আজ ঐতিহাসিক মুজিবনগর দিবস

মহাসিন আলী/শেখ শফি: আজ ১৭ এপ্রিল ঐতিহাসিক মুজিবনগর দিবস। বাঙালি জাতির এক অবিস্মরণীয় দিন। ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন পলাশির আম্রকাননে বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজ-উদ-দৌল্লার পরাজয়ের মাধ্যমে বাংলার স্বাধীনতার সূর্য অস্তমিত হয়েছিলো। ২১৬ বছর পর ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল পলাশীর আম্রকাননের অদূরে মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলা আম্রকাননে বাংলাদেশের স্বাধীনতার নতুন সূর্য উদিত হয়।

মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম প্রধান সংগঠক ও নবগঠিত বাংলাদেশ সরকারের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ ১৯৭১ সালের ৩০ মার্চ চুয়াডাঙ্গা সীমান্ত দিয়ে ভারত গমনের সময় দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চল রনাঙ্গণের নেতৃবৃন্দের সাথে আলাপ আলোচনা করেন। ওই আলোচনার মাধ্যমে এ এলাকার নিরাপত্তা ও ভৌগলিক অবস্থা সম্পর্কে নিশ্চিত হন এবং ১৪ এপ্রিল শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানের তারিখ নির্ধারণ করেন। প্রথম দিকে চুয়াডাঙ্গাতে শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠিত হওয়ায় কথা থাকলেও যুদ্ধ পরিস্থিতির নাটকীয় পরিবর্তনের ফলে নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করে শপথ গ্রহণের স্থান চুয়াডাঙ্গার পরিবর্তে ইপিআর-উইং’র অধীন মেহেরপুর সীমান্ত এলাকা বৈদ্যনাথতলা নির্ধারণ করা হয়।

দিনের পর দিন মুক্তিযোদ্ধারা মরণপণ যুদ্ধের পরে স্বীকৃতি না পেয়ে মুক্তিকামী মানুষের মনোবল যখন ভাঙতে শুরু করে। ঠিক এমনই এক সঙ্কটকালীন সময়ে ভারতীয় বিএসএফ’র ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা গোলক মজুমদার ও ৭৬ বিএসএফ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লে. কর্নেল চক্রবর্তী বৈদ্যনাথতলায় এসে স্থানীয় সংগ্রাম কমিটি এবং তৎকালীন মহকুমা প্রশাসক তৌফিক-ই-এলাহীসহ আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের সাথে কথা বলে বৈদ্যনাথতলায় (বর্তমানে মুজিবনগর স্মৃতিসৌধ) জায়গা দেখিয়ে মঞ্চ তৈরির প্রস্তুতি সম্পন্ন করতে বলেন। আপামর জনতা স্বতঃস্ফুর্ত অংশগ্রহণের মাধ্যমে ১৬ এপ্রিল সকাল থেকে শুরু করে সারারাত ধরে মঞ্চ তৈরি, বাঁশের বাতা দিয়ে বেস্টুনি নির্মাণ এবং স্থানীয়ভাবে ভাঙা চেয়ার-টেবিল দিয়েই আয়োজন সম্পন্ন করেন। আনুসঙ্গিক সরঞ্জাম আসে ভারতের হৃদয়পুর বিএসএফ ক্যাম্প থেকে। অত্যন্ত গোপনীয়তার সাথে আয়োজন সম্পন্ন করা হয়।

১৭ এপ্রিল ১৯৭১ সেই মাহিন্দ্রক্ষণে তাজউদ্দীন আহমদ ও সৈয়দ নজরুল ইসলাম অন্যান্য নেতৃবৃন্দকে সাথে নিয়ে সকাল ৯টার দিকে বৈদ্যনাথতলায় পৌঁছান। ইতোমধ্যে দেশি-বিদেশি শতাধিক সাংবাদিক এবং ভারতীয় নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরাও আসেন। বহু প্রতিক্ষিত শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান শুরু হয় সকাল ১১টায়। মেজর আবু উসমান চৌধুরীর পৌঁছুতে বিলম্ব হওয়ায় ক্যাপ্টেন মাহবুবউদ্দীন আহমেদ ইপিআর আনসারের একটি ছোটদল নিয়ে নেতৃবৃন্দকে অভিবাদন জানান। অভিবাদন গ্রহণের পর স্থানীয় শিল্পীদের জাতীয় সঙ্গীত পরিবেশনের মধ্যদিয়ে সৈয়দ নজরুল ইসলাম বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন। পার্শ্ববর্তী গৌরিনগর গ্রামের প্রভাষক বাকের আলীর কোরআন তেলওয়াত এবং ভবরপাড়া গ্রামের মি. পিন্টু বিশ্বাসের বাইবেল পাঠের মাধ্যমে শুরু হয় আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম। এরপরে আওয়ামী লীগের চিফহুইফ অধ্যাপক মো. ইউসুফ আলী বাংলার মুক্ত মাটিতে স্বাধীনতাকামী কয়েক হাজার জনতা এবং শতাধিক দেশি-বিদেশি সাংবাদিকের সামনে দাঁড়িয়ে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠ করেন। ঐতিহাসিক সেই স্বাধীনতার ঘোষণা পত্রে প্রদত্ত ক্ষমতাবলে চিফ হুইফ অধ্যাপক ইউসুফ আলী রাষ্ট্র প্রধান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অনুপস্থিতিতে উপ-রাষ্ট্র প্রধান হিসেবে সৈয়দ নজরুল ইসলামকে শপথ বাক্য পাঠ করান। এরপর গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের প্রধান মন্ত্রী হিসেবে তাজউদ্দীন আহমেদের নাম ঘোষণা করেন এবং প্রধানমন্ত্রীর সাথে পরামর্শক্রমে মন্ত্রিপরিষদের সদস্য আইন, সংসদ ও পররাষ্ট্র মন্ত্রী হিসেবে খন্দকার মোশতাক আহমদ, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে এএইচএম কামরুজ্জামান এবং অর্থ মন্ত্রী হিসেবে ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলীকে পরিচয় করিয়ে দেন। এ অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান উপস্থিত না থাকলেও বারবার উচ্চাররিত হয় তার নাম।

