আলমডাঙ্গার তিয়রবিলা গ্রামের ক্লিনিক ব্যবসায়ী নিহত নজরুল ইসলামের দাফন সম্পন্ন

 

দায়িত্বে অবহেলায় ফাঁড়ি আইসি ক্লোজড : লাশ নিয়ে চুয়াডাঙ্গায় বিক্ষোভ

আলমডাঙ্গা ব্যুরো: আলমডাঙ্গার তিয়রবিলা গ্রামের ক্লিনিক ব্যবসায়ী নজরুলকে গুলি করে ও কুপিয়ে হত্যার ঘটনা ও বিক্ষুব্ধদের প্রতিপক্ষের বসতবাড়ি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান পুড়িয়ে দেয়ার ঘটনায় ৩টি পৃথক মামলা দায়ের করা হয়েছে। ঘটনার দিনগত রাতেই একদিকে নিহতের চাচাতো ভাই আবু তালেব, অন্যদিকে গতকাল অগ্নিকাণ্ডে ক্ষতিগ্রস্ত তিয়রবিলা গ্রামের আলী হোসেন, আব্দুল মান্নান চৌধুরী ও হাকিমপুরের আনোয়ার হোসেন আলমডাঙ্গা থানায় পৃথক ৩টি মামলা দায়ের করেন। দায়িত্ব পালনে অবহেলার অভিযোগে তিয়রবিলা ফাঁড়ি পুলিশের আইসি এসআই আব্দুল হাকিমকে ক্লোজড করা হয়েছে। নজরুল ইসলামের লাশ নিয়ে বিক্ষোভ করেছেন চুয়াডাঙ্গা জেলা ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। হাসপাতাল মর্গে নিহত নজরুলের লাশ দেখতে যান হুইপ সোলায়মান হক জোয়ার্দ্দার ছেলুন এমপি। তিনি তিয়রবিলায় নজরুলের জানাজা অনুষ্ঠানেও শরিক হন।

থানাসূত্রে জানা গেছে, আলমডাঙ্গা উপজেলার তিয়রবিলা গ্রামের ক্লিনিক ব্যবসায়ী নজরুলকে গত সোমবার দিনদুপুরে গুলি করে ও কুপিয়ে খুন করা হয়। ওই দিন রাতে আলমডাঙ্গা থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করা হয়েছে। নিহতের চাচাতো ভাই একই গ্রামের নূর বক্স মণ্ডলের ছেলে আবু তালেব বাদী হয়ে মামলাটি দায়ের করেন। মামরায় অজ্ঞাত ১০/১২ জনকে আসামি করা হয়েছে। এ ঘটনায় পুলিশ সন্দেহভাজন কাউকে গ্রেফতার করতে পারেনি।

অন্যদিকে, এ নৃশংস হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় বিক্ষুব্ধ হয়ে ইউপি নির্বাচনের প্রতিপক্ষের বেশ কয়েকটি বাড়িঘর ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান পুড়িয়ে ভস্মীভূত করা হয়েছে। ওই অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় গতকাল পৃথক ৩টি মামলা দায়ের করা হয়েছে। তিয়রবিলা গ্রামের মৃত আবুল হোসেন চৌধুরীর ছেলে আলী হোসেন, অপর ছেলে আব্দুল মান্নান চৌধুরী ও হাকিমপুরের আনোয়ার হোসেন ডাক্তার ওই পৃথক মামলা ৩টি দায়ের করেছেন। ২২ জনের নাম উল্লেখসহ অজ্ঞাত আরও ১৪/১৫ জনকে আসামি করা হয়েছে। দায়েরকৃত এজাহার ৩টিতে  উল্লেখ করা হয় যে, নজরুল ইসলামকে সন্ত্রাসীরা তাড়িয়ে ধরে গুলি করে ও কুপিয়ে হত্যা করে। তারই জের হিসেবে ইউপি চেয়ারম্যান মোস্তাফিজুর রহমান রুন্নু, তার ভাতিজা তুষার ও রুন্নুর ভাই ফিরোজ আহমেদ ও আবু তাহেরের ছেলে জাহাঙ্গীরের নেতৃত্বে ৩০/৩৫ জন আলী হোসেন, আব্দুল মান্নান ও আনোয়ার ডাক্তারসহ বিভিন্ন ব্যক্তিদের বাড়ির বসত ঘরে পেট্রোল ঢেলে অগ্নি সংযোগ করে। বাড়ির সর্বস্ব পুড়িয়ে ভস্মীভূত করা হয়েছে। বাড়ির মহিলাদের অকথ্য নির্যাতন করা হয়েছে।

ক্ষতিগ্রস্ত একাধিক ব্যক্তি জানিয়েছেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে মামলা দায়ের করার মতো অবস্থা না থাকায় এখনও তারা এজাহার দায়ের করেননি, কাল-পরশু মামলা করবেন। তাদের কথায় বোঝা যায় ২/১ দিনের মধ্যে আরও ৫/৭ টি মামলা হতে পারে। নৃশংস হত্যাকাণ্ডের চে’ মানুষের নিকট অধিক গুরুত্ব পাচ্ছে ঘরবাড়ি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে অগ্নি সংযোগের ঘটনা

নজরুল হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় গ্রামবাসীসহ সাধারণ মানুষ অবশ্যই ব্যথিত ও ক্ষুব্ধ। বাপের পর ছেলে নজরুলকেও একইভাবে নৃশংসভাবে হত্যার ঘটনায় মানুষ বেদনায় হতবাক ও মূহ্যমান। স্বজন-পরিজনের বুক ফাটা আহাজারিতে এলাকার বাতাস ভারি।

কিন্তু এ শোকাবহ ঘটনা ছাপিয়ে অধিক গুরুত্ব পাচ্ছে অগ্নি সংযোগের পৈশাচিকতা। গ্রামবাসীর অভিযোগ এক শ্রেণির মানুষ যারা হত্যাকাণ্ডের কথা শুনে ঘটনাস্থলে না গিয়ে পেট্রোল হাতে আগে ছুটে গিয়েছে ভোটের প্রতিপক্ষের বাড়িঘরে ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে অগ্নি সংযোগ করতে। অভিযোগকারীদের সবচে’ গুরুত্বপূর্ণ অভিযোগ হচ্ছে- নৃশংসভাবে হত্যাকাণ্ডের শিকার নজরুলের পরিবার কিংবা তার কোনো আত্মীয়রা এমন ন্যাক্কারজনক ঘটনা ঘটায়নি। ঘটিয়েছে  ইউপি চেয়ারম্যান রুন্নু, তার ভাই ও ভাস্তের নেতৃত্বে। তারা নজরুলের লাশের নিকট না গিয়ে পরিকল্পনা অনুযায়ী পেট্রোল হাতে ছুটেছেন প্রতিপক্ষের বাড়িঘর ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ভস্মীভূত করতে। উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো যাদের বিরুদ্ধে কখনও অপরাধ সংগঠনে কোনো অভিযোগ নেই, এমন ব্যক্তির বাড়িঘর ও প্রতিষ্ঠানেও আগুন লাগিয়ে ভস্মীভূত করা হয়েছে শুধুমাত্র ভোটের প্রতিপক্ষ হওয়ার অপরাধে। অথচ প্রধান সন্দেহভাজন ওল্টুর বাড়িঘরে অগ্নি সংযোগ করা হয়নি। ওল্টুর বাড়ি রয়েছে অক্ষত।

নজরুলের লাশ নিয়ে চুয়াডাঙ্গা শহরে ছাত্রলীগের মিছিল: গত পরশু সোমবার রাতে নিহত নজরুলের লাশ ময়নাতদন্তের জন্য চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতাল মর্গে পাঠানো হয়। দুপুরে ময়নাতদন্ত সম্পন্নের পর ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে নজরুলের লাশ নিয়ে চুয়াডাঙ্গা শহরে বিক্ষোভ মিছিল করা হয়। এ সময় মিছিল থেকে নজরুল ইসলামসহ যে কয়েকটি হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে তার জন্য পুলিশ প্রশাসনকে দায়ী করেন তারা। অবিলম্বে এসব অপরাধীকে গ্রেফতারের দাবি করা হয়। অন্যথায় পুলিশ সুপারসহ কর্মকর্তাদের অপসারণের দাবিতে চুয়াডাঙ্গায় আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেন ছাত্রলীগ নেতৃবৃন্দ।

জানাজায় হুইপের যোগদান: বিকেল সাড়ে ৩টায়  জানাজা শেষে নজরুলের লাশ গ্রামের গোরস্তানে দাফন করা হয়েছে। জানাজায় উপস্থিত ছিলেন জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি জাতীয় সংসদের হুইপ বীর মুক্তিযোদ্ধা সোলায়মান হক জোয়ার্দ্দার ছেলুন এমপি। এ সময় অন্যান্যের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন চুয়াডাঙ্গা পৌরসভার সাবেক মেয়র রিয়াজুল ইসলাম জোয়ার্দ্দার টোটন, আলমডাঙ্গা উপজেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি ইউপি চেয়ারম্যান আমিরুল ইসলাম মন্টু, জেলা আওয়ামী লীগ নেতা শহিদুল ইসলাম খান, সমীর কুমার দে প্রমুখ। এ সময় প্রশাসনের প্রতি দ্রুত নজরুল ইসলামের হত্যাকারীদের গ্রেফতারের নির্দেশ দেন হুইপ ছেলুন জোয়ার্দ্দার এমপি।

