ইবি বন্ধে ব্যবসায়ীদের মাথায় হাত : পেশা বদলাচ্ছেন অনেকে

সাইফুল ইসলাম রাজ: বাসচাপায় এক ছাত্র নিহতের জের ধরে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে দীর্ঘদিন বন্ধ থাকার পর ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় (ইবি) খুলে আবার বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বিপাকে পড়েছেন ক্যাম্পাসের ব্যবসায়ী ও বিভিন্ন পেশাজীবীরা। বেচাকেনা নেমে এসেছে শূন্যের কোটায়। অনেকে বাধ্য হয়ে জীবিকার তাগিদে নিজ পেশা ছেড়ে অন্য পেশার দিকে ঝুঁকছেন। ব্যবসা থেকে আয় যথেষ্ট না হওয়ায় সংসারের ব্যয় নির্বাহ করতে ঋণ নিতে বাধ্য হচ্ছেন অনেকে। সম্প্রতি ক্যাম্পাসের বিভিন্ন ব্যবসায়ী ও পেশাজীবীর সাথে কথা বলে এ চিত্র ফুটে উঠেছে। দীর্ঘ ৩৭ দিন বন্ধ থেকে গত ৮ জানুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয় খুলে দেয় কর্তৃপক্ষ। পরদিনই অনিবার্য কারণ দেখিয়ে ফের বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ করে দেয়া হয়। এরপর থেকে বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ রয়েছে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটকের দক্ষিণ দিকের যাত্রী ছাউনির পাশে একটি স্টেশনারি দোকানের মালিক শামসুল হক। তিনি মোবাইলের কার্ড বিক্রির পাশাপাশি চা-পাউরুটি বেচা-কেনাও করেন। শামসুল হক ৫ বছর ধরে এখানে বেচা-কেনা করছেন। তিনি জানান, যেদিন ছাত্র নিহতের জের ধরে বাসে আগুন দেয়া হয়েছিলো ওই দিন আমার নগদ ক্যাশ ছিলো তিন হাজার টাকা। এরপর বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ হয়ে যায়। গত দেড় মাসে দোকানে বিক্রি একদম কমে গেছে। নগদ ক্যাশও শেষ হয়ে গেছে। বাধ্য হয়ে আরও দু হাজার টাকা ঋণ নিয়েছি। এখন আমার মূলধন বলতে এই দোকানের পণ্য সামগ্রীগুলো। প্রধান ফটকের সামনে খুলনা-কুষ্টিয়া মহাসড়কের পাশে আরও চারটি স্টেশনারি দোকান রয়েছে।

সপ্তডিঙ্গা জেনারেল স্টোর নামে একটি দোকানের দোকানদার রফিকুল ইসলাম জানান, ক্যাম্পাস খোলা থাকলে তার প্রতিদিন বেচাকেনা হয় পাঁচ থেকে ছয় হাজার টাকা। কিন্তু ক্যাম্পাস বন্ধ থাকায় বেচাকেনা কমে গেছে। এখন দিনে চার থেকে পাঁচশ টাকার বেশি বেচাকেনা হয় না। স্বদেশ ফটোস্ট্যান্ডের আসাদুজ্জমান বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় খোলা থাকলে আমার যা আয় হয় তা দিয়ে সংসার ভালোভাবেই চলে যায়। কিন্তু এখন চরম লোকসান হচ্ছে।

জানা গেছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটকের সামনে ২০টির মতো ফটোকপির দোকান রয়েছে। এছাড়া কম্পিউটারের দোকান রয়েছে তিনটি। এসব দোকানের কয়েকজন মালিকের সাথে কথা হলে তারাও একই কথা জানান। বেচাকেনা না থাকায় ইতোমধ্যে কয়েকটি দোকান বন্ধও হয়ে গেছে। সুন্দরবন কুরিয়ার সার্ভিসের ইবি শাখার প্রতিনিধি শামসুল আলম কবির বলেন, ক্যাম্পাস চলাকালে দিনে ৫০-৬০টি চিঠিপত্র-ডকুমেন্ট এই শাখা থেকে আদান-প্রদান হয়। এমনকি কয়েকটি পার্সেলও পাঠানো হয়। এতে করে দিনে প্রায় দেড় থেকে দু হাজার টাকার মতো লেনদেন হয়। এখন কোনো কোনো দিন একশো টাকা লেনদেন হতেও অনেক কষ্ট হয়ে যায়।

