কেরুজ চিনিকলের ২০১৩-১৪ আখ মাড়াই মরসুমের যাত্রা শুরু

৩৫ কোটির টাকার অবিক্রিত চিনি ও ২৬ কোটি টাকা লোকসানের বোঝা মাথায়

 

হারুন রাজু/হানিফ মণ্ড: মিলের লোকসান কমাতে অনেকটাই শাদামাটা পরিবেশে কেরুজ চিনিকলের ২০১৩-১৪ আখ মাড়াই মরসুমের যাত্রা শুরু করা হলো। এ যাত্রা শুরুকালে যেমনি ছিলেন না সরকারের কোনো মন্ত্রী, সচিব তেমনি ছিলেন না করপোরেশনের কেউ। লাভের আশায় এবারো মাড়াই শুরু করলেও লোকসানের সম্ভাবনা বেশি। গত ৩ মরসুমের ৩৫ কোটি টাকার অবিক্রিত চিনি ও গত মরসুমের ২৬ কোটি টাকা লোকসানের বোঝা মাথায় নিয়ে সংক্ষিপ্ত আলোচনাসভা ও দোয়া মাহফিলের মধ্যদিয়েই কেরুজ চিনিকলের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করা হয়েছে। কেরুজ চিনিকলের ২০১৩-১৪ আখমাড়াই মরসুম উদ্বোধনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্যশিল্প করপোরেশনের বেধে দেয়া দিন ছিলো গতকাল শুক্রবার। গতকাল বিকেল ৩টার দিকে কেরুজ চিনিকল কর্তৃপক্ষ মিলের কেইন কেরিয়ার চত্বরে আয়োজন করেন উদ্বোধনী সভা। মিলের নবাগত ব্যবস্থাপনা পরিচালক কৃষিবিদ মো. আজিজুর রহমানের সভাপতিত্বে প্রধান অতিথি ছিলেন দামুড়হুদা উপজেলা চেয়ারম্যান বীর মুক্তিযোদ্ধা আজাদুল ইসলাম আজাদ। বিশেষ অতিথি ছিলেন চুয়াডাঙ্গা অতিরিক্ত পুলিশ সুপার সালেহ উদ্দিন, দর্শনা পৌর মেয়র মহিদুল ইসলাম, কেরুজ শ্রমিক-কর্মচারী ইউনিয়নের সভাপতি জয়নাল আবেদীন, সাধারণ সম্পাদক মনিরুল ইসলাম প্রিন্স, দামুড়হুদা থানার অফিসার ইনচার্জ আহসান হাবীব, চিনিকলের মহাব্যবস্থাপক (কারখানা) ইউসুফ আলী শিকদার, মহাব্যবস্থাপক (ডিস্টিলারি) সুরেশ চন্দ্র ভট্টাচার্য, মহাব্যবস্থাপক (কৃষি) মোস্তফা কামাল ও মহাব্যবস্থাপক (অর্থ) মোশারফ হোসেন। মহাব্যবস্থাপক (প্রশাসন) আব্দুল কাইয়ুমের উপস্থাপনায় উপস্থিত ছিলেন কৃষি অফিসার আলাউদ্দিন, আখচাষি কল্যাণ সংস্থার সভাপতি আব্দুল হান্নান, আখচাষি নেতা সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান শামসুল হক, আব্দুল বারী, হাজি আকমত আলী, আয়ুব আলী রাজু, ডিস্টিলারি সেলস অফিসার শেখ মো. শাহাব উদ্দিন, ওয়ার্কার্স পার্টি নেতা সৈয়দ মজনুর রহমান, শ্রমিক নেতা তৈয়ব আলী, হাবিবুর রহমান হবি, ফিরোজ আহম্মেদ সবুজ, এএসএম কবির, আ.লীগ নেতা এরশাদ মাস্টার, জাতীয় পার্টি নেতা নুর জামাল প্রমুখ। আলোচনা শেষে সর্বোচ্চ আখচাষের জন্য চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলার বেগমপুর ইউনিয়নের শৈলমারী গ্রামের বিশারত আলী মোল্লাকে পুরস্কার দেয়া হয় এবং সবোর্চ্চ ফলনের জন্য পুরস্কার দেয়া হয়েছে চুয়াডাঙ্গা সাবজোনের মোড়ডাঙ্গা গ্রামের নাজিম উদ্দিনকে। দোয়া পরিচালনা করেন কেরুজ জামে মসজিদের পেশ ইমাম মাও. আব্দুল খালেক। দোয়া শেষে মিলের ডোঙায় আখ নিক্ষেপের মধ্যদিয়ে ২০১৩-১৪ আখ মাড়াইয়ের যাত্রা শুরু করা হয়েছে। ২৯ নভেম্বর মিল চালু করার লক্ষ্যে গত ২৩ অক্টোবর কেরুজ চিনিকল কর্তৃপক্ষ বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্যশিল্প করপোরেশনের কাছে চিঠি দেয়। করপোরেশন কর্তৃপক্ষ তা সংশোধন করে মিল চালুর নির্ধারিত দিনক্ষণ ঠিক করে দেয় ৬ ডিসেম্বর। এ মরসুমে কেরুজ চিনিকল কর্তৃপক্ষকে ১ লাখ ১০ হাজার মেট্রিক টন আখ মাড়াইয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে দেয় করপোরেশনের কর্তৃপক্ষ। সে হিসেব অনুযায়ী এ মরসুমে ৯০ মাড়াই দিবসে কেরুজ চিনিকলে ৮ হাজার ২৫০ মেট্রিক টন চিনি উৎপাদন করতে হবে। চিনি আহরণের গড় হার নির্ধারণ করা হয়েছে ৭ দশমিক ৫০। তবে কেরুজ চিনিকল কর্তৃপক্ষের হিসাবমতে কৃষক ও চিনিকলের নিজস্ব ৯ হাজার ৫১০ একর জমিতে আখ রয়েছে। এর মধ্যে চিনিকলের নিজস্ব জমির পরিমাণ ১ হাজার ১৮২ একর। এতে বীজআখ বাদে মিলে আখমাড়াই করা হতে পারে ৯৭ হাজার মেট্রিক টন। যা ৯০ দিবসে কোনো প্রকার যান্ত্রিক ত্রুটি দেখা না দিলে আখমাড়াই করে চিনি উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রার খুব কষ্টে ধারে-কাছে পৌঁছানো যেতে পারে। ৭৫ বছর বয়সী এ মিলের লাগাতার যান্ত্রিক ত্রুটির কারণেই নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রায় পৌঁছুতে হিমশিম খেতে হয় মিল কর্তৃপক্ষকে। বয়সের ভারে নুয়েপরা কেরুজ চিনিকলটি এ মরসুমেও মোটা অঙ্কের লোকসান গুনতে পারে বলেই সংশ্লিষ্টদের মধ্যে অনেকেরই ধারণা।

