অবরোধ সহিংসতা : ঝিনাইদহ কোর্টচাঁদপুরের এক শিবিরকর্মীসহ সারাদেশে নিহত ৫

চুয়াডাঙ্গায় প্রকাশ্যে পিকেটারদের দেখা না মিললেও চোরাগোপ্তা ইট নিক্ষেপে ট্রাকের কাঁচ ভাঙচুর : মেহেরপুরের আমঝুপিতে জোরালো পিকেটিং

 

মাথাভাঙ্গা ডেস্ক: দ্বিতীয় দফা ৭২ ঘণ্টার অবরোধের প্রথম দিনে চুয়াডাঙ্গা-মেহেরপুর তুলনামূলক শান্ত থাকলেও ঝিনাইদহের কোটচাঁদপুরে পুলিশের গুলিতে নিহত হয়েছেন শিবিরের এক কর্মী। গতকাল শনিবার সকাল ৯টার দিকে তুমুল সংঘর্ষের সময় গুলিবিদ্ধ হয়ে শিবিরকর্মী ইসরাফিল হোসেন নিহত হয়। এর প্রতিবাদে আজ রোববার কোর্টচাঁদপুর ও মহেশপুর উপজেলায় সকাল-সন্ধ্যা হরতালের ডাক দেয়া হয়েছে। অপরদিকে ৭২ ঘণ্টার অবরোধ শেষ হতে না হতে মঙ্গলবার থেকে আবারো সপ্তাজুড়ে অবরোধের ডাক দেয়া হতে পারে বলে দলীয়সূত্র জানিয়েছে। টানা অবরোধে সারাদেশ স্থবির হয়ে পড়েছে।

Jhenidah Photo

অবরোধের প্রথমদিন দেশজুড়েই সংঘর্ষ, সহিংসতার খবর পাওয়া গেছে। গতরাত ৮টার দিকে ঢাকা সদরঘাট থেকে রামপুরাগামী সুপ্রভাত পরিবহনের একটি বাসে রাজধানীর মালিবাগ চৌধুরীপাড়ায় অবরোধকারীরা পেট্রোলবোমা ছুঁড়ে মারলে বাসটি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে পাশের রিকশাসহ পথচারীদের চাপা দেয়। এতে ঘটনাস্থলেই পথচারী হাবিবুর রহমান (৩১) মারা যান। এছাড়া পথচারী অ্যাডভোকেট গোলাম কিবরিয়ার (৪৫) বাম হাত বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। অপর পথচারী মহিউদ্দিনের বাম পা ভেঙে গেছে। এছাড়া বাসের যাত্রী রেজাউল করিম ও বাসের হেলপার মনির হোসেন আগুনে দগ্ধ হয়ে ঢাকা মেডিকেলের বার্ন ইউনিটে ভর্তি হয়েছেন। পাবনায় মিছিলে ট্রাক ঢুকে যুবদলের মহাবুল নামের একজন নিহত হয়েছে। ফরিদপুরেও নিহত হয়েছে একজন। নিজের কাছে থাকা বোমার আঘাতে গতরাতে নিহত হয় সে। চট্টগ্রামে বাসের ছাদ থেকে পড়ে নিহত হয়েছে নিতাই নামের একজন বাস আরোহী। বগুড়াতেও গতকাল একজন নিহত হয়েছে বলে সংবাদমাধ্যম জানিয়েছে।

চুয়াডাঙ্গা জেলা শহরের প্রধান প্রধান সড়কে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী নেতাদের তেমন প্রকাশে ঘুরতে দেখা যায়নি। পুলিশ ছিলো আক্রামন্তক অবস্থায়। এর মধ্যেও চোরাগোপ্তা হামলা হয়েছে। চুয়াডাঙ্গা জেলা বিএনপির কার্যালয়ের অদূরবর্তী বালিকা বিদ্যালয়ের সামনে একটি ট্রাকে ইট নিক্ষেপ করে কাঁচ ভেঙে দেয়া হয়েছে। চুয়াডাঙ্গা-মেহেরপুর সড়কে বঙ্গজের অদূরে রাস্তার ওপর কাঠ ফেলে গতরাত ৯টার দিকে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়। অবরোধের কারণে চুয়াডাঙ্গা মেহেরপুরের শবজিচাষিরা ভয়াবহ ক্ষতির মুখে পড়েছেন। ফুলকফি নিয়ে কৃষকদের দুশ্চিন্তার শেষ নেই। অনেকের ফুলকপি ক্ষেতেই ফুটে ঝরে যাচ্ছে। অবরোধের শেষ কোথায়, কবে হবে রাজনৈতিক সমাধান? এ প্রশ্নের জবাব সাধারন মানুষের জানা নেই।

