আন্দোলনকারীরা অনমনীয় : আরো কঠোর অবস্থানে সরকার

অবরোধ : জয়পুরহাট ও কুলাউড়ায় উপড়ে ফেলেছে রেলের ফিসপ্লেট

 

স্টাফ রিপোর্টার: বিএনপির নেতৃত্বে ২০ দলীয় জোটের লাগাতার অবরোধ অব্যাহত রয়েছে। মোকাবেলায় আরও কঠোর অবস্থান নিয়েছে সরকার। অন্যদিকে বিএনপিও অনড় তাদের কর্মসূচি চালিয়ে যাওয়া নিয়ে। এরই মধ্যে সরকার আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে অগ্নিসংযোগ ও নাশকতায় জড়িত সন্ত্রাসীদের দেখামাত্র যেকোনো ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশ দিয়েছে। সমাবেশ করা নিয়েও দু পক্ষের মধ্যে বিরোধপূর্ণ অবস্থান তৈরি হয়েছে। ক্ষমতাসীন দল ১০ জানুয়ারির মহাসমাবেশ পিছিয়ে ১২ জানুয়ারি করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। অন্যদিকে বিএনপি জোট বিশ্ব ইজতেমার দ্বিতীয় পর্বে শেষ দিন, ১৮ জানুয়ারি সমাবেশ ডাকতে পারে। সংশ্লিষ্ট সূত্রের বরাত দিয়ে ঢাকার একাধীক সংবাদ মাধ্যম এ তথ্য জানিয়েছে।

গত কয়েকদিনের রাজনৈতিক সহিংসতায় সারা দেশে ৭ জন নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন দুই শতাধিক। গতকাল অবশ্য প্রাণহানির খবর পাওয়া যায়নি। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে সারা দেশে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা বেড়েছে। টানা তৃতীয় দিনের অবরোধে দূরপাল্লা বাদে যানবাহন চলাচল ও অফিস-আদালত খোলা থাকলেও মানুষের মনের শঙ্কা কাটছে না। গতকাল বৃহস্পতিবার প্রধানমন্ত্রীর পররাষ্ট্রবিষয়ক উপদেষ্টা ড. গওহর রিজভী, দুজন বিচারপতির বাড়িতে হামলা করেছে দুষ্কৃতকারীরা। হামলা হয়েছে রাজধানীর পাঁচ তারকা হোটেল প্যান-প্যাসিফিক সোনারগাঁওয়ে। অবরোধে চোরাগোপ্তা হামলা ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা বেড়েই চলেছে। অব্যাহত রয়েছে যানবাহনে অগ্নিসংযোগ। পেট্রোল বোমায় যাত্রীবাহী বাসে আগুন দেয়ার ঘটনায় আতঙ্ক বিরাজ করছে অফিসগামী কর্মজীবী সাধারণ মানুষের মধ্যে। রাতে এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে বোমা বিস্ফোরণ ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে। বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোট অনির্দিষ্টকাল অবরোধ কর্মসূচি অব্যাহত রাখার ঘোষণা দিয়েছে। অন্যদিকে আওয়ামী লীগ ঘোষণা দিয়েছে এ কর্মসূচি প্রতিহত করার। এ নিয়ে দুই দলের নেতাকর্মীদের রাজপথে মুখোমুখি অবস্থানের ফলে প্রতিনিয়ত চড়ছে উত্তেজনার পারদ। বিবৃতি-পাল্টা বিবৃতিতে দুই পক্ষেরই অনড় মনোভাব প্রকট হচ্ছে। সংকট নিরসনের কোনো লক্ষণই দেখা যাচ্ছে না। নতুন বছরের শুরু থেকে প্রচারমাধ্যমে প্রধান খবর হয়ে রয়েছে রাজনৈতিক সংঘাত-সহিংসতাই।

বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের ডাকা অবরোধের তৃতীয় দিন বৃহস্পতিবার দেশের বিভিন্ন স্থানে আগুন, ভাঙচুর, ককটেল বিস্ফোরণ, গুলি, ইটপাটকেল নিক্ষেপ ও ট্রেনে নাশকতার ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনায় ৭১ জন আহত হয়েছেন। এদিন সিলেট, যশোর ও নোয়াখালীতে সকাল-সন্ধ্যা এবং বরিশাল ও মানিকগঞ্জে আধাবেলা হরতাল পালিত হয়েছে। রাজধানীসহ সারা দেশে পিকেটাররা ২৬টি গাড়িতে আগুন ও ৯০টির বেশি গাড়ি ভাংচুর করেছে। পুলিশ অভিযান চালিয়ে বিএনপি-জামায়াতের শতাধিক নেতাকর্মীকে আটক করেছে। এছাড়া সারাদেশে আড়াই হাজারের বেশি নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। এদিকে চট্টগ্রাম, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও মানিকগঞ্জসহ কয়েকটি স্থানে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পাহারায় কিছু দূরপাল্লার গাড়ি চলাচল করেছে। মৌলভীবাজারের কুলাউড়া উপজেলায় সিলেট থেকে চট্টগ্রামগামী আন্তঃনগর উদয়ন এক্সপ্রেসের ইঞ্জিনসহ ৬টি বগি লাইনচ্যুত হয়েছে। বুধবার গভীর রাতে (আনুমানিক সাড়ে ৩টা) এ দুর্ঘটনায় কমপক্ষে ২৫ জন আহত হয়েছেন। দুর্ঘটনার কারণ অনুসন্ধানে রেলওয়ের বিভাগীয় পরিবহন কর্মকর্তা মো. নাজমুল ইসলামকে প্রধান করে ৪ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ একে অবরোধকারীদের নাশকতা বলে দাবি করছে। ভোর ৬টার দিকে জয়পুরহাট-জামালগঞ্জ রেললাইনের মধ্যবর্তী উড়ি-মাধপাড়া ব্রিজ এলাকায় ফিসপ্লেট খুলে প্রায় ৩৬ ফুট রেললাইন (একটি) তুলে ফেলে অবরোধকারীরা। ফলে জেলার সঙ্গে ঢাকা ও রাজশাহীসহ দেশের অন্যান্য স্থানের ট্রেন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। মেরামতের পর সকাল ১০টায় আবার ট্রেন চালু হয়। এর আগে ভোররাতে সদর উপজেলার জয়পুরহাট-বগুড়া মহাসড়কের হিচমী বাজারে একটি আলুবোঝাই ট্রাকে আগুন দেয় দুর্বৃত্তরা। পর্যাপ্ত নিরাপত্তার পরও চাঁপাইনবাবগঞ্জ-সোনামসজিদ সড়কের একাধিক স্থানে ট্রাকগুলোতে দফায় দফায় হামলা চালায় দুর্বৃত্তরা। অন্তত ২০টি ট্রাকে হামলার ঘটনা ঘটে। ট্রাক ভাংচুর ছাড়াও ককটেল ও পেট্রোলবোমা নিক্ষেপ করে দুর্বৃত্তরা। আগুন দেয়া হয় ২টি ট্রাকে। যশোর ঢিলেঢালাভাবে হরতাল ও অবরোধ পালিত হয়েছে। মাঠে ছিল না বিএনপি নেতাকর্মীরা। বুধবার রাত থেকে বৃহস্পতিবার দুপুর পর্যন্ত পুলিশ জেলায় অভিযান চালিয়ে বিএনপি-জামায়াতের ৭ নেতাকর্মীসহ ৪৪ জনকে আটক করেছে।