এদিকে গত মাড়াই মরসুমে এ মিলের চিনি কারখানা থেকে লোকসান গুনেছে প্রায় ২৬ কোটি টাকা। তবে এ লোকসান পুশিয়ে দিয়েছে মিলের ডিস্টিলারির মদ বিক্রির টাকায়। সরকারকে প্রচুর টাকা রাজস্ব দিয়েও ওই বিভাগ প্রায় ৫০ কোটি টাকা মুনাফা অর্জন করে। পরপর তিন মাড়াই মরসুমের উৎপাদিত চিনি এখনো অবিক্রিত রয়েছে। মিলের ৫টি গোডাউনে এখনো অবিক্রিত চিনির পরিমাণ ৬ হাজার ৯শ ১৫ দশমিক ০৫ মেট্রিকটন। যার বর্তমান বাজারমূল্য ৩৪ কোটি ৫৭ লাখ ৫২ হাজার ৫শ টাকা। মিলের ৫টি গোডাউন চিনিতে কানায় কানায় ভর্তি থাকায় বিকল্প ব্যবস্থা গ্রহণ করতে শুরু করেছে মিলকর্তৃপক্ষ। এছাড়া অতিরিক্ত একটি গোডাউন নির্মাণের জন্য মিলকর্তৃপক্ষ লিখিত প্রস্তাব করেছে করপোরেশন বরাবর। তবে এ প্রস্তাব কার্যকর হবে কি-না তা অনিশ্চিত। আর হলেও তা কবে নাগাদ হবে তা কেউ বলতে পারেনি।

এ মরসুমের উৎপাদিত চিনি রাখার জন্য মিলকর্তৃপক্ষ বিকল্প ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। সে হিসেবে চিনি রাখার গোডাউন নির্ধারণ করা হয়েছে বেশ কয়েকটি স্থান। স্থানগুলোর মধ্যে রয়েছে কেরুজ চিনিকলের বন্ধ হয়ে থাকা ওষুধ গোডাউন, পরিবহন বিভাগের ইঞ্জিন গোডাউন, সিজিনাল ব্র্যাকের ১৩টি কক্ষ, প্রাইমারি স্কুলের ৭টি কক্ষ, অফিসার্স ও সাধারণ ক্লাব, আবাসিক এলাকার খালি পড়ে থাকা কয়েকটি ভবনসহ বিভিন্ন স্থানে। সেজন্য মিল কর্তৃপক্ষকে অতিরিক্ত খরচবহন করতে হবে। যা মিলের জন্য কাটা ঘায়ে নুনের ছিটের মতো অবস্থায় পরিণত হবে। চিনিকলের নবাগত ব্যবস্থাপনা পরিচালক কুষিবিদ মো. আজিজুর রহমান এ মরসুমে মিলটির চিনি উৎপাদনের ক্ষেত্রে লাভজনক অবস্থায় পৌঁছে নেয়ার জন্য সব ধরনের প্রস্তুতি গ্রহণ করেছেন বলে জানিয়েছেন তিনি।