বাপ ও ছেলের একই পরিণতি: গত প্রায় ১৮ বছর আগে নজরুল ইসলামের বাবা সাবেক ইউপি চেয়ারমান লুৎফর রহমানকেও একইভাবে হত্যা করেছিলো সন্ত্রাসীরা। অভিযোগ রয়েছে পার্শ্ববর্তী হরিণাকুণ্ড উপজেলার ঠকপাড়া গ্রামের বাহিনী প্রধান হানেফের নেতৃত্বে ওল্টু, মোজামসহ কয়েকজন চেয়ারম্যান লুৎফর রহমানকে বাড়ি থেকে কৌশলে ডেকে নেন। পরে ভাটুই নদীর ধারে তাকে কুপিয়ে নৃশংসভাবে হত্যা করে। ওই হত্যা মামলায় ১৭ বছর সাজা খেটে তিয়রবিলা গ্রামের ঝড়ু মণ্ডলের ছেলে এক সময়ের স্থানীয় বাহিনীর প্রধান ওল্টু প্রায় ৮ মাস পূর্বে জেল থেকে বের হয়েছেন। জেলমুক্ত ওল্টু স্বতন্ত্র চেয়ারম্যান প্রার্থী লালের পক্ষে প্রচারণা চালিয়েছে। একারণেই নজরুলের সাথে তার পূর্বশত্রুতার বিষয়টি আরও জমকালো হয়ে ওঠে।

তিরবিলা ফাঁড়ি পুলিশের আইসি ক্লোজড: দায়িত্ব পালনে অবহেলার অভিযোগে তিয়রবিলা ফাঁড়ির আইসি আব্দুল হাকিমকে গত পরশু মঙ্গলবারই চুয়াডাঙ্গা পুলিশ লাইনে ক্লোজড করা হয়েছে। তার বিরুদ্ধে এলাকাবাসীর অভিযোগ- দুর্বৃত্তরা যখন প্রতিপক্ষের বাড়িতে বাড়িতে ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে অগ্নি সংযোগ করে, তখন তা প্রতিরোধ করতে তিনি আন্তরিকভাবে চেষ্টা করেননি। এমন পরিস্থিতিতে তিনি কঠোর ভূমিকা পালন করেননি। গতকাল তিনি ছাড়পত্র নিয়ে চুয়াডাঙ্গা পুলিশ লাইনে যোগ দিয়েছেন বলে আলমডাঙ্গা থানা পুলিশসূত্রে জানা গেছে। বর্তমানে তিয়রবিলা ফাঁড়ির আইসি হিসেবে যোগদান করেছেন আলমডাঙ্গা থানার সেকেন্ড অফিসার মোস্তাফিজুর রহমান।

পুলিশ সুপার রশীদুল হাসান গতকাল বেলা ১১ টার দিকে তিয়রবিলা গ্রামে যান। তিনি অগ্নিকাণ্ডে ভস্মীভূত সকল ঘরবাড়ি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন করেন। এ সময় ক্ষতিগ্রস্তদের দুরবস্থা দেখে তিনি মর্মাহত হয়েছেন। পরনের কাপড় ছাড়া এ সকল ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের আর কিছুই অবশিষ্ট নেই। অনেক পরিবারের মহিলারাও দুর্বৃত্তদের অত্যাচার থেকে রেহাই পাননি। নিরীহ মহিলাদেরকেও শারিরীকভাবে নির্যাতন করা হয়েছে। এ সকল বিষয় পুলিশ সুপারকে অবগত করানো হয়।

বর্তমানে গ্রামের অবস্থা: গতকালও তিয়রবিলা গ্রামের অবস্থা ছিলো থমথমে। খুন কিংবা অগ্নি সংযোগের বিষয়ে কেউ মুখ খুলতে রাজি না। সকলেই রয়েছেন অজানা আতঙ্ককে। গতকাল রাতেও পুলিশি টহল অব্যাহত ছিলো। পুলিশের তৎপরতায় আপাতত গ্রামের পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে থাকলেও গ্রামজুড়ে এখনও অজানা আতঙ্ক বিরাজ করছে।