অস্পষ্ট খাতে আদায় হচ্ছে টাকা : প্রধান শিক্ষকদের দাবি সব ঠিক আছে

ফাইজার চৌধুরী: চুয়াডাঙ্গার দুটি সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়সহ অধিকাংশ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি ফি অতিরিক্ত আদায় করা হচ্ছে। অভিভাবকদের এ অভিযোগের প্রেক্ষিতে গত দু দিন ধরে চুয়াডাঙ্গার কয়েকটি বিদ্যালয়ে খোঁজ নিতে গিয়ে পাওয়া গেছে চাঞ্চল্যকর তথ্য।

চুয়াডাঙ্গা ভি.জে সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় এবং সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে চলতি শিক্ষাবর্ষে শিক্ষার্থী ভর্তি ফি বাবদ সাড়ে ৮শ টাকা করে আদায় করা হচ্ছে। তবে বিদ্যালয় দুটির প্রধান শিক্ষকদ্বয় বলেছেন, সরকারি প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী ৭শ টাকার বেশি নেয়া হচ্ছে না। পিকনিক বাবদ যে ১শ টাকা করে নির্ধারণ করা হয়েছে তা আর নেয়া হচ্ছে না। যাদের নিকট থেকে এ অর্থ আদায় করা হয়েছে তাদেরকে যথাযথভাবে ফেরত দেয়া হচ্ছে। অভিভাবকদের অনেকেই অভিযোগ করে বলেছেন, এমনসব খাত দেখিয়ে অর্থ আদায় করা হচ্ছে যা শুধু অস্পষ্টই নয়, হরেক নামের খাত দেখিয়ে আদায় করা অর্থ কীভাবে খরচ হয় তা নিয়েও দানা বেঁধেছে রহস্য।

সরকার যখন দেশে স্নাতক শ্রেণি পর্যন্ত নারী শিক্ষা অবৈতনিক করার চিন্তা-ভাবনা করছে ঠিক তখনই চুয়াডাঙ্গার সরকারি দুটি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে এবার নতুন শিক্ষাবর্ষে ছাত্র-ছাত্রীদের ভর্তি ফি আদায় শুরু করে ৮শ ৫০টাকা হারে। অবশ্য অভিভাবকদের আপত্তির মুখে বনভোজনের একশ টাকা আদায় না করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। এ দুটি স্কুলের দু প্রধান শিক্ষক জানিয়েছেন, সরকারি আদেশে বলা হয়েছে দেশের সরকারি স্কুলগুলো সর্বসাকুল্যে ৭শ টাকা সেশন ফি হিসেবে নিতে পারবে।

চুয়াডাঙ্গা সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে এ বছর তৃতীয় থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত ভর্তি ফি নেয়া হচ্ছে ৮শ ৫২ টাকা আর ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত ৮শ ৪২ টাকা। যে সকল খাত দেখিয়ে অর্থ নেয়া হচ্ছে তার মধ্যে রয়েছে, ক্রীড়া খাতে ৭০,  স্কুল ম্যাগাজিন বাবদ ৩০, লাইব্রেরি ১৫, গার্লস গাইড ৩০, হলদে পাখি ২৫, কমনরুম ৩০, দরিদ্র তহবিল ২০, পরীক্ষা নির্দেশিকা ৪০, সেলাই ২০, মিলাদ ২০, বিজ্ঞানাগার ২০, ব্যবস্থাপনা খাতে ১০০, রেডক্রিসেন্ট ২০, সাংস্কৃতিক ২৫, বিদায় ৩৫, তথ্য প্রযুক্তি ২০ ও বিবিধ ১৮০ টাকা। এসব খাতে আদায় করা অর্থ যথাযথভাবে ব্যয় হয় কি-না তা নিয়ে অভিভাবকদের মধ্যে সন্দেহ দানা বেঁধেছে।

শুধু মসজিদ বাবদই ৫০ টাকা হারে প্রতি শিক্ষাবর্ষে আদায় করা হয় ১ লাখ ১০ হাজার টাকা। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির এ দেশে অন্য ধর্মের অভিভাবকরা ঘোর আপত্তি জানিয়ে বলেছেন, বাংলাদেশে যার যার ধর্ম তার তার মত পালন করা গণতান্ত্রিক অধিকার। এখানে মসজিদ বা মিলাদের খাত দেখিয়ে অন্যান্য ধর্মের ছাত্র-ছাত্রীর কাছে থেকে টাকা আদায় অশোভনীয়