একই অবস্থা ক্যাম্পাসের আভ্যন্তরীণ ব্যবসায়ীদের। বিশ্ববিদ্যালয়ের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলের ডাইনিং ম্যানেজার বশির মিয়া বলেন, প্রায় দেড়মাস ধরে হলের ডাইনিং বন্ধ রয়েছে। অথচ খোলা থাকলে দিনে কম করে হলেও দশ থেকে বারো হাজার টাকার বেচাকেনা হতো। ক্যাম্পাসে ভ্যান চালাচ্ছিলেন শুকুর আলী। তার সাথে কথা হলে তিনি বলেন, আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাফেটেরিয়ায় তরকারি বণ্টনের কাজ করি। এ থেকে আমার দিনে কয়েকশ টাকা আয় হতো। বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ থাকায় এখন ক্যাফেরিয়াও বন্ধ রয়েছে। তাই অনেকটা বাধ্য হয়ে ভ্যান চালাচ্ছি। শুকুর আলীর মতো ঝাল-মুড়ি বিক্রেতা সজিবও এখন ভ্যানচালক। ফ্ল্যাক্সিলোড দোকানদার সাগর আহমেদ এখন ভাড়ায় মোটরসাইকেল চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করেন। ক্যাম্পাসের পার্শ্ববর্তী শেখপাড়া বাজারের সবজি বিক্রেতা হাসিবুল বলেন, ক্যাম্পাস বন্ধের পরে ৩২ হাজার টাকার মাল কিনেছিলাম। বেচাকেনা না থাকায় সেগুলো আজও বিক্রি করে শেষ করতে পারিনি।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ইবি এলাকার প্রায় দু’শ ব্যক্তি ক্যাম্পাসের অভ্যন্তরে ও বাইরে বিভিন্ন পেশার সাথে জড়িত। ক্যাম্পাস সচল থাকলে এসব ব্যক্তির জীবিকাও সচল থাকে। বর্তমানে ক্যাম্পাস বন্ধ থাকায় এসব দোকানদার-ব্যবসায়ীদের যে পরিমাণ আয় হচ্ছে তা দিয়ে ঘর ভাড়া ও বিদ্যুত বিল পরিশোধ করা সম্ভব হচ্ছে না। অনেক দোকানদার-ব্যবসায়ীর অধীনে কয়েকজন করে শ্রমিক কাজ করলেও বর্তমানে ব্যবসা মন্দা যাওয়ায় তাদেরকেও আর রাখছেন না দোকান মালিকরা। ইতোমধ্যে কয়েকজন দোকানদার তাদের দোকান বন্ধ করে দিয়েছেন। বিসমিল্লাহ ফটোস্ট্যান্ড অ্যান্ড কম্পিউটারের মালিক মনিরুল ইসলাম জানান, আগে যা আয় হতো তা দিয়ে মোটামুটি ডাল-ভাত খাবার ব্যবস্থা হতো। এখন ইনকামই হচ্ছে না। চিন্তায় আছি, সামনের মাসে দোকান ভাড়া ও বিদ্যুত বিল কীভাবে পরিশোধ করবো। পত্রিকার হকার মো. সাহেব আলী বলেন, ক্যাম্পাস বন্ধ থাকায় বর্তমানে অর্ধেক পত্রিকা সরবরাহ কমে গেছে। এতে করে প্রতিদিন দিনে কয়েকশ টাকা লোকসান গুনতে হচ্ছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে আমার কষ্টের সীমা থাকবে না।

এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ফলিত পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক ড. মাহবুবর রহমান বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রী তথা পার্শ্ববর্তী এলাকার যাদের দৈনন্দিন রুজি-রোজগার বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর নির্ভরশীল বর্তমান পরিস্থিতিতে সকলেই কর্মবিমুখ হয়ে পড়েছে। শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি তারাও অনেক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। মানবিক দিক বিবেচনা করে যতো দ্রুত সম্ভব বর্তমান পরিস্থিতির পরিত্রাণ হওয়া প্রয়োজন।