মন্ত্রিপরিষদের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান সেনাপতি হিসেবে কর্নেল এমএজি ওসমানী এবং সেনাবাহিনীর চিফ অফ স্টাফ পদে কর্নেল আব্দুর রবের নাম ঘোষণা করা হয়। এরপরে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের প্রধান মন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমেদ উপস্থিত সকলের সামনে ৩০ মিনিটের এক উদ্দীপনাময় ভাষণ দেন। ভাষণে তিনি বলেন, আজ থেকে স্বাধীন বাংলাদেশের রাজধানী হবে এ বৈদ্যনাথতলা এবং এর নতুন নাম হবে মুজিবনগর। তিনি ওই ভাষণে বিশ্ববাসীর কাছে নতুন রাষ্ট্রের স্বীকৃতিদান ও সামরিক সাহায্যের আবেদন জানান।

বক্তৃতা এবং শপথ গ্রহণ পর্ব শেষে নেতৃবৃন্দ মঞ্চ থেকে নেমে এলে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতিকে গার্ড অব অনার প্রদান করেন মেজর আবু উসমান চৌধুরী। উপস্থিত জনতার মুহুমুহু জয়বাংলা ধ্বনিতে মুখরিত হয়ে ওঠে মুজিবনগরের আম্রকানন। সব মিলিয়ে ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যে অনুষ্ঠান শেষ হয়। মুজিবনগর সরকারের নেতৃত্বেই টানা ৯ মাস যুদ্ধ শেষে লাখ শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত হয় বাংলার স্বাধীনতা। বিশ্বের মানচিত্রে ঠাঁই করে নেয় স্বাধীন সার্বভৌম নামের বাংলাদেশ।

দিনটি উপলক্ষে মুজিবনগর স্মৃতি কেন্দ্রে সকালে সূর্যোদয়ের সাথে সাথে পতাকা উত্তোলন ও স্মৃতিসৌধে পুষ্পস্তবক অর্পণ এবং বীর মুক্তিযোদ্ধা, বিজিবি, পুলিশ বাহিনী, আনছার ভিডিপি, বিএনসিসি, গার্লস গাইড ও স্কুলের শিক্ষার্থী কতৃক গার্ড অব অনার প্রদান এবং কুচকাওয়াজ প্রদর্শন করা হবে। এছাড়া সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ের মন্ত্রী, আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় ও স্থানীয় নেতৃবৃন্দসহ সরকারি পর্যায়ের বিভিন্ন কর্মকর্তা উপস্থিত থাকবেন। দিনটিকে ঘিরে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে সকল ধরনের প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন জেলা প্রশাসক পরিমল সিংহ।

এদিকে মুজিবনগর দিবস উপলক্ষে বাংলাদেশ ডাক বিভাগের বি ২১২৯ জাতীয় শ্রমিক লীগের অন্তর্ভুক্ত কেন্দ্রীয় কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক আবদুস সালাম ডাকবিভাগের পক্ষথেকে কিছু দাবি উপস্থাপন করেছেন। দাবির মধ্যে রয়েছে মুজিবনগরে আন্তর্জাতিক মানের স্থলবন্দর প্রতিষ্ঠা, ১৭ এপ্রিলকে জাতীয় শপথ দিবস ঘোষণা করা, মুজিবনগরে বঙ্গ বন্ধু বহুমুখী কারিগরি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা, মুজিবনগরে শেখ মুজিব মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর প্রতিষ্ঠা, মুজিবনগরে আন্তর্জাতিক মানের পর্যটন কেন্দ্র ঘোষণা, সরস্বতী খালকে বিনদনের ক্ষেত্র হিসেবে রূপান্তর, প্রধানমন্ত্রীর অগ্রধিকার প্রকল্পের আওতায় মুজিবনগরের কর্মসংস্থান ব্যাংক স্থাপন, ঋণ প্রদান ও যুব-পুরুষ-নারীদের আত্মকর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা।