এক বছরে একই বিদ্যালয়ের ২৯ ছাত্রী বাল্যবিয়ের শিকার : তালাক ১০

সহযোগিতায় ইউপি মেম্বার মাতবর কাজি ও নামধারী নেতা : নির্বিকার প্রশাসন
আলম আশরাফ: হরদম বাল্যবিয়ে হচ্ছে আলমডাঙ্গায়। অবাধে বিয়ের কারণে আইন ও প্রশাসনকে কেউই তোয়াক্কা করছে না। বাল্যবিয়ে আইনত দণ্ডনীয় হলেও প্রশাসনের পক্ষ থেকে তেমন কোনো ব্যবস্থা না নেয়ায় তা বন্ধ হচ্ছে না। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বাল্যবিয়ের শিকার হচ্ছে স্কুলের ছাত্রীরা। তাদের ইচ্ছের বিরুদ্ধেই বিয়ে দিয়ে শ্বশুর বাড়িতে পাঠানো হচ্ছে। ফলে সমাজে বাল্যবিয়ের শিকার অনেকেই আত্মহত্যার পথ বেছে নিচ্ছে। কেউ কেউ হচ্ছে তালাকের শিকার। অনেকেই শিকার হচ্ছে একাধিক বিয়ের।
আলমডাঙ্গা উপজেলার জেহালা ইউনিয়নের মুন্সিগঞ্জ পশুহাট এলাকার সৃজনী মডেল মাধ্যমিক বিদ্যাপীঠে গতকাল বৃহস্পতিবার সরেজমিনে যান এই প্রতিবেদক। সেখানে গিয়ে বাল্যবিয়ের যা তথ্য পাওয়া গেছে তা হতবাক করবে সচেতন মহলকে। গত এক বছরে এই বিদ্যালয়ের ২৯ ছাত্রী বাল্যবিয়ের শিকার হয়েছে। তালাকপ্রাপ্ত হয়েছে ১০ জন। আর পাঁচ ছাত্রী গিয়েছে দ্বিতীয় স্বামীর ঘরে।
সৃজনী মডেল মাধ্যমিক বিদ্যাপীঠ থেকে এবার জেএসসি পাস করেছে শাবনুর খাতুন। দরিদ্র দিনমজুরের মেয়ে শাবনুরের ইচ্ছে ছিলো লেখাপড়া শিখে বড় হবে। সে দামুড়হুদা উপজেলার বিষ্ণুপুর গ্রামের রিজাল আলী মণ্ডল ও পারভীনা খাতুনের মেয়ে। শাবনুর দু বছর বয়স থেকে নানির কাছে থাকে। তার নানাবাড়ি আলমডাঙ্গার খাদিমপুর ইউনিয়নের পারকৃষ্ণপুর গ্রামে। নানা মারা যাওয়ার পর নানির অপার স্নেহে বেড়ে উঠছিলো সে। জেএসসি পরীক্ষার পর ডিসেম্বরের শেষে পিতার বাড়িতে বেড়াতে গিয়েছিলো শাবনুর। কিন্তু এই বেড়ানোই শাবনুরের জন্য অভিশাপ হয়ে দেখা দিলো। গত বৃহস্পতিবার রাত ১২টায় গোপনে জোরপূর্বক শাবনুরকে বিয়ে দিয়ে দেয় পিতা পক্ষের লোকজন। নানি ভানু গতকাল বৃহস্পতিবার স্কুলে এসে কেঁদে কেঁদে বললেন, ওর খুব ইচ্ছে ছিলো লেখা পড়া শিখে মানুষের মতো মানুষ হবে। বিয়ের কথা শুনতেই চাইতো না সে। কিন্তু জোরপূর্বক বিয়ে দেয়া হলো তাকে। তার কি সংসার করার মতো বয়স হয়েছে?
