখলেছুর রহমান জানিয়েছেন, অগ্নিসংযোগের ঘটনায় প্রায় ২ কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মোহাম্মদ বেলায়েত হোসেন ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন।

আলমডাঙ্গা থানার অফিসার ইনচার্জ শেখ আতিয়ার রহমান বলেন, তাৎক্ষণিকভাবে এ হত্যাকাণ্ডের কারণ সম্পর্কে নিশ্চিতভাবে কিছু বলা যাচ্ছে না। তবে পূর্বশত্রুতা ও ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন নিয়ে বিরোধের জেরে নজরুলকে হত্যা করা হতে পারে বলে তিনি ধারণা করছেন।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক গ্রামবাসীসূত্রে জানা যায়, খাসকররা ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে নিহত নজরুল নৌকার সমর্থক মোস্তাফিজুর রহমান রুন্নুর পক্ষে প্রচারণা চালিয়েছেন। নির্বাচনে রুন্নু জয়লাভ করেন। এ কারণে তার প্রতিপক্ষরা নাখোশ ছিলেন। একারণেই তাকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হতে পারে বলে তাদের ধারণা।

আবার গ্রামের অনেকের জানান, গত প্রায় ২০ বছর আগে নজরুল ইসলামের বাবা সাবেক ইউপি চেয়ারমান লুৎফর রহমানকেও একইভাবে হত্যা করে সন্ত্রাসীরা। চেয়ারম্যান লুৎফর রহমান হত্যা মামলায় ১৭ বছর সাজা খেটে তিয়রবিলা গ্রামের ঝড়ু মণ্ডলের ছেলে এক সময়ের স্থানীয় বাহিনীর প্রধান ওল্টু জেল থেকে বের হয়েছেন। জেলমুক্ত ওল্টু স্বতন্ত্র চেয়ারম্যান প্রার্থী লালের পক্ষে প্রচারণা চালিয়েছেন। একারণেই নজরুলের সাথে তার পূর্বশত্রুতার বিষয়টি আরও জমকালো হয়ে উঠে। এই শত্রুতার কারণে এই ক্লিনিক মালিক নজরুলকে হত্যা করা হতে পারে বলেও গ্রামের অনেকের ধারণা।

নিহত ক্লিনিক মালিক নজরুল ইসলাম তিয়রবিলা গ্রামের সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান মৃত লুতফর রহমানের ৩ ছেলে ও ৩ মেয়ের মধ্যে সকলের বড়। তিনি বিবাহিত। ২ পুত্র সন্তানের জনক। বড় ছেলে তোহিদুল ইসলাম ৪র্থ শ্রেণির ছাত্র। ছোট ছেলের বয়স মাত্র ২/৩ মাস। প্রায় ৮ মাস আগে তিনি ১৫ বছর আগে দায়েরকৃত একটি অপহরণ মামলায় আত্মসমর্পণ করেন। এরপর সে মামলায় জেল থেকে প্রায় ২ মাস আগে মুক্ত হয়ে বাড়ি ফেরেন। ইউপি নির্বাচনে নৌকার পক্ষে কাজ করেন।

পুলিশ জানিয়েছে, রাতেই নিহত নজরুলের লাশ ময়নাতদন্তের জন্য রাতেই চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালমর্গে পাঠানো হয়েছে। তিয়রবিলা গ্রামে গতরাতেও পুলিশি টহল অব্যাহত ছিলো। পুলিশের তৎপরতায় আপাতত গ্রামের পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে থাকলেও গ্রামজুড়ে এখনও অজানা আতঙ্ক বিরাজ করছে। গ্রামের পরিবেশ থমথমে। বাড়ি ছেড়ে রাতে পুলিশের আশ্রয়ে থাকা তিয়রবিলা গ্রামের ইউনুস আলীর ছেলে মানোয়ার জানিয়েছেন, পুলিশ চলে গেলে আবারো তাদের পরিবারে সহিংসতা নেমে আসতে পারে। সেই আতঙ্কে তারা বাড়ি না ফিরে পুলিশের আশ্রয়ে রয়েছেন। শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত নিহতের মেজ ভাই আক্তারুজ্জামান আলমডাঙ্গা থানায় হত্যা  মামলার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন বলে পুলিশ জানায়।