আন্তর্জাতিক চাপ বাড়ছে ফের : আলোচনার জন্য প্রস্তুত খালেদা জিয়া

স্টাফ রিপোর্টার: বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া বলেছেন, আলোচনার জন্য তিনি প্রস্তুত এবং আলোচনার মাধ্যমেই সমাধান হতে হবে বলে মনে করেন তিনি। গত সোমবার বিবিসির সাথে এক সাক্ষাৎকারে তিনি এ কথা বলেন। তবে জামায়াতের সঙ্গ ছাড়ার জন্য প্রধানমন্ত্রীর আহ্বান সম্পর্কে তিনি বলেন, বিএনপি তাদের রাজনীতির ব্যাপারে স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নেবে এবং কারো দ্বারা নির্দেশিত হবে না। অপরদিকে সমঝোতার মাধ্যমে শিগগিরই একটি অংশগ্রহণমূলক ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের লক্ষ্যে আন্তর্জাতিক চাপ বাড়ছে। ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে বেশির ভাগ ভোটার তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে না পারায় হতাশা প্রকাশ করেছে আন্তর্জাতিক মহল।

বিবিসির সাথে সাক্ষাতকারে খালেদা জিয়া বলেন, সরকারকে আলোচনার পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। আলোচনার আগে তার দলের নেতাকর্মীদের মুক্তি দিতে হবে, তাদের কার্যালয় খুলে দিতে হবে এবং তাকে বাড়ি থেকে বের হতে দিতে হবে। খালেদা জিয়া বলেন, বিএনপি তাদের আন্দোলন চালিয়ে যাবে। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে প্রহসনের নির্বাচন হিসেবে উল্লেখ করেন খালেদা জিয়া। এদিকে বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার বাসায় সাক্ষাৎ করেছেন বাংলাদেশে নিযুক্ত কানাডার হাইকমিশনার হিদার ক্রুডেন। খালেদা জিয়ার বাসা থেকে বেরিয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে কোনো কথা বলেননি হিদার ক্রুডেন।

গতকাল মঙ্গলবার রাত ৯টায় খালেদা জিয়ার বাসা থেকে বের হন কানাডার হাইকমিশনার। ওই সাক্ষাৎকালে উপস্থিত ছিলেন বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান শমসের মবিন চৌধুরী এবং চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা রিয়াজ রহমান। বিএনপি চেয়ারপারসনের গুলশানের বাসভবনের সামনে নিরাপত্তাব্যবস্থা অনেকটা শিথিল করা হয়েছে। কয়েক প্লাটুন পুলিশ প্রত্যাহার করা হয়েছে। তবে এখনো সেখানে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন রয়েছে বলে জানা গেছে। এদিকে গত ২৯ ডিসেম্বর থেকে পরিবারের সদস্য ছাড়া পুলিশ কাউকে খালেদা জিয়ার বাসায় প্রবেশ করতে না দিলেও সোমবার রাতে আইনজীবীদের প্রবেশের অনুমতি দেয়।

অপরদিকে সমঝোতার মাধ্যমে শিগগিরই একটি অংশগ্রহণমূলক ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের লক্ষ্যে আন্তর্জাতিক চাপ বাড়ছে। ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে বেশির ভাগ ভোটার তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে না পারায় হতাশা প্রকাশ করেছে আন্তর্জাতিক মহল। সর্বশেষ জাতিসংঘ মহাসচিব বান কি মুন একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের পথ বের করতে রাজনৈতিক দলগুলোর ব্যর্থতায় হতাশা জানিয়েছেন। এ পরিস্থিতিতে সহিংসতা বন্ধ করে সংলাপের মাধ্যমে দ্রুত নতুন নির্বাচনের উপায় বের করতে রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি আহবান জানিয়েছেন আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়। এর আগে যুক্তরাষ্ট্র, চীন, কমনওয়েলথ, যুক্তরাজ্য ও কানাডা সদ্যসমাপ্ত নির্বাচন নিয়ে তাদের স্পষ্ট অবস্থান জানিয়েছে। কিন্তু সদ্যসমাপ্ত নির্বাচনকে সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা রক্ষার নির্বাচন বলে উল্লেখ করেছে ভারত। বাংলাদেশের নির্বাচন প্রক্রিয়া ও রাজনৈতিক সহিংসতা সম্পর্কে ঢাকায় নিযুক্ত বিদেশি কূটনীতিকরা বরাবর সোচ্চার থাকলেও ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পর তারা কেউই মুখ খোলেননি। সদ্যসমাপ্ত এ নির্বাচন সম্পর্কে কোনো মন্তব্যও করেননি। তবে এ নির্বাচন সম্পর্কে এসব দেশের হেডকোয়ার্টার থেকেই এবার প্রতিক্রিয়া জানানো হয়েছে। বলা হয়েছে, এ নির্বাচনে বেশির ভাগ ভোটার ও রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণ ছিলো না। তাই তারা দ্রুত সংলাপের মাধ্যমে আরও একটি নির্বাচনের উপায় খুঁজে বের করতে রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি আহবান জানিয়েছেন। আর কোনো ধরনের সহিংসতা গ্রহণযোগ্য নয় বলে জানিয়েছে তারা।  জাতিসংঘ মহাসচিব বান কি মুন বাংলাদেশের জনগণের প্রত্যাশাকে গুরুত্ব দিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোকে জরুরি ভিত্তিতে অর্থবহ সংলাপ শুরুর তাগিদ দিয়েছেন। সোমবার জাতিসংঘ মহাসচিবের পক্ষে তার মুখপাত্র এক বিবৃতিতে এ তাগিদ দেন।

