ছেলেকে ক্রিকেট থেকে দূরে রাখার অনেক চেষ্টা করেছিলেন বাবা

মিরাজদের বাড়ি এখন যেন মেলার মাঠ!

 

পাট, কাগজ, খাবার– হরেক রকমের পণ্য তৈরি হয় বিশাল কারখানা কিংবা ছোট ছোট ক্ষুদ্র শিল্প প্রতিষ্ঠানে। রাস্তা ধরে চলতে থাকলে নানান পণ্য উত্পাদনের শব্দ, গন্ধ এসে বুঝিয়ে দেয় এলাকাটির বৈশিষ্ট্য। শিল্প এলাকার বসতবাড়িগুলোরও নিজস্ব একটা চরিত্র আছে; সারাদিন নিরিবিলি, সকাল-সন্ধ্যায় হইচই। রাস্তা থেকে তাকালে এই বাড়িটাকেও আলাদা কিছু বলে মনে হয় না। শুধু আলাদা বলতে, বাড়িতে ঢোকার রাস্তার মুখে একটা বড়সড় জটলা। স্কুলছাত্রদের জটলার কাছে গিয়ে কৌতূহল প্রকাশ করতেই তারা এক বাক্যে বললো– এটা মিরাজ ভাইয়ের বাড়ি। হ্যাঁ, খুলনা শহরের খালিশপুরের এই এলাকাটার পরিচয়ই এখন ‘মিরাজ ভাইয়ের বাড়ি’। মেহেদী হাসান মিরাজ অনেক আগে থেকেই বাংলাদেশের ক্রিকেটের তারকা। সেই ১২ বছর বয়স থেকেই বয়সভিত্তিক জাতীয় দলের জার্সি উঠেছে গায়ে। এই কয়েকদিন আগেই যুব দলের অধিনায়ক হিসেবে টানা দ্বিতীয় বিশ্বকাপ খেললেন, ঘরের মাটিতে বিশ্বকাপে নেতৃত্ব দিলেন। ফলে এলাকায় ‘মিরাজ ভাই’ নতুন তারকা নন। তবে ঢাকা টেস্টে বাংলাদেশ দলকে ঐতিহাসিক এক জয় এনে দেয়ার পর থেকে এই বাড়িটা রীতিমতো ক্রিকেট ভক্তদের কাছে ‘দর্শনীয় স্থান’ হয়ে উঠেছে। ঢাকা টেস্ট শেষ হওয়ার পরদিন দুপুরে মিরাজের বাড়ি পৌঁছানোর পর মনে হলো ছোটখাটো কোনো এক মেলার মাঠে চলে এসেছি। মূল রাস্তা থেকে একটা সরু রাস্তা ধরে কয়েক কদম এগোলেই একটা টিনের দো-চালা ঘর। উঠোনে এক গাদা চেয়ার বসানো। সেসব চেয়ার দখল করে ফেলেছেন মিরাজকে শুভেচ্ছা জানাতে আসা লোকজন। এই অতিথিদের ভেতর সংবাদকর্মী আছেন, এলাকার ক্রিকেটাররা আছেন, আছেন আত্মীয়-স্বজনেরা এবং মহল্লার প্রতিবেশীরা। এক পাশে বসে সবার কৌতূহল মেটাচ্ছেন মিরাজের বাবা জালাল হোসেন। কাছে গিয়ে কুশল বিনিময় করতে পরিচয় জানার আগেই হাক দিলেন, ‘আরও মেহমান আসছে। মিষ্টি পাঠাও বাইরে।’ বোঝা গেলো, যত অভ্যাগত আসছেন, সবাইকে মিষ্টিমুখও করানো হচ্ছে! একটু খোঁজ-খবর নিয়ে জানা গেলো, আগের দিন বিকেলে মিরাজ যখন স্টিভেন ফিনকে এলবিডব্লিউ করলেন, তারপর থেকেই শুরু হয়েছে এই উত্সব। বাংলাদেশ মেতেছে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ১০৮ রানে নিজেদের ইতিহাসের এ যাবত্কালের শ্রেষ্ঠতম ক্রিকেট ম্যাচ জয়ের আনন্দে। আর এলাকার মানুষ এই মিরাজদের বাড়ি এসে মেতেছেন যেন ‘বিশ্ব জয়ের’ আনন্দে। তবে মেহেদী হাসান মিরাজ জন্মসূত্রে বরিশালের বাকেরগঞ্জ উপজেলার ছেলে। বাবার হাত ধরে ছোট বোন রুমানা আক্তার মিম্মা আর মায়ের সাথে খুলনায় এই ভাড়া বাড়িতে চলে আসেন মিরাজরা। মিরাজের বাবা জালাল পেশাগত জীবনে অনেক কষ্টই করেছেন সংসার চালিয়ে নিতে। স্বপ্ন ছিলো ছেলেটা তার বিএ, এমএ পাস করে বড় কোনো চাকরি করবে। কিন্তু ছেলে হাঁটতে শেখার পরপরই ক্রিকেটে ভিড়ে গেলো। শুরুতে তার ক্রিকেট জীবনকে পাত্তাই দেননি জালাল সাহেব। পড়াশোনার ক্ষতি হতে পারে ভেবে খুব চেষ্টা করেছিলেন ক্রিকেট থেকে ছেলেকে দূরে সরিয়ে রাখতে। নিজেই হাসতে হাসতে বলছিলেন, ‘আমরা তো গরীব মানুষ। স্বপ্ন দেখি, ছেলে-মেয়ে পড়াশোনা করে চাকরি করবে। ক্রিকেট খেলে যে ভবিষ্যত্ আছে, তা তো বুঝতাম না।‘ তবে এই বাধার মধ্যে মিরাজ পরিবারে একজন সমর্থক পেয়ে যান, দাদা। মিরাজের দাদা গানবাজনা করতেন যৌবনে। নাতি তাই পড়াশোনার এই ছকে বাঁধা জীবনের বাইরে কিছু করায় খুব সমর্থন ছিলো তার। কিন্তু মানুষের নিয়তি। সেই মিরাজ যে বছর প্রথম বয়সভিত্তিক দলে ডাক পেলেন, সেই বছরই ইহলোক ছেড়ে গেলেন তার দাদা। মিরাজ তার দাদার স্বপ্নপূরণ করেছেন। পূরণ করেছেন তাকে নিয়ে দেখা কোচ সালাউদ্দিন আহমেদের স্বপ্নও। খুলনার আরো অনেক ক্রিকেটারের মতো এই মিরাজেরও পথচলা শুরু প্রয়াত এই কোচের হাত ধরে। আজ ওপর থেকে তাকিয়ে মিরাজের দাদা বা কোচ নিশ্চয়ই তৃপ্ত হয়ে দেখেন, সেদিনের পিচ্চি ছেলেটা আজ টেস্ট জেতাচ্ছে বাংলাদেশকে! গল্প অবশ্য একটানা চলতে পারে না। একটার পর একটা ফোন আসে। ফোন না ধরার অনুরোধ করতেই মিরাজের বাবা বলেন, ‘কাউকে কী নিরাশ করা যায়? সবাই তো মিরাজকে ভালোবাসে বলেই ফোন করছে। মিরাজ তো আমার একার ছেলে নয়।’ এই পুরো পরিবারটাতে এই ‘সার্বজনীনতা’ বোধ চলে এসেছে। মিরাজের বোন, বিএল কলেজের ছাত্রী রুমানা আক্তার মিম্মা যেমন বলছিলেন, ‘ভাইয়া জাতীয় দলে খেলা শুরুর করার আগে থেকেই আমরা বাংলাদেশের খেলার সময় সবাই একসাথে খেলা দেখি, দলের জন্য প্রার্থনা করি। কাল তো খেলার সময় আমরা বলছিলাম, দল জিতলেই হয়। ভাইয়া উইকেট না পেলে ক্ষতি নেই।’

পাস থেকে তার বাবা কথাটা কেড়ে নিয়ে বললেন, ‘দেখেন, আমি মনে করি মিরাজ একা নয়। মাঠের লড়াইয়ে নামা এগারো জনই আমার মিরাজ। আজ আমার ছেলে ভালো খেলেছে, রোজ সে পারবে না। কিন্তু আরেকদিন অন্য কোনো ছেলে মাঠে ভালো করে দলকে জেতাবে। মাঠে বাংলাদেশের পক্ষে লড়াই করা সব ক্রিকেটারই আমার সন্তানের মতো।’