ঘোষিত ১০ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনী তফশিল বাতিল করে নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে গতকাল শনিবার ভোর ৬টা থেকে সারাদেশে বিএনপি নেতৃত্বাধীন ১৮ দলীয় জোট ৭২ ঘণ্টার অবরোধ কর্মসূচি পালন করছে। আজ দ্বিতীয় দিন। প্রথম দিনে চুয়াডাঙ্গার সড়কে অটো ও শ্যালোইঞ্জিন চালিত বিভিন্ন নামের কিছু যান চলতে দেখা গেলেও বাস-ট্রাক থ্রিহুইলার চলেনি। সড়কে মোটরসাইকেলও ছিলো তুলনামূলকভাবে কম। জোরালো পিকেটিং না থাকলেও পুলিশি টহল ও বিভিন্ন স্থানে পুলিশের সাজোয়া অবস্থান লক্ষ্য করা গেছে। গতরাতেই পুলিশ গ্রেফতার অভিযান চালায়। তবে শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত কাওকে গ্রেফতারের তথ্য দিতে পারেনি পুলিশ।

ঝিনাইদহ অফিস জানিয়েছে, গতকাল শনিবার ঝিনাইদহের কোটচাঁদপুরে ১৮ দলীয় জোটের নেতাকর্মীদের সাথে পুলিশের সংঘর্ষ হয়েছে। সংঘর্ষ চলাকালে পুলিশের গুলিতে ইসরাইল হোসেন (২৪) নামে এক শিবিরকর্মী নিহত হয়েছেন। এ সময় ৩ পুলিশ সদস্যসহ আহত হয়েছেন অন্তত ১০ জন। নিহত ইসরাইল কোটচাঁদপুর উপজেলার হরিণদিয়া গ্রামের শহিদুল ইসলামের ছেলে। এদিকে শিবিরকর্মী নিহতের প্রতিবাদে আজ রোববার জেলার ৬ উপজেলায় সকাল-সন্ধ্যা হরতাল ডেকেছে ১৮ দল।

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, গতকাল শনিবার সকাল সাড়ে ৯টার দিকে বিএনপি ও জামায়াত-শিবিরের নেতা-কর্মীরা কোটচাঁদপুর শহরের মেন বাসস্ট্যান্ডে কালীগঞ্জ-জীবননগর সড়ক অবরোধ করে রাখে। এ সময় পুলিশ অবরোধকারীদের সরে যেতে বললে তাদের সাথে পুলিশের সংঘর্ষ বেধে যায়। তবে দু সহস্রাধিক অবরোধকারীর প্রতিরোধে পিছু হঁটে পুলিশ। পরে সকাল সাড়ে ১০টার দিকে কোটচাঁদপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা দেবুপ্রসাদ পালের নেতৃত্বে পুলিশ আবারও বাসস্ট্যান্ড এলাকায় যায়। একপর্যায়ে পুলিশ ও অবরোধকারীদের মধ্যে সংঘর্ষ বেধে যায়। অবরোধকারীদের হঁঠাতে ২৫/৩০ রাউন্ড গুলি ও ২ রাউন্ড টিয়ারসেল নিক্ষেপ করলে তারা ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। অবরোধকারীরা পুলিশকে লক্ষ্য করে ৮/১০টি হাত বোমা ছুড়ে মারে। এ সময় অবরোধকারীদের ইটপাটকেলের আঘাতে ৩ পুলিশ সদস্য আহত হন। পুলিশের গুলিতে শিবিরকর্মী ইসরাইল হোসেন ও কোটচাঁদপুর উপজেলা স্বেচ্ছাসেবকদলের ক্রীড়া সম্পাদক ইমদাদুল হক গুলিবিদ্ধসহ বেশ কয়েকজন আহত হন। আহতদের মধ্যে দুজনকে আশঙ্কাজনক অবস্থায় যশোর মেডিকেলে পাঠানো হয়েছে।

কোটচাঁদপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের আবাসিক মেডিকেল অফিসার ডা. সিদ্দিক হোসেন জানান, সকাল ১১টার দিকে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় হাসপাতালে আনা হলে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ইসরাইল হোসেন নামে এক যুবক মারা যান। এদিকে বেলা ১২টার দিকে কোটচাঁদপুর হাসপাতাল থেকে নিহত শিবিরকর্মীর লাশ গ্রামের বাড়ি হরিণদিয়া নিয়ে যায় দলীয় নেতাকর্মীরা। দুপুর ২টার দিকে পুলিশ সেখান থেকে লাশ নিয়ে আসে। ঝিনাইদহ সদর হাসপাতালমর্গে ময়নাতদন্ত শেষে নিহতের পরিবরের কাছে লাশ হস্তান্তর করা হবে বলে পুলিশ জানিয়েছে। কোটচাঁদপুর থানার ওসি শাজাহান আলী বলেন, পুলিশকে লক্ষ্য করে ১৮ দলীয় জোট সর্মথকরা ককটেল ও ইটপাটকেল নিক্ষেপ করার পরে পুলিশ বাধ্য হয়ে গুলি চালায়। এ সময় একজন নিহত হয়েছেন বলে তিনি শুনেছেন।

ঝিনাইদহ জেলা ছাত্রশিবির সভাপতি শাহজালাল বলেন, পুলিশের ছোড়া শর্টগানের গুলিতে তাদের কর্মী ইসরাইল নিহত হয়েছেন। শান্তিপূর্ণ অবরোধ কর্মসূচিতে পুলিশ গুলি চালিয়েছে। এ ঘটনার প্রতিবাদে ১৮ দলীয় জোট আজ রোববার জেলাব্যাপি সকাল-সন্ধ্যা হরতালের ডাক দিয়েছে বলে তিনি জানান।

শিবিরকর্মী নিহতের পর কোটচাঁদপুর শহরে চাপা উত্তেজনা বিরাজ করছে। পুলিশের পাশাপাশি এলাকায় র‌্যাব ও পুলিশ অবস্থায় নিয়েছে। পুলিশের ওপর হামলা-বোমাবাজি, সরকারি কাজে বাধাদানের ঘটনায় কোটচাঁদপুর থানায় একাধিক মামলা দায়েরের প্রস্তুতি চলছে বলে কোটচাঁদপুর সার্কেলের সহকারী পুলিশ সুপার জাহিদুল ইসলাম সাংবাদিকদের জানান।

এদিকে ঝিনাইদহের সড়ক-মহাসড়কগুলোতে গাছ ও গাছের গুঁড়ি ফেলে এবং আগুন জ্বালিয়ে অবরোধ করে পিকেটাররা। ফলে কোনো ধরনের ইঞ্জিনচালিত যানবাহন চলাচল করছে না। দোকানপাট ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে।

কোটচাঁদপুর প্রতিনিধি জানিয়েছেন, ৭২ ঘণ্টা অবরোধের প্রথম দিনে কোটচাঁদপুরে পুলিশের গুলিতে একজন নিহত ও ৫ জন আহত হয়েছে।  পরিস্থিতি সামাল দিতে বিজিপি মোতায়েন করা হয়েছে। সকাল সাড়ে ১০টার দিকে মেন বাসস্ট্যান্ডে অবরোধকারীরা রাস্তা অবরোধ করে। এ সময় অবরোধকারীরা বাসস্ট্যান্ডে একটি হাত বোমার বিস্ফোরণ ঘটায়। এ ঘটনার পরপরই পুলিশ বাসস্ট্যান্ডে অবস্থান নিলে পুলিশ-অবরোধকারীদের মধ্যে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া ও পুলিশের ওপর অবরোধকারীরা ইটপাটকেল নিক্ষেপ শুরু করে। এক পর্যায়ে পুলিশ শর্টগানের গুলিবর্ষণ শুরু করে। এ সময় ইসরাইল (৩০) ও ইনতাজ আলী (৩২) নামে দুজন গুলিবিদ্ধ হয়। আহত ইসরাইলকে স্থানীয় হাসপাতালে নেয়ার পর তার মৃত্যু হয়। নিহত ইসরাইল শিবিরকর্মী বলে জানা গেছে। সে উপজেলার হরিণদিয়া গ্রামের শহিদুল ইসলামে ছেলে।