বিবৃতিতে বলা হয়, বাংলাদেশে ৫ জানুয়ারির নির্বাচন মেরুকরণ ও কম অংশগ্রহণমূলক বলে চিহ্নিত হয়েছে। এ নির্বাচনকে কেন্দ করে ব্যাপক প্রাণহানি ও সহিংসতার ঘটনায় জাতিসংঘ মহাসচিব মর্মাহত। যে নির্বাচন শান্তিপূর্ণ ও অংশগ্রহণমূলক হওয়া সম্ভব ছিলো, সেখানে রাজনৈতিক দলগুলো কোনো সমঝোতায় পৌঁছতে না পারায় হতাশ হয়েছেন বান কি মুন। এতে সবার আগে শান্তিপূর্ণ ও সহায়ক পরিবেশ সৃষ্টির আহ্বান জানানো হয়েছে, যাতে মানুষ সমবেত এবং শান্তিপূর্ণভাবে মত প্রকাশের অধিকারের চর্চা করতে পারে। তিনি বাংলাদেশের সব পক্ষকে সংযম দেখানোর আহ্বান জানিয়ে বলেছেন, সহিংসতা এবং মানুষ ও সম্পত্তির ওপর হামলা কখনোই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। তিনি জানান, বাংলাদেশে অংশগ্রহণমূলক, অহিংস, সমঝোতা ও সংলাপের ভিত্তিতে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার প্রতি সমর্থন দিয়ে যাবে জাতিসংঘ।

যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে হতাশা প্রকাশ করেছে। যুক্তরাষ্ট্র মনে করে, এ নির্বাচনের ফলাফলে জনগণের প্রত্যাশার কোনো প্রতিফলন ঘটেনি। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দফতরের উপমুখপাত্র মেরি হার্ফ সোমবার এক বিবৃতি সদ্য অনুষ্ঠিত নির্বাচন সম্পর্কে তাদের এ অবস্থান পরিষ্কার করেন। মেরি হার্ফ বলেন, সদ্য অনুষ্ঠিত নির্বাচনে অর্ধেকেরও বেশি আসনে প্রার্থীরা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন এবং বাকিগুলোর মধ্যে অধিকাংশ আসনেই নামমাত্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়েছে। তাই এ নির্বাচনের ফলাফল বাংলাদেশি জনগণের আকাক্সক্ষার প্রতিফলন ঘটেনি। মেরি হার্ফ আরও বলেন, নতুন সরকারের রূপ কী হবে, সেটা ভবিষ্যতেই জানা যাবে। কিন্তু বাংলাদেশের মানুষের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তার অঙ্গীকার অটুট থাকবে। আমরা বাংলাদেশ সরকার ও বিরোধীদলকে অবিলম্বে সংলাপে বসার জন্য উৎসাহিত করছি। যাতে তারা যতো শিগগির সম্ভব, একটি নতুন নির্বাচন অনুষ্ঠানের পথ খুঁজে বের করবে। আর সেটি অবাধ, নিরপেক্ষ, শান্তিপূর্ণ ও বিশ্বাসযোগ্য হওয়ার মাধ্যমে বাংলাদেশের মানুষের আকাক্সক্ষার প্রতিফলন ঘটাবে। বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত ৫ জানুয়ারির নির্বাচন নিয়ে হতাশা প্রকাশ করেছে যুক্তরাজ্য সরকারও। দেশটির দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী ব্যারোনেস সৈয়দা হুসেইন ওয়ার্সি সোমবার এক বিবৃতিতে এ হতাশার কথা জানান। তিনি জানান, এ নির্বাচনে বেশির ভাগ ভোটার তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারেননি, যা ভোট পড়েছে তাও অনেক কম, যাতে জনগণের প্রত্যাশার প্রতিফলন ঘটেনি। তাই জনগণের প্রত্যাশা অনুযায়ী সহিংসতামুক্ত, অংশগ্রহণমূলক ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের লক্ষ্যে সব রাজনৈতিক দলকে একসাথে কাজ করার আহ্বান জানান তিনি। তিনি বলেন, বাংলাদেশের সংবিধানের বিধান অনুযায়ী নির্বাচনের ঘোষিত ফলাফল আমরা গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছি। একটি পরিপক্ষ ও কার্যকর গণতন্ত্রের প্রকৃত প্রমাণ হল শান্তিপূর্ণ ও বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন। যাতে সাধারণ মানুষের ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটবে বলে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ও যুক্তরাজ্য বিশ্বাস করে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক হয়রানি, সহিংসতা ও সংঘাত বেড়ে যাওয়ায় উদ্বেগ জানান সৈয়দা ওয়ার্সি। বাংলাদেশের স্থিতিশীলতা, সমৃদ্ধিশালী ও গণতান্ত্রিক ভবিষ্যতের জন্য যুক্তরাজ্য সব ধরনের সহায়তা দেবে বলেও আশ্বাস দেন ওয়ার্সি।