মানিকগঞ্জ সকালে দেশের দক্ষিণাঞ্চলের বিভিন্ন জেলা থেকে আসা যানবাহন ফেরি পার হয়ে পাটুরিয়া থেকে ঢাকার উদ্দেশে যাত্রা করে। এ সময় স্থানীয় পুলিশের টহল ভ্যানের সঙ্গে বিজিবির তিনটি গাড়ি পাহারায় থাকে। ফলে ২০/২৫টি কোচ সমসংখ্যক পণ্য বোঝাই ট্রাক নিরাপদে ঢাকার উদ্দেশে ছেড়ে যায়। ভোর চারটার দিকে শিবালয় উপজেলার পাটুরিয়া ফেরিঘাট এলাকায় একটি দূরপাল্লার পরিবহনসহ দুটি বাসে আগুন লাগে। সকাল থেকে অধিকাংশ দূরপাল্লার বাস চট্টগ্রাম ছেড়ে যায়নি। তবে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে পুলিশ পাহারায় সীমিতাকারে কিছু পণ্যবাহী ট্রাক ও রাতে যাত্রীবাহী বাস চলাচল করেছে। তবে দিনে চলাচল বন্ধ ছিল। দূরপাল্লার বাস চলাচল বন্ধ থাকায় অন্যান্য দিনের মতো যাত্রীদের ভিড় দেখা গেছে চট্টগ্রাম রেলস্টেশনে। অবরোধের কারণে দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে বিশ্ব ইজতেমা যাত্রীদেরও। সড়কপথে বাস চলাচল বন্ধ থাকার পাশাপাশি ট্রেনেও চাপ থাকায় আজ থেকে টঙ্গীর তুরাগ তীরে শুরু হওয়া ইজতেমায় চট্টগ্রামের অনেকেই যোগ দিতে পারবেন কিনা তা নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে। মহাসড়কে গাড়ি চলাচলে নিরাপত্তা দিতে ৱ্যাব, পুলিশ ও বিজিবি সমন্বিতভাবে কাজ করবে বলে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। বিজিবি সূত্র জানায়, বুধবার রাতে বিজিবির পাহারায় ৪৬৫টি পণ্যবাহী ট্রাক-কাভার্ড ভ্যানসহ বিভিন্ন যানবাহন চট্টগ্রাম ছেড়ে গেছে। বুধবার রাতে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের বসন্তপুর রাস্তার মাথায় একটি পাথও বোঝাই ট্রাকে আগুন দিয়েছে অবরোধকারীরা। গাইবান্ধার পলাশবাড়ী উপজেলায় রংপুর-ঢাকা মহাসড়কে মহেশপুর-ব্র্যাক মোড় এলাকায় বুধবার রাত থেকে বৃহস্পতিবার পর্যন্ত ২০-২৫টি গাড়ি ভাংচুর করেছে অবরোধকারীরা।

মেহেরপুর অফিস জানিয়েছে, অবরোধের সমর্থনে গতকাল বৃহস্পতিবার সাবেক এমপি ও বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য মাসুদ অরুনের নেতৃত্বে ২০ দলীয় জোট বিক্ষোভ মিছিল করেছে। ৭ দফা দাবি ও অবরোধের সমর্থনে মিছিলটি বিএনপি কার্যালয় থেকে বের হয়ে প্রেসক্লাব প্রাঙ্গণে গিয়ে শেষ হয়। মিছিলে উপস্থিত ছিলেন পৌর বিএনপির সভাপতি জাহাঙ্গীর বিশ্বাস, জেলা বিএনপির যুগ্ম সম্পাদক মাহাবুবুর রহমান, দপ্তর সম্পাদক আব্দুর রহিম, জেলা ছাত্রদল নেতা আহমেদ রাজিব খান, জেলা স্বেচ্ছাসেবক দলের যুগ্মআহ্বায়ক তোফায়েল আহমেদ ও জেলা তাঁতিদলের সাধারণ সম্পাদক জুয়েল হাসান প্রমুখ।