প্রধান শিক্ষকদ্বয় যা বললেন, চুয়াডাঙ্গা সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মাহফুজুল হোসেন উজ্জ্বলের সাথে যোগাযোগ করে উপরোক্ত বিষয়গুলো জানালে তিনি বলেন, ‘ছাত্রীদের ভর্তি ফি বাবদ যে টাকা নেয়া হচ্ছে তা ডিসি স্যারের সাথে বৈঠকের পর তার অনুমতিক্রমেই নির্ধারণ করা হয়েছে। ৮শ ৫০ টাকা এমন বেশি কী? বনভোজন নিয়ে অভিভাবকদের আপত্তি থাকলে এবার ছাত্রীদের টাকা ফেরত দেয়া হবে। বিবিধ ও ব্যবস্থাপনা খাতে আদায়কৃত টাকার প্রশ্নে তিনি জানান, ওই টাকায় স্কুলে মাস্টাররোলে যারা কাজ করে তাদের বেতন দেয়া হয়। আর ম্যাগাজিন নিয়মিত প্রকাশ না হওয়ার বিষয়ে প্রধান শিক্ষক মাহফুজুল হোসেন দাবি করেন ২০১২ সালের ম্যাগাজিন গত বছর বের করা হয়েছে। তার আগের তিন বছরের হিসাব অবশ্য তিনি দিতে পারেননি।

চুয়াডাঙ্গা ভি.জে স্কুলের প্রধান শিক্ষক শরীফ উদ্দিন বিশ্বাসের সাথে যোগাযোগে করা হলে তিনি আনীত অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, স্কুল ফান্ডে সব টাকা জমা থাকে। তবে ওই ফান্ডের কোনো তথ্য তিনি তাৎক্ষণিক দিতে পারেননি। শরীফ উদ্দিন দাবি করেন, যে সকল স্কুলে মসজিদ নেই ওই স্কুলগুলোও তো টাকা নিচ্ছে। আর আমার স্কুলে তো মসজিদ রয়েছেই। ভি.জে স্কুল মসজিদের রক্ষণাবেক্ষণ সম্পর্কেও তার কাছ থেকে কোনো হালনাগাদ তথ্য মেলেনি। সামাজিক খাতে টাকা আদায়ের বিষয়ে এ স্কুল প্রধান জানান, ও টাকা বহু বছর ধরে নিয়ে আসা হচ্ছে। এ খাত সম্পর্কেও কোনো তথ্য তিনি দিতে পারেননি। স্কুল ম্যাগাজিন তিনি দায়িত্ব গ্রহণের পর বেরিয়েছে তবে এখনও ছাত্রদের হাতে পৌঁছেনি বলে তিনি জানান। অন্য সব প্রশ্নে প্রধান শিক্ষক শরীফ উদ্দিন বিশ্বাস তার আগে যারা দায়িত্ব পালন করেছেন তাদের ওপর চাপিয়েছেন। আর অভিভাবকদের আপত্তি থাকায় পিকনিক বাবদ নেয়া টাকা ফেরত দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।

চুয়াডাঙ্গা জেলা প্রশাসক স্কুল কমিটির সভাপতি মো. দেলোয়ার হোসাইনের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, এ বিষয়ে বলতে হলে ফাইলপত্র দেখে তারপর বলা যাবে। অভিভাবক তথা সাধারণ মানুষ মনে করেন সন্তানের ভবিষ্যত চিন্তা করে প্রতিবছর ভর্তি মরসুমে চুয়াডাঙ্গার দুটি সরকারি স্কুলের প্রধান শিক্ষকের সিদ্ধান্ত মুখ বুঁজে সহ্য করে যান সবাই। এখন তাদের কার্যক্রম অনেকটা একপেশে বা স্বেচ্ছাচারিতায় পরিণত হয়েছে। ভর্তি ফি আদায়ের গোটা বিষয় আরও স্বচ্ছ হওয়া প্রয়োজন বলে অভিভাবকরা মনে করেন। তা ছাড়া যে সব খাত দেখিয়ে টাকা নেয়া হচ্ছে তার যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করা দরকার বলেও তারা দাবি করেন।

অন্যদিকে সচেতন মহল মনে করে মন্ত্রণালয় কর্তৃক নির্ধারিত ভর্তি ফিস  সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ যদি খাতওয়ারি ছক অনুসারে আদায় করতে বলতো তা হলে অভিভাবকদের মধ্যে বিভ্রান্তি সৃষ্টি হতো না।