একমাত্র ছেলে আলিমের একটা হিল্লে হলেই ছেড়ে দেবো এ পেশা

৩০ বছর যাবত দেশীয় ফল বিক্রি করে সংসার চালানো নফরকান্দির ভূমিহীন রতন বললেন

 

ইসলাম রকিব: ৩০ বছর ধরে দেশীয় মরসুমি ফল বিক্রি করে সংসার চালিয়ে আসছেন চুয়াডাঙ্গা জেলা সদরের ডিঙ্গেদহের নফরকান্দি গ্রামের রতন আলী। কখনো তালশাঁস, কখনো ডাব, কখনো বা নারিকেল, লিচু, কাঁঠাল, পেয়ারা, তরমুজ বিক্রি করে ভূমিহীন কৃষক রতন আলী চালাচ্ছেন অভাবের সংসার। ২ মেয়েকে পাত্রস্থ করার পাশাপাশি একমাত্র ছেলে আ. আলিমকে এসএসসি পাস করিয়েছেন। চলতি ২০১৫ সালে ডিঙ্গেদহ সোহরাওয়ার্দী স্মরণী বিদ্যাপীঠের ভোকেশনাল থেকে এসএসসি পরীক্ষায় কৃতিত্বের সাথে পাস করেছে ছেলে আ. আলিম। গতকাল রোববার দুপুর ১২টার দিকে ডিঙ্গেদহ বাজারে তালশাঁস বিক্রি করছিলেন রতন। প্রচণ্ড রোদ আর ভ্যাপসা গরমে একটু পরিত্রাণ পাওয়ার আশায় পথচারী ও বাজারের অনেক ব্যবসায়ী ভিড় জমিয়ে রতনের তালশাঁস কিনছিলেন। একজন পরিচিত ব্যবসায়ী এ প্রতিবেদককে দেখে চিনে ফেলে বললেন, রতন ভাই সাংবাদিক ভাইকে একটু আগে তালশাঁস দিয়ে ছেড়ে দিন। সাংবাদিক পরিচয় পেয়ে রতন উপস্থিত সবার নিকট ক্ষমা চেয়ে বললেন, ভাই আমি সাংবাদিক ভাইকে কয়টি শাঁস দিয়ে আপনাদের দেবো, উনি ব্যস্ত মানুষ তো! বিরতিহীন অটোমেশিনের মতো তালের দু পাশে দু কোপ দিয়ে কখনো ৩টি, কখনো বা ২টি করে শাঁস বের করছেন। ৪/৫ মিনিটেই ৫ হালি তালশাঁস বিনানো হয়ে গেলো। রতন বললেন, ভাই এগুলো সবার আগে আমি আপনার খাতিরে তৈরি করে দিলাম। দাম নিতে না চাইলেও এক প্রকার জোর করেই তালশাঁসের দাম দেয়া হলে রতন বললেন, সাংবাদিক ভাই, আপনি পাশের এই আনারুলের হোটেলে একটু বসেন খদ্দের মিটিয়ে আপনার সাথে একটু কথা বলবো। রতনের আকুতি আর মেশিনের মতো দ্রুত কথা আর কাজ দেখে না বসে আর পারা গেলো না। ২০ মিনেটের মধ্যেই তালশাঁসের সিংহভাগ শেষ হয়ে গেলো। খদ্দের পাতলা হয়ে গেলে রতন চলে এলেন এ প্রতিবেদকের নিকট। রতন কোমরের গামছা ঝেড়ে মুখ মুছে বলতে থাকলেন, ভাই ১৯৮৫ সাল থেকে আমি দেশীয় ফল বিক্রি করে আসছি। ২ বোন ২ ভাইয়ের মধ্যে আমি ছোট ছিলাম। অভাবের সংসারে বিয়ের ২ বছরের মাথায় ফল বেচার কাজ শুরু করি। সেই যে শুরু, কষ্ট হলেও এ কাজ ছাড়তে পারি না। কষ্ট হলেও কম সময়ে আয়-রোজগার হয় বেশি। তাই এ কাজই বেশি সহজ মনে হয়। দু বেলা কষ্ট করতে পারলে ৭/৮ শ টাকা প্রতিদিন আয় করা সম্ভব হয়। এ কাজের আয় দিয়ে বসবাস করার মতো ৪ কাঠা জমি কিনেছি। দু মেয়েকে ভালো ঘরে পাত্রস্থ করেছি। আর একমাত্র ছেলে আ. আলিমকে এসএসসি (ভোকেশনাল) পাস করিয়েছি। আর কতোদিন এ কাজ করবেন? এ পশ্নের জবাবে রতন বলেন, বয়স হয়েছে, মন-শরীর আর সাড়া দিতে চায় না। তারপরও সংসার চালাতে কাজ করার কোনো বিকল্প নেই। তবে ছেলেটার একটা হিল্লে ( চাকরি-বাকরি) হলেই এ কাজ ছেড়ে দেবো। কারণ আমার সময় তো শেষের পথে। ছেলের ভবিষ্যত গড়া পর্যন্ত আমাকে কাজ করতে হবে। এ কথা শেষে আবারো রতন আলী তার আপন পেশায় নিয়োজিত হয়ে গেলেন। পলকহীন দৃষ্টিতে তার চলে যাওয়া আর নিবিষ্ট মনে দা দিয়ে তালশাঁস কাটা দেখে অন্তরের কোণে ভেসে ওঠে গ্রামবাংলার কতো মানুষই কতো রকম পেশার মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করে থাকে। এর নামই কী সমাজ, সংসার আর পরিবার-পরিজনের মায়ার জালে জড়িয়ে তিলে তিলে নিজেকে শেষ করা।