ঢাকায় নিযুক্ত চীনা রাষ্ট্রদূত মঙ্গলবার ভাসানী অনুসারী পরিষদের সাথে মতবিনিময়কালে ৫ জানুয়ারির নির্বাচন নিয়ে কথা বলেন। তিনি জানান, এ নির্বাচনে প্রধান বিরোধীদলসহ বেশির ভাগ দল অংশ নেয়নি এবং অধিকাংশ ভোটার তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারেনি। এ নির্বাচনকে কেন্দ করে সংঘটিত সহিংসতা গণতন্ত্রের পাশাপাশি বাংলাদেশের অর্থনীতিকে যেভাবে ধ্বংস করেছে, তাতে চীন উদ্বিগ্ন। সরকার ও বিরোধীদল আন্তরিক হলে এ সঙ্কটের সমাধান সম্ভব বলে মন্তব্য করেন তিনি। ভারতীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র সৈয়দ আকবরউদ্দিন সোমবার এক বিবৃতিতে বলেন, ৫ জানুয়ারির নির্বাচন ছিলো বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ও সাংবিধানিক প্রক্রিয়ার অংশ। বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ কি হবে এবং কারা জনপ্রতিনিধিত্ব করবেন তা বাংলাদেশের জনগণই তা নির্ধারণ করবে। তিনি বলেন, সহিংসতার পথে কোনো সমাধান আসে না। তাই গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে তার নিজস্ব গতিপথে চলতে দিতে হবে।

৫ জানুয়ারির নির্বাচন সম্পর্কে সোমবার দেয়া এক বিবৃতিতে কমনওয়েলথের মহাসচিব কমলেশ শর্মী হতাশাজনক বলে উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেন, নির্বাচনে সীমিত সংখ্যক ভোটারের অংশগ্রহণ জনগণের প্রত্যাশার প্রতিফলন নয়। তাই দ্রুততার সাথে একটি শান্তিপূর্ণ ও অংশগ্রহণমূলক রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার লক্ষ্যে সংলাপ শুরু করার তাগিদ দেন। সেইসাথে রাজনৈতিক সহিংসতা কোনো অবস্থাতেই গ্রহণযোগ্য নয় বলে মন্তব্য করেন তিনি। কানাডার পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন বেয়ার্ড সোমবার দেয়া এক বিবৃতিতে বাংলাদেশের সদ্যসমাপ্ত নির্বাচনের ফলাফলে হতাশা জানিয়েছেন। এ নির্বাচনকে অংশগ্রহণমূলক করতে রাজনৈতিক দলগুলো ব্যর্থ হওয়ায় তিনি অসন্তোষ প্রকাশ করেন। বাংলাদেশের জনগণের রাজনৈতিক মতামত প্রকাশে ভোটাধিকারের সুযোগ প্রতিষ্ঠায় সর্বোচ্চ পদক্ষেপ নেয়ার জন্য রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি আহবান জানিয়েছে জাপান। ঢাকায় নিযুক্ত জাপানের রাষ্ট্র্রদূত শিরো সাদোশিমা মঙ্গলবার এক বিবৃতিতে এ আহ্বান জানান। এছাড়া রাজনৈতিক সহিংসতা ও জনগণের প্রতি সব ধরনের হুমকির কড়া নিন্দা জানান তিনি।