অপরদিকে আহত ইনতাজ উপজেলার মুরুটিয়া গ্রামের ইলাহি বক্সের ছেলে। সে থানা স্বেচ্ছাসেবকদলের কর্মী বলে জানা গেছে। পুলিশের গুলিবর্ষণে ১৮ দলের আরো ৩/৪ জন আহত হয়েছে বলে অসমর্থিত সূত্রে জানানো হয়। কোটচাঁদপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা শাজাহান আলী জানান, পুলিশ আত্মরক্ষার্থে ২০ রাউন্ড শর্টগানের গুলিবর্ষণ করেছে। গুলিতে আহত হওয়ার ব্যাপারে তাৎক্ষণিকভাবে তিনি কোনো তথ্য দিতে পারেননি। ঘটনার পরই নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট দেবু প্রসাদ পাল ও মাসুম আলীর নেতৃত্বে বাসস্ট্যান্ডে বিজিপি মোতায়েন করে রাস্তায় ব্যারিকেড অপসারণ করা হয়েছে। বর্তমানে পরিস্থিতি থমথমে অবস্থায় বিরাজ করছে।

আলমডাঙ্গা ব্যুরো জানিয়েছে, শনিবার বিকেল ৪টার দিকে আলমডাঙ্গা উপজেলা জামায়াত-শিবির পশ্চিম শাখা বৈদ্যনাথপুর ভোলার মোড়ে বিক্ষোভ সমাবেশ করে। আলমডাঙ্গা উপজেলা পশ্চিম শাখা জামায়াতের আমির ডা. আহমেদ জালাল, সাধারণ সম্পাদক আব্বাস উদ্দীন, ছাত্রশিবির সভাপতি নাজমুস সাকিব সমাবেশে বক্তব্য রাখেন।

আলমডাঙ্গা ব্যরো আরও জানিয়েছে, আলমডাঙ্গা উপজেলা ও পৌর বিএনপি গতকাল আলমডাঙ্গা-কুষ্টিয়া সড়ক অবরোধ করে। পরে সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়েছে। সভাপতিত্ব করেন কালিদাসপুর ইউনিয়ন বিএনপির সভাপতি আলি হোসেন। প্রধান অতিথি ছিলেন উপজেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক শেখ সাইফুল ইসলাম। উপস্থিত ছিলেন  সাংগঠনিক সম্পাদক আনোয়ার হোসেন, সহসভাপতি আব্দুল জব্বার, পৌর বিএনপির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ইসরাফ হোসেন, পৌর বিএনপির সম্পাদক আজিজুর রহমান পিন্টু, এমদাদুল হক ডাবু, বোরহান উদ্দিন, রেজাউল করিম, একরামুল হক বুলু, হাফিজুর রহমান চমক, শওকত খান, মহিদুল উসলাম, মাগরিবুর রহমান, ওহিদুল ইসলাম বাবু, যুবদল নেতা ফারুক হোসেন মুকুল, গোলাম, রফিকুল, ছাত্রনেতা লিমন, রহিদ, রানা, মানিক, সবুজ, শিমুল, সুইট প্রমুখ।

মেহেরপুর অফিস জানিয়েছে, শনিবার সকাল সাড়ে ৬টার দিকে মেহেরপুর-চুয়াডাঙ্গা সড়কের মেহেরপুর সদর উপজেলার রাজনগর মোড়ে অবরোধ করেছেন জামায়াত-শিবির নেতাকর্মীরা। এতে ওই সড়কে সকল প্রকার যানবাহন চলাচল বন্ধ রয়েছে। বিক্ষুব্ধ অবরোধকারীরা সড়কের ওপর টায়ারে আগুন দিয়ে দফায় দফায় বিক্ষোভ প্রদর্শন করছেন। অবিলম্বে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পুনঃপ্রতিষ্ঠার দাবি জানিয়ে সরকারবিরোধী বিভিন্ন স্লোগানে চলছে বিক্ষোভ সমাবেশ। অবরোধের কারণে ভোর থেকেই দূরপাল্লার ও আন্তঃজেলা সকল প্রকার বাস চলাচল বন্ধ রয়েছে।

এদিকে গতরাতে মেহেরপুর থেকে আলগামনযোগে সবজি নিয়ে জেলার বাইরে পৌঁছে দেয়ার চেষ্টা করলে আমঝুপিবাজার এলাকায় অর্ধশতাধিক সবজি বোঝায় নসিমন, করিমন ও আলগামন অবরোধকারীরা ফেরত পাঠায় বলে স্থানীয়সূত্র জানায়।