একই স্কুলের একই ক্লাসের ছাত্রী শিলা খাতুনের আজ নাকি বিয়ে। আলমডাঙ্গার খাদিমপুর ইউনিয়নের রংপুর গ্রামের সিদ্দিকুর রহমান ও আলিয়া খাতুনের মেয়ে শিলা খাতুনের বিয়ের দিনক্ষণ ঠিক হয়েছে সপ্তাহখানেক আগেই। বাল্যবিয়ে আইনত দণ্ডনীয় হলেও বেশ ঘটা করেই এ বিয়ের আয়োজন করা হয়েছে। বিদ্যালয়ের ছাত্রীরা জানায়, শিলার ইচ্ছে ছিলো অন্তত এসএসসি পাস করবে সে। কিন্তু পরিবারের লোকজন আর সমাজপতিরা তার সে স্বপ্ন পূরণ হতে দিলো না।
বাল্যবিয়ের শিকার স্কুলছাত্রীদের সহপাঠীরা জানায়, গত এক বছরে সৃজনী মডেল স্কুলের ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্রী যমুনা খাতুন, সাহেদা খাতুন বাল্যবিয়ের শিকার হয়েছে। সপ্তম শ্রেণির আয়েশা খাতুন, টুম্পা খাতুন, আন্নু খাতুন, পপি খাতুন, কল্পনা খাতুন, শাপলা খাতুন, সাদিয়া খাতুন, বৃষ্টি রানী ও তৃণা খাতুন, অষ্টম শ্রেণির সাথী খাতুন, মালা খাতুন, শাবনুর খাতুন, শারমিন খাতুন, মুন্নি খাতুন, বন্যা খাতুন, জেসমিন খাতুন, আঁখি খাতুন, বিথী খাতুন, ফাতেমা খাতুন, বন্যা খাতুন, মরিয়ম খাতুন, অনামিকা পারভীন ও রিতু খাতুন অভিশপ্ত বাল্যবিয়ের শিকার হয়েছে। এ ছাড়া নবম শ্রেণির উর্মি খাতুন ও শাহানাজ পারভীন রেহাই পায়নি বাল্যবিয়ে থেকে।
এই স্কুলের বাল্যবিয়ের শিকার ছাত্রীদের মধ্যে শাহানাজ, সাথী, শারমিন, বন্যা, জেসমিন, তৃণা, মালা, আঁখি, টুম্পা ও সোনিয়া খাতুন তালাকপ্রাপ্ত হয়েছে। এ ছাড়া দ্বিতীয় স্বামীর ঘরে গেছে আরো পাঁচ ছাত্রী। এরা হলো শাহানাজ, সাথী, বন্যা, তৃণা ও মালা খাতুন। এই ভয়াবহ চিত্র শুধু সৃজনী মডেল হাইস্কুলেরই নয়, আশপাশ সব স্কুলেরই একই দশা। পার্শ্ববর্তী মুন্সিগঞ্জ একাডেমীর প্রধান শিক্ষক আতিয়ার রহমান ও মুন্সিগঞ্জ মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শঙ্কর কুমার পাত্র জানালেন, বাল্যবিয়ের কারণে অনেক মেধাবী মুখ স্কুল থেকে ঝরে যাচ্ছে। প্রশাসনের কাছে অভিযোগ করেও তেমন লাভ হয় না। পরবর্তীতে গোপনে বিয়ে হয়ে যায়।
জেহালা ইউনিয়নের কাজি আনোয়ার হোসেন এই প্রতিবেদককে জানান, তিনি গত ৪ বছর ধরে কাজি হিসেবে কাজ করছেন। এই চার বছরে তিনি ৩০৪ খানা বিয়ে পড়িয়েছেন। আর এর মধ্যে নিজ হাতে তালাক লিখেছেন ১১২টি।
সূত্র জানায়, এলাকার মেম্বারদের সহযোগিতায় কনে পক্ষ চেয়ারম্যানের কাছ থেকে নিবন্ধনে বয়স বাড়িয়ে স্কুল ছাত্রীদের বিয়ের পিঁড়িতে বসাচ্ছে। কাজিরা মেয়ের চেহারা ও বয়স না দেখেই বিয়ে পড়াচ্ছেন জন্ম সনদ দেখে। জন্মসনদ হাতে পেলেই তারা যেন দায়মুক্ত। অনেক ক্ষেত্রে জন্মসনদ না পেলে তারা মূল ভলিউমে বিয়ে নিবন্ধন করেন না। তারা কৌশলে একটা ফরমে কনে ও বরের তথ্য লিখে রেখে দেন। জানতে চাইলে বিয়ে পড়াননি বলে এড়িয়ে যান। তাছাড়া গ্রামের এক শ্রেণির মাতবর ও নামধারী নেতা বাল্যবিয়েতে সরাসরি সহযোগিতা করে থাকেন বলে অভিযোগ করলেন সৃজনী মডেল মাধ্যমিক বিদ্যাপীঠের প্রধান শিক্ষক আহাদ আলী মোল্লা। তিনি অভিযোগ করে বলেন, অনেক ক্ষেত্রে অভিভাবককে বাল্যবিয়ে দিতে বারণ করলে তারা ক্ষুব্ধ হন। প্রশাসনকে জানিয়ে কোনো লাভ হয় না। পরে ঠিকই বিয়ে হয়ে যায়। আর প্রশাসনের পক্ষ থেকে বাল্যবিয়ের সাথে সংশ্লিষ্টদের শাস্তি না দেয়ার কারণে বাল্যবিয়ে বন্ধ হচ্ছে না।